ইয়েমেন যুদ্ধের চার বছরে যেখানে সৌদি ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী

দরিদ্র দেশ ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের আগ্রাসন চার বছর শেষ হয়ে পঞ্চম বছরে গড়িয়েছে। ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সুইডেনের স্টকহোমে অর্জিত সমঝোতাসহ বেশ কয়েক দফা শান্তি আলোচনা সত্বেও যুদ্ধ এখনো অব্যাহত রয়েছে।
ইয়েমেনের অসহায় জনগণ প্রতিনিয়ত সৌদি নিষিদ্ধ অস্ত্রের আঘাতে প্রাণ হারাচ্ছেন। কিন্তু ইয়েমেনের জনগণ পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলায় সৌদি আরব আজ পর্যন্ত তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।
সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট আমেরিকার সমর্থন নিয়ে ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। সৌদি আরবের সমর্থনপুষ্ট আব্দুল হাদিকে ফের ক্ষমতায় বসানোই যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য যদিও এখন পর্যন্ত তারা সফল হয়নি। কিন্তু গত চার বছর ধরে ইয়েমেনে ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সৌদি আরব সেখানে ব্যাপক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসনের পেছনে আমেরিকা, ব্রিটেন ও দখলদার ইসরাইলের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এবং রিয়াদ কেবল ওয়াশিংটনের লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের প্রতি আমেরিকার ব্যাপক সমর্থন থাকলেও ইয়েমেনের জনগণ পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং সৌদি আরব ও তার সমর্থকদেরকে অচলাবস্থার সম্মুখীন করেছে। ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ আন্দোলনের মহাসচিব আব্দুল মালেক আল হুথি যুদ্ধের চার বছর পূর্তিতে গত ২৫ মার্চ বলেছেন, সৌদি আরবের পেছনে আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইসরাইলের সমর্থন রয়েছে এবং সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত পাশ্চাত্যের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।
বৃহৎ শক্তিগুলোর সমর্থন নিয়ে সৌদি আরব ভয়াবহ বিপর্যয় ও ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেও ইয়েমেনের জনগণ এখনো সফলতার সঙ্গে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। চার বছর ধরে চলা অসম এ যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সত্বেও আনসারুল্লাহ আন্দোলন ও প্রতিরোধকামী জনগণ এখনো বিজয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছে এবং তাদের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে। ইয়েমেনিরা যুদ্ধের ময়দানে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রমাণ করেছে তারা যুদ্ধ চায় না কিন্তু শত্রুর যেকোনো ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসনের ব্যাপারে তারা সতর্ক। বিভিন্ন শান্তি আলোচনায় অংশ নেয়া থেকে যুদ্ধ অবসান ও শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আনসারুল্লাহ আন্দোলনের আগ্রহের প্রমাণ পাওয়া যায়। গত চার বছরের ঘটনাবলীতে প্রমাণিত হয়েছে সামরিক সংঘাতের মাধ্যমে ইয়েমেন সংকটের অবসান ঘটবে না। চার বছরের যুদ্ধে সৌদি আরবের একমাত্র সাফল্য হচ্ছে, তারা ইয়েমেনের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস করেছে, ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, কলেরার মতো মহামারি রোগের বিস্তার ঘটিয়েছে এবং প্রতিদিন নিরীহ মানুষ বিশেষ করে নারী ও শিশু হত্যা করেছে।
স্টকহোম শান্তি চুক্তি মেনে নিয়ে আনসারুল্লাহ আন্দোলন পশ্চিমাঞ্চলীয় কৌশলগত হুদাইদা শহর নিয়ন্ত্রণের ভার জাতিসংঘের তত্বাবধানে স্থানীয় বাহিনীর হাতে ছেড়ে দিতে সম্মত হয় যাতে রাজনৈতিক উপায়ে ইয়েমেন সংকটের অবসান ঘটে।
এমনকি স্টকহোম সমঝোতা অনুযায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য সানা ও রিয়াদ থেকে হুদায়দা শহরে প্রতিনিধি পাঠানোর কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের বাধার কারণে শেষ পর্যন্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। হুদায়দা শহরে যুদ্ধবিরতি শুরুর একই সময়ে সৌদি আরব ইয়েমেনের বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে। প্রমাণ করে তারা আসলে যুদ্ধের অবসান চায় না বরং ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। ইয়েমেনের রাজনৈতিক উচ্চ পরিষদের প্রধান মাহদি আল মাশাত বলেছেন, সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট যদি শান্তির সব পথ বন্ধ করে দেয় তাহলে তাদের জন্য কঠিন দিন অপেক্ষা করছে। তিনি বলেন, "সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে আরো ভয়াবহ কঠিন পন্থা ব্যবহারের ক্ষমতা রাখে ইয়েমেনিরা  যা তারা এখনো ব্যবহার করেনি। তাই এখনো শান্তির সুযোগ রয়েছে।"  তিনি বলেন, আমেরিকা, ব্রিটেন ও সৌদি আরব ইয়েমেনকে খণ্ড-বিখণ্ড করার জন্য যুদ্ধ জিইয়ে রেখেছে এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে।
আন্তর্জাতিক সমাজের নীরবতার সুযোগে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ায় কেবল ইয়েমেনের জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং তারা মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে গত চার বছরের যুদ্ধে দরিদ্র এ দেশটিতে সব ক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয় শুরু হয়েছে। গত ২৫ মার্চ ইয়েমেনের শিক্ষামন্ত্রী ইয়াহিয়া আল হুথি বলেছেন, সৌদি আগ্রাসনে ২২টি প্রদেশের তিন হাজার ৫২৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে এবং আরো ৬৬০টি ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও দেশটির স্বাস্থ্যখাতেও নেমে এসেছে মারাত্মক বিপর্যয়। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের ত্রাণ বিষয়ক সমন্বয়কারী দফতর থেকে বলা হয়েছে, চলতি বছরের শুরু থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সময়ে সারা ইয়েমেনে কলেরাসহ অন্যান্য সন্দেহজনক রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। গত কয়েক বছরে দুইবার কলেরা রোগের বিস্তার ঘটেছে এবং এখন পর্যন্ত এক লাখ মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছে এবং প্রায় তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
ইয়েমেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইউসুফ আল হাজেরি বলেছেন, গত চার বছরে সৌদি আগ্রাসনে এ পর্যন্ত ১২ হাজার মানুষ নিহত এবং প্রায় ২৬ হাজার আহত হয়েছে।
এ ছাড়া দেশের বাইরে যেতে না পারার কারণে কিংবা দেশের ভেতরেই চিকিৎসার অভাবে আরো ৩২ হাজার ইয়েমেনি প্রাণ হারিয়েছে। অর্থাৎ সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এ পর্যন্ত প্রায় ৪৪ হাজার ব্যক্তি নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ৬৩৬১জন নারী ও শিশু রয়েছে।
ইয়েমেনের জনগণের বিরুদ্ধে চলমান ব্যর্থ যুদ্ধ এমন সময় পঞ্চম বছরে গড়িয়েছে যখন জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই কোটি ৪০ লাখের বেশি মানুষের জন্য জরুরি সাহায্যে প্রয়োজন। এ ছাড়া, দেড় কোটি মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। শিশুসহ আরো লাখ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন।
ব্যাপক মানবিক বিপর্যয়ের পরও যুদ্ধ অব্যাহত রাখা থেকে বোঝা যায় ভূ-কৌশলগত দিক থেকে ইয়েমেনের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ  কারণেই রাজনৈতিক সমঝোতা সত্বেও সৌদি আরব ও তার মিত্রদের মধ্যে যুদ্ধ অবসানের কোনো আগ্রহই দেখা যাচ্ছে না। আফ্রিকার শিং হিসেবে পরিচিত এলাকার কাছে ইয়েমেনের অবস্থান এবং এ দেশটি লোহিত সাগর ও আরব সাগরকে সংযুক্ত করায় এ দেশটির ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব অনেক। বিশেষ করে, বাব আল মান্দাব প্রণালী হয়ে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বালানিসহ অন্যান্য পন্যসামগ্রী আনা নেয়ার কারণে এ দেশটির ভৌগোলিক গুরুত্ব অপরিসীম। ইয়েমেনের এ ভূ-কৌশলগত গুরুত্বের কারণে সৌদি আরব ও তার মিত্ররা ওই দেশটিতে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ইয়েমেনের তথ্যমন্ত্রী সাইফুল্লাহ আল শামি বলেছেন, তার দেশে নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা শত্রুদের প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু ইয়েমেনের সরকার, জনগণ ও সেনাবাহিনী শত্রুর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং তাদের সব অশুভ পরিকল্পনা নস্যাত করে দিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.