বইমেলার দিগন্ত-ছোঁয়া আকাশ by সেলিনা হোসেন

২০১৭ সালের ডিসেম্বরের ২১ তারিখে শুরু হয়েছিল খড়দহ বইমেলা। ১৮ বছর ধরে এই বইমেলা বছরে একবার আয়োজিত হচ্ছে। আমার কখনো এই বইমেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে এই বইমেলার খবর পত্রিকায় পড়েছি। যাদের এই বইমেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তাদের কাছে বইমেলা সম্পর্কে গল্প শুনেছি। তারা ভালোলাগার কথাই বেশি করে বলত। আমার ধারণা হয়েছিল ছোট বইমেলার বড় পরিসর নিয়ে খড়দহ বইমেলা লেখক-পাঠকের প্রাণের বইমেলা হয়েছে। এ বছর মেলা আয়োজক কমিটি সিদ্ধান্ত নেন যে এখন থেকে বাংলাদেশের একজন লেখককে এই মেলার উদ্বোধনী দিনে আমন্ত্রণ জানান হবে। বইমেলা কমিটির সিদ্ধান্ত আমার পক্ষে আসে। বইমেলার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন শ্রী কাজল সিনহা। আমি উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য মানস চক্রবর্তীর কাছ থেকে আমন্ত্রণ পত্র পাই। খড়দহ বইমেলা দেখার সুযোগ আমি পাই। সেদিন মঞ্চে অনেকে ছিলেন। ছিলেন কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী। সবার বক্তৃতার পরে গান গেয়েছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন।
খড়দহ মেলার পরিসর অনেক বড় নয়। চারদিকের বসতির মাঝে একটি মাঠ ব্যবহৃত হয় এই মেলার জন্য। দেখলাম ৪০টি বইয়ের স্টল আছে। মাঠভর্তি মানুষের উপস্থিতি দেখে মনে হয়েছে ছোট বইমেলার বড় দিগন্ত। মেলাজুড়ে মানুষের উপস্থিতি বইয়ের হাত ধরে। এমন দৃশ্যটি আমার মাঝে সীমান্ত পেরিয়ে আসার আনন্দ আকাশ-ছোঁয়া করে ফেলে। এই বইমেলার যে বিষয়টি আমার আরও ভালো লেগেছে তাহলো ঘনবসতির মাঠে অনুষ্ঠিত মেলা মানুষের দোরগোড়ার আয়োজন। শিশুদের হাত ধরে বাবা-মায়েরা মেলায় আসছে। বই কিনছে। গাড়ি ভাড়া করে দূরে কোথাও যেতে হচ্ছে না। হাতের কাছে এত বই না কিনে কি উপায় আছে! দুচারটা তো কিনতেই হয়। এভাবে বইমেলার ছোট আয়োজনে মানুষ হাতের কাছে বই পায়। বই পৌঁছে যায় বড়দের কাছে, ছোটদের কাছেও। খড়দহ মেলা প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আমি প্রাণের টান অনুভব করি।
একজন লেখক হিসেবে বইমেলা আমার কাছে আপন অস্তিত্বের মতোই একটি বিষয়। বাংলা একাডেমিতে ৩৪ বছর চাকরি করে অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমি দেখেছি খুব কাছে থেকে প্রতিদিন, প্রতিটি সময়ে। এর চরিত্র শুধু বই প্রকাশ এবং বিক্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই বইমেলা ভাষা আন্দোলনের শহীদের রক্তে প্রতিষ্ঠিত বাংলা একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত এবং একুশে ফেব্রুয়ারির উপলক্ষ হলেও সারা মাস জুড়ে বইমেলার আবেদন জাতীয় মননের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমি জানি না সারা মাস জুড়ে অন্য কোনো দেশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় কি না। বাংলা একাডেমি আয়োজিত ফেব্রুয়ারি বইমেলাটি আমাদের একদম নিজস্ব বইমেলা। নিজেদের লেখক, নিজেদের প্রকাশনা এবং নিজেদের ভাষার পাঠকের মহাসম্মেলন এই মেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। জাতিসত্তার এমন অসাধারণ রাখিবন্ধন করেছে আমাদের অমর একুশে গ্রন্থমেলা।
এছাড়াও আমি বিভিন্ন সময়ে ভারতের তিনটি প্রদেশের বইমেলায় আমন্ত্রিত হয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। ১৯৯৬ সালে প্রথম যাই দিল্লিতে। ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ দিন ধরে চলেছিল এই মেলাটি। এটি ছিল দিল্লির দ্বাদশ বিশ্ব বইমেলা। মেলার থিম ছিল ‘সার্ক দেশসমূহ’। সার্কদেশসমূহের সাতজন লেখক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। মেলার উদ্বোধন করেছিলেন পাকিস্তানের কবি আহমদ ফরাজ। আমাকে দেয়া হয়েছিল ইংরেজি ও হিন্দি বইয়ের তালিকা (ক্যাটালগ) অবমুক্ত করার জন্য। সাতটি দেশের সাতজন লেখকই কিছু না কিছু করেছিলেন। বইমেলাটির আয়োজন করেছিল ‘ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া। আমার লিখিত ভাষণে আমি বলেছিলাম, ‘আমি মনে করি বইমেলা এমন সম্মেলনের ও অঙ্গীকারের প্রতীক, যা একটি বিশেষ দেশের সীমানাকে ছাড়িয়ে যায়। বই যেভাবে দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনা হ্রাস করে মানুষকে শান্তি ও সৌহার্দ্যরে পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তেমনটি আর কিছু পারে বলে আমি মনে করি না এবং বইমেলাই আমি বিশ্বাস করি, মারণাস্ত্র, সামরিক শাসন, স্বৈরাচার, অসাম্য এবং অন্য যা কিছু মানুষকে মানুষ হিসেবে খর্ব করে, তার বিরুদ্ধে শপথ উচ্চারণ করার এবং নিজেদের আত্মাকে বিকিয়ে না দেয়ার জন্য অঙ্গীকার ঘোষণার সর্বোত্তম সুযোগ এনে দেয়। এই বিশ্বমেলা আয়োজনের জন্য আমি ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াকে অভিনন্দন জানাই।’ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল দিল্লির প্রগতি ময়দানে। পাশাপশি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান। অসংখ্য লেখক, অজস্র বই আমার জন্য ছিল এক বিপুল অভিজ্ঞতা। বিভিন্ন দেশ থেকে, বিশেষ করে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা লেখক এবং প্রকাশকরা আমার মনোযোগ কেড়েছিল। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমি অনেক কিছু জানতে পারি। মোজাম্বিক থেকে এসেছিলেন একজন নারী, তার নামটা ভুলে গেছি, তিনি অত্যন্ত কর্মনিষ্ঠ মহিলা। তার নিজের প্রকাশনা সংস্থা ছিল এবং আফ্রিকার কোনো একটি বইয়ের সংগঠনের তিনি সভাপ্রধান ছিলেন।
ওয়াইএমসিএ’র গেষ্ট হাউসে আমরা একসঙ্গে ছিলাম। তার প্রকাশনা সংস্থা থেকে বেশ কয়েকটি বই কিনি। পরিচয় হয়েছিল দিল্লির ‘কালি ফর উইম্যান’-এর স্বত্তাধিকারী উর্বশী বুটালিয়ার সঙ্গে। তার সংস্থাটি সে সময়ে নারী বিষয়ে বই প্রকাশের জন্য বেশ নাম করেছিল। উর্বশী এখন জুবান (Zuban) নামে প্রকাশনা সংস্থা চালায়। প্রগতি ময়দান একটি বিশাল এলাকাজুড়ে, অনেক সময় এই মাথা থেকে ঐ মাথায় যেতে গাড়ি ব্যবহার করছিল মেলা কর্তৃপক্ষের লোকজন। অন্যথায় সাধারণের জন্য গাড়ি প্রবেশ নিষেধ। ব্যাংক, পোস্ট অফিস, টেলিফোন অফিস ইত্যাদিসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুই ছিল সে মেলা প্রাঙ্গণে। পরে শুনেছিলাম এই ময়দানটি বিভিন্ন ধরণের মেলা আয়োজন করার জন্য স্থায়ী জায়গা। প্রগতি ময়দানে গিয়ে পরিচিত হওয়ার অসংখ্য মানুষ এখনো আমার স্মৃতির এক গভীর সঞ্চয়। বইমেলা আমার জন্য দেশের সীমানা তুলে দিয়েছিল প্রত্যক্ষভাবে।
পরে যে বইমেলাটি আমাকে টেনেছে সেটি হলো ‘আগরতলা বইমেলা। ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত হয় অষ্টাদশ আগরতলা বইমেলা।
ঐ বইমেলায় উপস্থিত থাকার জন্য আমি নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম ত্রিপুরা সরকারের তথ্য, সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রী জীতেন্দ্র চৌধুরীর কাছ থেকে। বইমেলা আয়োজিত হয়েছিল ‘রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবন’ প্রাঙ্গণে। বইমেলার উদ্বোধক ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী কবি অনিল সরকার। বিশেষ অতিথি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গ্রন্থাগার মন্ত্রী নিমাই পাল এবং ত্রিপুরার প্রবীণ কথাসাহিত্যিক বিমল চৌধুরী। প্রদীপ জ্বালিয়ে বইমেলা উদ্বোধন করা হলে সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠে পুরো প্রাঙ্গণজুড়ে আলোর মালা। অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলা ও ককবরক ভাষায় রবীন্দ্রনাথ লিখিত জাতীয় সঙ্গীত পরিবশেন করে শিল্পীরা। আয়োজনটি ছোট ছিল কিন্তু প্রাণের আবেগে ভরপুর ছিল। স্থানীয় লেখকরা আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। তাদের আলোচনা থেকে ত্রিপুরা সাহিত্যের একটি ধারণা পাওয়া যায়। কয়েকদিন ত্রিপুরা থেকে তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে বইমেলার আবহকে আমার একটি ভিন্নমাত্রার অনুষঙ্গ মনে হয়েছিল। ছোট আয়োজনটি মাতিয়েছিল অনেক বেশি করে।
কলকাতার বইমেলায় আমি অনেকবার গিয়েছি। এই বইমেলাটিও আমার জন্য অনেক বড় একটা স্মৃতি হয়ে আছে। কারণ, মাতৃভাষায় লেখা বই কিন্তু অন্যদেশ ও সংস্কৃতির মানুষের কথা তাই এই বইমেলায় যেতে তাগিদ অনুভব করি। ১৯৯৯ সালে কলকাতা বইমেলার থিম ছিল ‘বাংলাদেশ’। আমাকেও একটি প্রবন্ধ পড়তে হয়েছিল। সেবার গড়ের মাঝে বইমেলা হয়েছিল।
এই মেলায় একটুখানি ধাক্কা খাই, কারণ প্রতিষ্ঠিত লেখকরা ভালো ব্যবহার করেননি। বাংলাদেশ থিম কান্ট্রি হলেও বাংলাদেশের লেখকদের আলোচনা অনুষ্ঠানের সময় তারা মেলায় উপস্থিত থেকেও আড্ডা দিয়েছেন অন্যত্র। মনে হয়েছিল, লেখকদের সঙ্গের দরকার নেই। বই কেনা হোক আনন্দের। লেখকদের উদাসীনতা দেখে ভেবেছিলাম এই বইয়ের প্রাচুর্য কিন্তু লেখকদের হৃদয় খোলা নয়। বই চাই, লেখকের উষ্ণতা চাই না এটা তো হয় না, যেটা আমি দিল্লি কিংবা আগরতলায় পাইনি।
দিল্লি এবং আগরতলায় যেসব লেখকের সঙ্গে দেখা হয়েছে তারা বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। সালটা মনে নেই, মনে আছে কোনো এক সময়ে ঢাকার ‘মুক্তধারা’র স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজের বইয়ের পসরা বসিয়েছিলেন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। ঘাসের উপর চট বিছিয়ে রেখে দেয়া বইগুলো ফুলের মতো ফুটেছিল।
পাঠক উবু হয়ে বসে বই দেখেছিলেন। মনে হচ্ছিল এ এক অন্য জগৎ। এই মেলাকে আস্তে আস্তে বড় হতে দেখেছি। স্টল তৈরি হতে দেখেছি। ছোট পরিসরে মেলার আয়োজন দেখেছি। এসব সত্তর দশকের কথা। মানুষের ভিড় কম ছিল। স্টলের সংখ্যা কম ছিল। ঘুরে ঘুরে বই দেখার আনন্দ ছিল বেশি। বই খুঁজতে ঠেলাঠেলি করতে হয়নি। অনায়াসে পেয়ে যেতাম নিজের পছন্দের বই।
আশির দশকে মেলার বড় পরিবর্তন হয়। ১৯৮৪ সালে বইমেলার আনুষ্ঠানিক নাম রাখ হয় ‘অমর একুশে বইমেলা।’ এ বছর একাডেমি প্রাঙ্গণের বিভিন্ন জায়গায় মাটি ফেলে ভরাট করে মেলার আয়তন বাড়ানো হয়। মাটি ফেলা হয় পুকুরের পশ্চিম পাড়ে। ভরাট করা হয় বর্ধমান ভবনের উত্তর ও ক্যাফেটেরিয়া ভবনের দক্ষিণ দিক। আশির দশকে এটি একটি দিক ছিল যে মেলার আয়তন বাড়ানো। আরেকটি দিক ছিল এই বছরে মেলার দিনও বাড়ানো হয় ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আগে একুশের বইমেলার সময় ছিল মাত্র কয়েকদিন। এ সময়ের বইমেলা উদ্বোধন করতেন দেশের বরণ্যে কেউ।
মেলার এমন পরিবেশে বিশ্বাস করতাম বইমেলা মানুষের সাংস্কৃতি চেতনাকে পরিশীলিত করে। তথ্য প্রযুক্তির এই সময়েও বলতে চাই বইয়ের বিকল্প নেই। বড় করে শ্বাস নিলে একুশের চেতনায় প্লাবিত হয়ে থাকা মেলা প্রাঙ্গণ জাতির ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ জায়গা।
নব্বইয়ের দশকে বইমেলা আরো বড় হয়। বইমেলা উদ্বোধন করতে আসেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। এখন পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। এই অনুষ্ঠান বিভিন্ন চ্যানেলে সরাসারি প্রচারের ব্যবস্থা করার ফলে দেশের দূর অঞ্চলের মানুষ দেখতে পাচ্ছে।
প্রতিদিন বইমেলার খবর প্রচারিত হয় দৈনিক পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক চ্যানেলে। এভাবে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের নানা কর্মকাণ্ড একুশের বইমেলাকে সম্প্রসারিত করেছে। ফলে সমস্যা দেখা দিয়েছে জায়গার। তাই প্রশ্ন উঠেছে বইমেলাকে অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়া যায় কিনা তা ভেবে দেখার জন্য। বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী ময়দানের বিশাল প্রাঙ্গণ জুড়ে বইমেলা আয়োজিত হয়।
আরও একটি বইমেলার কথা উল্লেখ করতে চাই। এই বইমেলার আয়োজন করেছিল আদিবাসী মান্দি জনগোষ্ঠী। বইমেলার স্লোগান ছিল ‘বই হোক মান্দিদের আত্মবিকাশের মন্ত্র।’ আত্মবিকাশের অর্থ অনেক বড়, আমি মনে করি বইমেলা দিয়ে শুধু বই কেনা বা পড়ার অভ্যাসটা গড়ে তোল নয়। এর অর্থ নিজের বিকাশকে পূর্ণাঙ্গ করা। ব্যক্তিমর্যাদাকে বিকশিত করা এবং জাতিগোষ্ঠীর মর্যাদাকে রাষ্ট্রীয় অধিকার আদায়ের মধ্য দিয়ে সমুন্নত করা। বই আত্মবিকাশের সহায়ক শক্তি। আজকের এই আলোকিত মুখের কাছে আমার দাবি, তারা তারুণ্যপ্রদীপ্ত হয়ে বইয়ের মাধ্যম নিজেদের যোগ্য করে তুলবে।
মান্দী ভাষার উদীয়মান তরুণ কবি মিঠুন রাকসাম যখন এই বইমেলার আয়োজন করে, এটি কোনো সামান্য ঘটনা নয়, এটি একটি শুভ, বি-শা-ল ঘটনা। আমরা যখন বলব যে আমাদের বৈচিত্র্য আছে, আমাদের জাতিসত্তার মধ্যে যে বৈচিত্র্য আছে, যাদের নিজেদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সারা বিশ্বের দরবারে যেতে পারবে, বলতে পারবে- এই আমি, এই আমার মান্দি জনগোষ্ঠী, এই আমি, এই আমার আইন, এই আমার ইতিহাস, এই আমার ঐতিহ্য, এই আমার গল্প, এই আমার কবিতা, এই আমার নাটক, এই আমার পাহাড়, মধুপুরের গড়, পর্বত-জঙ্গল সবকিছুর ভেতরে আমাদের অস্তিত্ব আছে। এই অস্তিত্বের যে ভবিষ্যৎ নিয়ে আজকের বইমেলার শুরু, উদ্বোধন তার ভেতর দিয়ে।
বই কোনো একটি কাগজের পাতা নয়, বই কোনো একটি দুই মলাটের কোনো কিছু নয়, বই একটি অসাধারণ শক্তি। আমি মনে করি, আজকের প্রযুক্তির দিনে, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, ইমেইল, মোবাইল, সবকিছুর পরও বই আমাদের সেই শক্তি, যে শক্তির ভেতর দিয়ে আমরা আমাদের নিজেদের আবিষ্কার করতে পারি। প্রতিটি লেখা প্রতিটি অক্ষর আমাদের জীবন হয়ে থাকবে।
ইদানিং বাংলাদেশের প্রকাশকরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বইমেলার আয়োজন করে। তাদের লক্ষ্য ছেলেমেয়েদের হাতের নাগালে বই পৌঁছে দেয়া। একবার ছায়ানট ভবনের নালন্দা স্কুলে আয়োজিত হয়েছিল বইমেলা। আমি আমন্ত্রিত অতিথি ছিলাম। দেখলাম ছেলেমেয়েরা বই কিনছে। ষষ্ঠ শ্রেণির একটি মেয়ে আমার ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি এনে আমাকে বলল, ‘আপনার এই বইটি আমাকে দিতে হবে। আমার কাছে যে টাকা ছিল তা শেষ হয়ে গেছে।’ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বই আর বইমেলার বিষয়টি গভীর ভালোবাসায় দেখতে পাই। আমি ওর মাথায় হাত রেখে বলি, ‘মাগো তোমার যে বই ভালোলাগে তা নাও। টাকার কথা ভাবতে হবে না।’ একটি বইয়ের জন্য ও দাবী জানিয়েছে, আবদার করেনি। বইমেলার সার্থকতা এখানে।
এমন অনেক ছোট ছোট বইমেলার নানা অভিজ্ঞতা আমার আছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে গিয়েছিলাম হুগলির কোন্নগরের নবগ্রাম হীরালাল পাল কলেজে। অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল কলেজের বাংলা বিভাগ। হুগলি শহরে অনেক ছোটবড় বইমেলা দেখে প্রাণমাতানো আনন্দ নিয়ে দেশে ফিরে আসি। বারবারই ভাবি এভাবে বইমেলা মানবজীবনের প্রগতির ধারাকে অক্ষুণ রাখবে। জনজীবনের অধিকারের লড়াইয়ে প্রেরণা দেবে।
জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা রক্ষার সহায়ক শক্তি হবে। যত ছোট আকারের হোক না কেন কোনো জনগোষ্ঠীর ভাষা বিলুপ্ত হবে না। বইমেলা ধারণ করবে মানবজাতির সৃজনশীল মেধা। বিকশিত হবে জ্ঞান। চর্চিত হবে শুভ ও কল্যানের বোধ।
২০১৯ সালের ৫ জানুয়ারি খড়গপুর বইমেলায় আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় অনুষ্ঠিত এই মেলা আমার সামনে আর এক দিগন্ত। লেখক-পাঠকের মিলনমেলায় স্নাত হই। নিজের বইয়ের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় পাঠককে।
আমরা সবাই জানি বইয়ের সীমান্ত নেই। সীমান্ত ছাড়িয়ে বই পৌঁছে যায় মানুষের কাছে। এশিয়ার মানুষ হয়ে জানতে পারি আফ্রিকার সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের রূপরেখা। জানতে পারি ইউরোপ-আমেরিকা-ল্যাটিন আমেরিকার জীবন। বই মানবজাতির অক্ষয় সাধনা।

No comments

Powered by Blogger.