বাজার ও মাজার: মুলতানে একদিন by টিম ব্লাইট

মুলতানের কথা মনে পড়লেই আমার মনে স্বপ্নময় নানা ছবি ভেসে ওঠে। ২০০৬ সালে আমি যখন প্রথম পাকিস্তানে যাই, তখন লাহোর নয়, এমনকি গিলগিট-বাল্টিস্তানও নয়, বরং এই মুলতান সফরেই সবচেয়ে বেশি রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।
ওই সময় যে কারণে আমি পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলাম, সেটা ব্যাখ্যা করা উচিত। আমি মধ্যপ্রাচ্য এলাকা সফর করছিলাম, ঐতিহ্য, বিশ্বাস আর দর্শনের বিস্তৃতের বিশেষভাবে মুগ্ধ হয়েছিলাম।
ইরানে গিয়ে আমি আধ্যাত্মিক প্রচারকদের সম্পর্কে জানতে পারি। তারা মধ্যযুগের ওই সময়টাতে পূর্ব দিকে পাড়ি জমিয়েছিরেন।
পাশ্চাত্য দুনিয়া ওই সময় ছিল সবচেয়ে খারাপ অবস্থায়। এ কারণে পরবর্তীকালে তা অন্ধকার যুগ নামে পরিচিত হয়। তবে মুসলিমরা তখন তত্ত্ব ও চিন্তাধারায় বিকশিত হচ্ছিল।
হারাম গেট, মুলতান
পারস্য থেকে অনেক সুফি সাধক বের হয়েছিলেন। তাদের অনেকেরই গন্তব্য ছিল মুলতান।
আমি জানতাম, আধুনিক মুলতান বিশাল বিশাল প্রতিষ্ঠান সাজানো থাকবে না। মনে রাখতে হবে, সাম্প্রতিক ইতিহাস তো মুসলিমবিশ্বের প্রতি তেমন সদয় নয়। ওই সব পতিষ্ঠানের টানেই একসময় বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, শাহ রুকন-ই-আলম, সৈয়দ জালালুদ্দিন বুখারি, লাল শাহবাজ কালান্দার আর বাবা ফরিদউদ্দিন গঞ্জশকর এখানে এসেছিলেন।
মুসাফিরখানার অভ্যন্তরভাগ
অবশ্য চলতি বছরের প্রথম দিকের আগে আমি যথাযথভাবে মুলতানকে দেখতে পারিনি। অসুস্থতা আর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কারণে প্রথম দুটি সফরে আমার লক্ষ্য হাসিল হয়নি।
তবে এবার আমি জানতাম, নগরীটি হবে আমার। আমাকে টেনেছিল দরবেশ আর তাদের মাজারগুলো, অনেক বন্ধুও ছিল পথজুড়ে।
আমরা যেদিন মুলতানের সন্ধানে বের হয়েছিলাম, সেদিন ছিল গরম, অবশ্য মুলতানের অন্য সব দিনের মতোই। আমরা শুরু করলাম হারাম গেট দিয়ে। সম্ভবত ১৬ শতকের ইটের তৈরি একটি কাঠামো এটি।
শাহ রুকুন ই আলমের মাজার
নাম দিয়ে বোঝা যায়, একসময় এখানে ছিল নারী নিবাস। নগরীর অন্যান্য স্থাপত্যের মতো, এটিও সময়ের পরিক্রমায় পুনঃনির্মিত হয়েছে। ইতিহাসে অনেকবারই মুলতান অবরোধের মুখে পড়েছে। ফলে অনেক দুঃসময় তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে। অতি সম্প্রতি ইতালির বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে হারাম গেটটির সংস্কার করা হয়েছে।
এই গেট দিয়েই আমরা প্রাচীর নগরী মুলতানে প্রবেশ করি।
মুলতানের পুরনো শহরের সড়কের দৃশ্য
আমরা আমাদের ডান দিকে একটি ছোট মাজার অতিক্রম করি। দেখতে পেলাম, একজন গেটকিপার কবুতরের ঝাঁককে খাবার দিচ্ছে। বিশ্বজুড়েই আধ্যাত্মিক স্থাপনাগুলো কবুতরকে আকৃষ্ট করে। মুলতান আসলে কবুতরে পরিপূর্ণ। মাজারটির সবুজ গম্বুজটি এখানে কবুতরের সংখ্যার প্রমাণ দিচ্ছে।
সাখি ইয়াহিয়া নওয়াবের সমাধি
দরবেশদের নগরী হিসেবে মুলতান আগেই নাম কুড়িয়েছে। আমাদের চোখের সামনে দিয়েই নারী-পুরুষ মাজারে প্রবেশ করছে, বের হচ্ছে। অনেকে পাপড়ি উপহার দিচ্ছে, কেউ কেউ মোমবাতি দিচ্ছে।
তখন সবে বিকাল শুরু হয়েছে। আমরা যে মাজারটির সামনে ছিলাম, সেটি হলো ১৬ শতকের বিখ্যাত সুফি সাধক মুসা পাক শাহিদের ছেলে সাখি ইয়াহিয়া নওয়াবের মাজার।
মুসা পাক শহীদের সমাধি
বর্ণাঢ্য ইটের কাঠামোটি হঠাৎ করেই চোখের সামনে চলে এলো। চার দিকে পোস্টারের ছাওয়া ভবনরাজির মধ্যে সবুজের পরশ এনে দিয়েছে মাজারটি। আমরা একেবারে মাজারের দরজার সামনে পড়ে গেলাম। মাজারের গেটে তিন ব্যক্তি দাঁড়ানো। আমি তাদের কাছে ছবি তোলার অনুমতি চাওয়ার আগে মনে হচ্ছিল তারা তাদের নিজেদের জগতে হারিয়ে গেছে।
চক বাজার
আর ভেতরে এক লোক নম্রভাবে মেঝেতে বসে আছেন। তার পুরো মনোযোগ পবিত্র কোরআন তেলায়াতের দিকে।
আরো কাছে, মুসা পাক শহিদের মাজারের নিকটে আমরা একটি পুরনো মুসাফির খানার অস্তিত্ব দেখতে পেলাম। সম্প্রতি সংস্কার করে এই পুরনো উজ্জ্বলতা কিছুটা ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
জৈন মন্দিরের অভ্যন্তরভাগ
এরপর আমাদের গন্তব্য হলো চকবাজার। পথেই পড়ল একটি জৈন মন্দির। আমি তাতে সাড়া না দিয়ে পারলাম না। একসময় যে এটি অত্যন্ত মনোরম স্থাপনা ছিল, তার রেশ এখনো এতে রয়ে গেছে।
বাজারের পথেই পড়ে দুটি বিখ্যাত মাজার। একটি রুকন-ই-আলমের, অপরটি বাহাউদ্দিন জাকারিয়ার।
মুলতানের কেন্দ্রস্থলে সূর্যাস্তের দৃশ্য
রিকসায় সামান্য পথ অতিক্রম করে আমরা পশ্চিম দিকে পাহাড়ের কাছে এগুলাম। এখান থেকেই শাহ রুকন-ই-আলমের মাজারের গম্বুজ প্রথমে চোখে পড়ল। এখানেও কবুতরের ঝাক দেখা গেল। গোলাকার স্থাপনায় মাজারটি বিশেষ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। আর বাহাউদ্দিন জাকারিয়ার মাজারটি অন্যসবের মতো, তবে আকর্ষণশক্তি কিন্তু কম নয়।
বাহাউদ্দিন জাকারিয়ার সমাধি
এখানে শাহ রুকন-ই-আলমের দাদা ঘুমিয়ে আছেন। তিনি হলেন মুলতানের আদি সুফি দরবেশদের অন্যতম।
ঐতিহাসিক স্থাপত্যের প্রতি যাদের আগ্রহ আছে, তাদের কাছে এর গুরুত্ব বিপুল। এর আলোকেই পরবর্তীকালের মাজারগুলোর নক্সা হয়েছে। এর ছোঁয়া অন্য সব স্থাপনায় দেখা যায়।
সাখি ইয়াহিয়া নওয়াবের সমাধি
সূর্য তখন অস্ত যেতে বসেছে। আমি তখন মাজারের সাদা গম্বুজের পেছনে একটি স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেছি।
একটু পরই শুরু হলো মাগরিবের আজান। কিছু সময় পরই শোনা গেল কাওয়ালি। এক দল লোক সমাধির কাছে বসে সুর তুলছে। আর আমি যেজন্য এসেছিলাম, তা পেয়ে গেলাম।
(সব ছবি লেখকের তোলা)

No comments

Powered by Blogger.