মৃণাল সেন সম্পর্কে নন্দিতা দাস: ‘আমার বন্ধু, দার্শনিক ও পথ প্রদর্শক’ by নন্দিতা দাস

মৃণাল সেনের সঙ্গে নন্দিতা দাস
মৃণাল দা’র মৃত্যু নিয়ে আমাকে কিছু লিখতে হবে তা আমি ভাবতেই পারছি না। গত নভেম্বরে যখন দেখা হলো তখন তাকে বেশ দুর্বল মনে হলো। আমি জানতাম এই মেধাবী শিল্পী আমাদের ছেড়ে শিগগিরই চলে যাচ্ছেন। এমন একটি দিন আসবে জানা থাকলেও কেউ এর জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে না। আমার প্রতিক্রিয়া জানতে টেলিফোন করা এক সাংবাদিকের কাছ থেকে আমি প্রথম খবরটি জানতে পারি। আমি শোকে স্তব্ধ হয়ে যাই। ২০ বছরের সম্পর্কটিকে মাত্র একটি বাক্যে বলে ফেলা কি কারো পক্ষে সম্ভব? এমন মুহূর্তে আমাকে বিরক্ত করার জন্য এক সাংবাদিক আন্তরিক ক্ষমাও চেয়েছেন। একজনতো বললেন যে রোববার বন্ধের দিন হওয়ার পরও এই ‘ব্রেকিং নিউজের’ জন্য তাকে কাজ করতে হচ্ছে! ঘনিষ্ঠ কারো মৃত্যু যখন ‘সংবাদ চক্রে’র অংশ হয়ে যায় তখন বুঝা যায় আমাদের জীবনযাত্রাটি কতটা নি:সঙ্গ হয়ে পড়েছে।
আমি কলকাতায় গিয়েছি আর মৃণালদার সঙ্গে দেখা হয়নি এমনটি কখনো হয়নি। সেখানে অনেকে ছিলো, সবাইকে আমি স্নেহ করি। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগদানের উদ্দেশ্যে ছেলেকে নিয়ে কলকাতা যাওয়ার পর ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়। তাকে বেশ দুর্বল মনে হচ্ছিল। কিন্তু আমি যতক্ষণ ছিলাম উনি আমার হাতটিকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন। দীর্ঘসময় মমতাপূর্ণ নিরবতা বিরাজ করছিলো। মাঝে মধ্যে সেই নীরবতা ভাঙ্গছিলো আমাদের টুকটাক কথায়। তিনি আমার ছবি মান্টো নিয়ে কথা বললেন, সন্তানের স্কুল সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আরো তাচ্ছিল্যের সঙ্গে এই বলে আক্ষেপ করেন যে চলচ্চিত্র উৎসবে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। যদিও তিনি জানতেন যে আমন্ত্রণ পেলেও তার যাওয়া হতো না, কিন্তু এই অসম্মান তাকে বেশ কষ্ট দিয়েছে।
ছবি: নন্দিতা দাস
বিদায়ের আগে আমরা কিছু ছবি তুলি। এটাই আমাদের শেষ দেখা হবে সেটা কি জানতাম? কাউকে শেষ বিদায় জানানো সবসময়ই বেদনার। কিন্তু তাকে নীরবতার মধ্যে বিবর্ণ হয়ে যেতে দেখা আরো বিষণ্নের। অনেক কথা, অনেক আইডিয়া, এমনকি অনেক বেশি কর্মতৎপর মানুষটি এখন তার ডাইনিং টেবিলে নি:সঙ্গ বসে আছে।
আমি ২০ বছরের বেশি সময় ধরে মৃণালদাকে চিনি। কাঠখোট্টা ধরনের মনে হওয়া অত্যন্ত সৎ মানুষটির কিন্তু কৌতুকরসের অভাব ছিলো না। তার স্ত্রী গীতাদী সবসময় পাশে থেকে তাকে শক্তি জুগিয়েছেন। তাদের সঙ্গে অনেক সন্ধ্যা কেটেছে তাদের গল্প শুনে। অনেক সময় তাদেরকে আত্মবিনয়ী দেখেছি। তখন দিদির দৃষ্টিটি বেশি ভালো মনে হতো। দিদি হেসে দিয়ে মৃণালদার চাটুকারিপূর্ণ গল্প বাতিল করে দিয়ে পাল্টা গল্প শোনাতেন। তাদের হাস্য-পরিহাস, নি:শর্ত ভালোবাসা এবং পারস্পরিক সম্মান সত্যিকারের ভালোবাসার প্রতি আমার বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করেছে। দিনের পর দিন আমাদের শোয়ার ঘরের আলাপচারিতা খাবারের টেবিল পর্যন্ত গড়িয়েছে। তাদের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে সেই আলাপচারিতার তাদের বিছানায় পর্যন্ত পৌছে যায়। দুই বছর আগে গীতাদি আমাদের ছেড়ে গেলে মৃণালদা তার আসল সত্তাটি হারিয়ে ফেলেন।
আমার ভূবন ছবি সেটে, ছবি: নন্দিতা দাস
পরিচয়ের পর থেকেই মৃণালদা আমাকে বলতেন যে আমাকে নিয়ে তিনি ছবি বানাবেন। ২০০২ সালের কথা, সেটা ছিলো তার শেষ ছবি – আমার ভূবন। বাংলার একটি গ্রাম্য মুসলিম পরিবারের কাহিনী। এটা ছিলো ত্রিভুজ প্রেম। আমি সখিনার চরিত্রে অভিনয় করি। আমার দুই ভাই ছিলো। তাদের সঙ্গে কোন মনোমালিন্য ছিলো না। সংঘাতটি চাপা ছিলো কিন্তু সমাধানটি আমাদের আসল মূল্যবোধটিকেই চ্যালেঞ্জ করে বসে। শুটিংয়ের দিন পনের আগে মৃণালদা ফোন করে বলে কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কারণ বিনিয়োগকারীরা কোন মুসলিম পরিবারকে নিয়ে বানানোর ছবির পেছনে টাকা ঢালতে রাজি নয়! অবিশ্বাস্য মনে হলো। এটা গুজরাট রায়টের কিছু দিনের পরের ঘটনা। সাম্প্রদায়িক অশান্তি ও পক্ষপাতিত্বের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আমি তাকে বললাম যে মুসলিম কাহিনী আসলে প্রকল্প বাতিলের কোন কারণ নয়। এরপর তিনি যখন বললেন, ঠিক আছে আমার কাছে অল্প যে কিছু টাকা আছে তাই দিয়ে ছবি বানাবো, তবে তোমার ফি এখন দিতে পারবো না’, তখন আমি অবাক হইনি।
এরপর আমরা চব্বিশ পরগনা জেলার টাকি নামে একটি গ্রামে যাই। মনি রত্নমের তামিল ছবি কান্নাথিল মুথামিত্তাল-এর শুটিং শেষ করে আমাকে আমার ভূবন ছবির শুটিয়ের জন্য যেতে হয়েছিলো। একটি ‘ধর্মীয় ছবি’ করার জন্য আমি এমন জায়গায় গিয়েছি যেখানে কখনো যাইনি। আমি নানা ধরনের খাবার খেয়েছি, বহুরকম মানুষের সঙ্গে মিশেছি। কিন্তু এই দুই পরিচালকের মধ্যে ছিলো দুস্তর ব্যবধান। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত টানা একঘেয়ে শুটিং থেকে আমি অনেক বেশী নমনীয় শিডিউলে কাজ করতে যাই। গিয়ে দেখি গোটা গ্রামটিই যেন ছবির কাজে নেমে পড়েছে। মৃণালদা, আমরা নায়ক-নায়িকা ও ক্ররা মিলে পাঁচজন একটা গেস্ট হাউজে থাকতাম। এর সামনে দিয়ে ইছামতি নদী বইছিলো। এর ওপারে বাংলাদেশ। মৃণালদা বলতে বাংলাদেশে সূর্য ওঠে, আর ভারতে এসে ডোবে। বাংলাদেশকে নিয়ে তার আলদা টান ছিলো। তিনি ফরিদপুরে জন্মেছিলেন, যা আজ নদীর ওপারে।
আমার ভূবন, ছবি: নন্দিতা দাস
সেটের ভেতর-বাইরে মৃণালদা তার জীবনের অনেক গল্প আমাদের বলতেন। তিনি বলতেন সৌমিত্র চ্যাটার্জি ও শাবানা আজমির মতো অভিনেতাদের সঙ্গে সময় কাটানোর কথা, জিয়ান-লুক গোদার্দ ও সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকদের কথা। সবকিছুর জন্যই তার দরদ ছিলো। এমনকি রাতে আমরা যে মাছ খেতাম তার জন্যও। তিনি সবসময় খোলামনে কথা বলতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে তার ছবিটি দর্শকরা গ্রহণ করবে। তারা সেটা গ্রহণও করেছে। এমন এমন হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যে ছিলেন যারা শিল্প ও শিল্পীকে আলাদা করতেন না।
কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য আমার ভূবন মনোনীন হয়। ছবিটি স্বল্প পরিসরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেয়া হয়। এরপর আমরা পুরষ্কার গ্রহণের জন্য কায়রো চলচ্চিত্র উৎসবে একসাথে যাই। আমি অভিনয়ের জন্য আর মৃণালদাকে আজীবন সম্মাননা দেয়া হয়। সেবারই সম্ভবত শেষবার ছবিটি বড় পর্দায় দেখানো হয়েছিলো। ছবিটি কয়েকবার টিভিতেও দেখানো হয় কিন্তু এর থিয়েটার প্রিন্টের কোন হদিস এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। তখন থেকে আমি এটি খুঁজছি। আমাদের মহান শিক্ষকদের প্রতি আমরা কতটা শ্রদ্ধাহীন, খুবই মর্মান্তিক একটি বিষয়।
তিনি জীবনে যেমন সাধারণ ছিলেন, মরনেও। তিনি খুব বেশি প্রচার চাইতেন না। তার মাপেক চিত্র নির্মাতাকে এখন গান-স্যালুট দেয়া হয়, পুষ্পস্তবক অর্পনের জন্য ভক্তদের ভীড় জমে যায়। তিনি এর কিছুই চাননি। তাকে যার ভালোবাসে তারা তার ইচ্ছাকে সম্মান করেছে। মৃণালদার শেষযাত্রায় মানুষের ঢল নামে। তারা নি:শব্দ পদযাত্রায় অংশ নেয়। সাধারণ মানুষের মতোই বিদায় নিতে চেয়েছিলেন তিনি।
আমার ভূবন ছবি সেটে, ছবি: নন্দিতা দাস
আমি যখন তার বাড়িতে যাই, সেখানে গীতাদিকে না দেখে বিসন্ন হয়েছিলাম। গিয়েছিলাম শুধু তাকে নয়, তার ছেলে কুনাল সেনকে দেখার জন্যও। সেও তার পিতার সততা ও মায়ের শক্তি পেয়েছে। কুনালদা তাকে বন্ধু ডাকতো এবং সেও অনেকের বন্ধু ছিলো। তবে সবার নয়। ভণ্ড ও মুনাফিকদের সে একদম দেখতে পারতো না মৃণালদা।
সে ছিলো আমার বন্ধু, দার্শনিক ও পথ প্রদর্শক। তার প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানানো হবে কঠিন প্রশ্নগুলো করে যাওয়ার মাধ্যমে। আমাদের বিবেকের ডাকে সারা দিতে হবে, সাধারণ মানুষের কাহিনী ‍তুলে ধরতে হবে, যারা ক্রমেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
আমার এক ছবি দেখে তিনি বলেছিলেন, তুমি অসাধারণভাবে সাধারণ। কেরালায় যখন থাকো তখন মালয়ী। আর বাংলায় থাকলে বাঙ্গালী। আমি সেরকমই সাধারণ থাকতে চাই।
মৃণালদার সঙ্গে একটি যুগের একটি বিদায় নিয়েছে। তার সঙ্গে আমার ঘনঘন সাক্ষাত না হলেও সান্তনা ছিলো যে তার মতো কেউ আছে আমার। স্বার্থপরের মতো বলতে হয়, আমি যদি চিরকাল তার সঙ্গে থাকতে পারতাম। কিন্তু তার মতো একটি মানুষকে দিনে দিনে নিস্প্রভ হয়ে যেতে দেখা কঠিন হতো। আজ সময় এসে তাকে ও তার কাজগুলোকে সম্মান জানানোর সময় এসেছে। তিনি জীবনে  অনেক যুদ্ধ করেছেন, অনেক গল্প বলেছেন এবং আমাদের অনেককে অনেক কিছু দিয়েছেন। এখন শান্তিতে থাকুন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.