অভিমানী এক মুক্তিযোদ্ধার অন্যরকম প্রতিবাদ

অভিমানী এক মুক্তিযোদ্ধা এখন দেশজুড়ে আলোচনায়। তার মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া চিঠি নিয়ে সর্বত্র চলছে আলোচনা। চিঠি অনুযায়ী, তার শেষ ইচ্ছা পূরণও করা হয়েছে। গার্ড অব অনার ছাড়াই দাফন সম্পন্ন হয়েছে। শেষ বিদায়ের সময় বাজেনি বিউগলের সুর। অভিমানী মুক্তিযোদ্ধার ব্যতিক্রমী এ প্রতিবাদ এখন মানুষের মুখে মুখে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হঠাৎ যদি আমার মৃত্যু হয়, আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন না করা হয়। কারণ অ্যাসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি যারা আমার ছেলেকে চাকরিচ্যুত, বাস্তুচ্যুত করে পেটে লাথি মেরেছে, তাদের সালাম-স্যালুট।
আমার শেষ যাত্রার কফিনে আমি চাই না। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করিও। জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপি বরারর এ চিঠি লেখার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইসমাইল হোসেন। তার এই চিঠিতে লিখে যাওয়া অছিয়ত অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
অবশ্য ম্যাজিস্ট্রেট মহসীন উদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশ প্রশাসনের চৌকসদল গার্ড অব অনার জানাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। দিনাজপুর সদর উপজেলার ৬নং আউলিয়াপুর ইউনিয়নের যোগীবাড়ী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মো. ইসমাইল হোসেন পিতৃস্নেহে চিঠিতে যা লিখে গেছেন তার মূলকথা হচ্ছে- জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপির সুপারিশে ছেলে নুর ইসলামের ‘নো-ওয়ার্ক, নো-পে’ ভিত্তিতে গাড়িচালক হিসেবে চাকরি হয়। সেই সুবাদে নুর ইসলাম সদর অ্যাসিল্যান্ডের গাড়ি চালাতেন। কর্মস্থলে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে হুইপ ইকবালুর রহিম এমপির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এ সময় তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে সেখানে উপস্থিত এডিসি রাজস্বকে বিষয়টি দেখতে বলেন। হুইপকে বিষয়টি অবগত করায় প্রশাসন থেকে প্রথমে নুর ইসলামকে তার বসবাসরত খাস পরিত্যক্ত বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেয়া হয়। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে অ্যাসিল্যান্ড-এর স্ত্রী নুর ইসলামকে বাথরুম পরিষ্কার ও মাংস রান্না করতে বলেন। মাংস রান্না ঠিক না হওয়াসহ বিভিন্ন অজুহাতে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকারিয়াকে নিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে জেলা প্রশাসকও ক্ষিপ্ত হন। এ ছাড়াও নুর ইসলাম তার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মাফ চাওয়ার জন্য অ্যাসিল্যান্ডের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও দেখা করতে পারেনি।  চাকরি চলে যাওয়ায় উপায় না পেয়ে হুইপ ইকবালুর রহিম এমপির সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু প্রশাসন সেটি চরম নেগেটিভ ভাবে নেয়। বর্তমানে তার ছেলেটি চাকরিচ্যুত ও বাস্তুচ্যুত হয়ে স্ত্রী-পুত্র পরিজন নিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
তিনি লিখেছেন, ‘জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে নিয়ে করা স্বাধীন দেশে আমার ছেলের রুজি রোজগারটুকুও অন্যায়ভাবে কেড়ে নেয়া হলো। গত ২১.১০.২০১৯ইং তারিখ থেকে এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দিনাজপুরের কার্ডিওলজি বিভাগে, ওয়ার্ড নং-২, বেড নং-৪৪ এ ভর্তি অবস্থায় আছি, এই পত্রটি তোমার কাছে লিখছি। তোমার কাছে আমার আকুল আবেদন- তুমি ন্যায় বিচার কর। ঠুনকো অজুহাতে আমার ছেলেটিকে চাকরিচ্যুত করায় তাকে চাকরি ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা কর। আমার বয়স প্রায় ৮০ বছরের কাছাকাছি। ছেলেটি হঠাৎ করে চাকরিচ্যুত হওয়ায় একেই তো আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ তারপর মানসিকভাবেও ভেঙ্গে পড়েছি। জীবণ মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হঠাৎ যদি আমার মৃত্যু হয়, আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন না করা হয়। কারণ অ্যাসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি যারা আমার ছেলেকে চাকরিচ্যুত, বাস্তুচ্যুত করে পেটে লাথি মেরেছে, তাদের সালাম-স্যালুট আমার শেষ যাত্রার কফিনে আমি চাইনা।’ পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ২২শে অক্টোবর চিঠিতে তিনি স্বাক্ষর করে ডাকযোগে ঢাকায় জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপির বরাবরে প্রেরণ করেন। পরের দিন ২৩শে অক্টোবর সকাল ১১টার সময় হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন আবস্থায় মারা যান।
বৃহস্পতিবার ২৪শে অক্টোবর সকাল ১১টায় সদর উপজেলার ৬নং আউলিয়াপুর ইউনিয়নের যোগীবাড়ী গ্রামে মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মো. ইসমাইল হোসেনের জানাজার পূর্ব মুহূর্তে ম্যাজিস্ট্রেট মহসীন উদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশ প্রশাসনের একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করার জন্য যান। এ সময় স্ত্রী ছেলে-মেয়েরা তাদের পিতার লিখে যাওয়া চিঠি অনুয়ায়ী তারা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন বা গার্ড অব অনার প্রদান করতে দেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। তাদের ভাষায় এটাই হবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মরহুম ইসমাইল হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। জানাজার আগে মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মো. ইসমাইল হোসেনের পরিবার পরিজন দায়িত্ব দিলে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মোফাজ্জল হোসেন দুলাল জানাজা নামাজে উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বলেন, অন্যায়ভাবে মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মো. ইসমাইল হোসেনের ছেলেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সেই ক্ষোভ থেকেই তিনি এই চিঠি লিখে গেছেন। আমরা তার লিখে যাওয়া চিঠির অছিয়ত অনুয়ায়ী দাফন করতে চাই। চিকিৎসার জন্য তিনি অনেকের কাছে ফোন করে সাহায্য চেয়েছিলেন। গার্ড অব অনার প্রদান করতে যাওয়া ম্যাজিস্ট্রেটকে ছেলেরা বলেন, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় জেলা প্রশাসক বেতন পান। তিনি জেলার পিতা। তার সঙ্গে একজন মুক্তিযোদ্ধা দেখা করতে গিয়ে দেখা পান না। এর চেয়ে লজ্জার কি হতে পারে। এই কারণেই তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল আলম বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর খবর পেয়ে প্রশাসন থেকে গার্ড অব অনার প্রদান করতে যাওয়ার পর বিষয়টি অবগত হই। তিনি বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার  প্রদান করতে না দেয়ায় তা প্রদান করা সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মো. ইসমাইল হোসেনের মুক্তিবার্তা নং-০৩০৮০১১০০২, ভাতা বই নং-৮১৯।

No comments

Powered by Blogger.