সঙ্ঘাত আর সহিংসতার আতঙ্কের দিকে চোখ ফেরানো by মেহর এফ হোসাইন

বিষয়টি বেশ ভয়াল। আরেকটি নৃশংসতার খবর পাওয়া গেল এবং এরপর ক্রোধ, ক্ষোভ, নিন্দা ইত্যাদি ইত্যাদিও দেখা গেল বিশ্বজুড়ে। তারপর বিশ্ব চলল বিশ্বের গতিতে। মানুষের প্রাণহানি স্রেফ সংখ্যায় নেমে এসেছে, নৃশংস ঘটনাগুলো স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়ে গেছে, তারপর সবই বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছে।
সবকিছুই বদলে গেছে ২০১৫ সালে।
ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর রাতের পর্দা সবেমাত্র কেটে গেছে। এজিয়ান সাগরে বেলাভূমিতে একটি শিশু চুপচাপ, নিশ্চুপ ঘুমিয়ে আছে। শিশুটি আর কোনো দিন জাগবে না, তবে বিশ্বের বিবেককে বেশ ভালোভাবেই নাড়া দিয়ে গেছে।
তিন বছর বয়সের সিরিয়ান উদ্বাস্তু অ্যালান কুর্দি নিরাপত্তা, শান্তি আর স্থিতিশীলতার আশায় নতুন দেশে পাড়ি দিচ্ছিল। তার মা-বাবাই তার মনে ওই আশার আলো সঞ্চার করেছিল। অবশ্য সে তুলনামূলক নিরাপদ উপকূলে পৌঁছাতে পেরেছিল, তবে জীবিত নয়, মৃত। তার মৃত্যু আরো অনেক হতাহতের চেয়ে বেশি কিছু ছিল। সে কেবল একটি সংখ্যাই ছিল যেটা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে।
নেভি ব্লু শর্ট আর লাল টি-শার্ট পরা কুর্দি আফগান-বংশোদ্ভূত আমেরিকান উপন্যাসিক খালেদ হোসাইনিকে উদ্দীপ্ত করেছে। তার নতুন উপন্যাস সি প্রেয়ারে কুর্দিকে তিনি অমরত্ব দান করেছেন। ব্রিটিশ ইলাস্ট্রেটর ড্যান উইলিয়ামসের ইলাস্ট্রেটেডের বইটি সাধারণ কোনো গ্রন্থ নয়।
লেবাননের পূর্বাঞ্চলে মার্জ শহরে একটি অস্থায়ী উদ্বাস্তু শিবিরের তাবু থেকে উঁকি দিচ্ছে এক সিরীয় উদ্বাস্তু শিশু, ছবি: এপি
সঙ্ঘাত আর সহিংসতার আতঙ্ক প্রায়ই বিজয়ের ভাষ্যে, ক্ষতির বর্ণনায় এবং অনেক সময় জীবনহানি ও বিলুপ্তির শ্রেণিবিভাগে ধরা পড়ে। যুদ্ধের ইতিহাস অন্যান্য আকারেও তুলে ধরা হয়ে থাকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি। এটি হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি অধিকৃত নেদারল্যান্ডসের তার ইহুদি পরিবারের জীবনলিপি।
ইরানি বংশোদ্ভূত ফরাসি শিল্পী ও গ্রন্থকার মারজানি স্যাট্রাপি একই কাজ করেছেন পারসেপোলিস এক ও দুই নামের গ্রাফিক উপন্যাসে। তিনি ইসলামি বিপ্লবের পর প্রতিবেশী ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইরানে কিশোরদের বসবাসের বিপদ নিয়ে লিখেছেন।
মাল্টায় জন্মগ্রহণ করা আমেরিকান কার্টুনিস্ট জো স্যাক্কো ফিলিস্তিনের সঙ্ঘাতের শিকারদের নিয়েও একই কাজ করেছেন। তিনি সহিংসতা, বাস্তুচ্যূতি ও মৃত্যুর ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন।
তবে কুর্দির দুর্ভাগ্য সে তার কাহিনী তুলে ধরার মতো অবস্থায় পৌঁছাতে পারেনি। তবে তার কথাই তুলে ধরার দায়িত্বটি নিয়েছেন হোসাইনি।
তিনি তথ্য সংগ্রহ করেছেন তার বাবার কথা থেকে। সি প্রেয়ার বাড়ি, পরিবার ও ভালোবাসার কথা-চিত্র তুলে ধরে মনছোঁয়ায়। বইটিতে সিরিয়ান নগরী হোমসে এ পল্লী গ্রামের ছবি বেশ অবলীলায় তুলে ধরা হয়েছে। বইটি পড়তে পড়তে সিরিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামের খামার বাড়িতে আনায়াসেই ঢুঁ মেরে আসা যাবে। হোমস নগরীকে প্রাণবন্ত একটি স্থান হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। চমৎকার একটি স্থান হিসেবেই চোখের সামনে ভাসছে সবকিছু।
তবে যুদ্ধের ভয়াবহ তিনি তুলে বেশ নির্মমভাবে। বোমা, ক্রোধ, ক্ষুধা, মৃত্যু ইত্যাদি ভয়াবহ খারাপ বিষয়গুলো সামনে চলে এসেছে। এখনো যারা জীবিত আছে, তারা কিন্তু এই নৃশংসতা কখনো ভুলে থাকতে পারবে না।
তবে এই বর্ণনা তুলে ধরাটাই কি যথেষ্ট?
মর্যাদা আর শান্তি কেড়ে নেয়া হলে মানুষ নীরব হয়ে যায়। ফলে হোসাইনির এই বর্ণনা পাঠ করাও হৃদয়বিদারক।
ভয়ঙ্কর কথা হলো, যুদ্ধ আর সহিংসতার তাণ্ডব থেকে মানুষ ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। কিন্তু তাদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আত্মরক্ষার জন্য ছুটতে গিয়ে আমরা বুঝতে পারছি, আমরা আমন্ত্রিত নই, আমরা অনাকাঙ্ক্ষিত।
সিরিয়ার দেই এজ-জর শহরে ভবনের ধ্বংসস্তুপের মাঝ দিয়ে হেটে যাচ্ছে এক শিশু, ছবি: রয়টার্স
এই বিপর্যয়কর সময়ে আমার সন্তান যখন নিথর দেহে উপকূলে পড়ে থাকে, বাবা হিসেবে আমি কী করতে পারি? প্রার্থনা করা ছাড়া কি আমার আর কিছু করার আছে।?
আছে। তা হলো যেসব শক্তিশালী লোক মনে করে, তারা নিয়তি গড়ার ক্ষমতা রাখে, তাদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়া। এটি তাদের জন্য যেমন কল্যাণকর, পুরো বিশ্বের জন্যই কল্যাণকর। এজিয়ান সাগরের উপকূলে যে শিশুটির নিথর দেহ ভেসে এসেছে, সে কিন্তু মানুষের নির্দয়তার কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। যারা যুদ্ধ ছড়াচ্ছে, তাদেরই যুদ্ধের আগুনে পুড়ে মরার কথা। সবচেয়ে নাজুক শিশুটি কেন সবসময় সবচেয়ে বেশি নির্মমতার শিকার হবে?

No comments

Powered by Blogger.