ইস্টার হামলার শূণ্যতার পর আবার পর্যটক বাড়ছে শ্রীলংকায়

ইস্টার সানডের সন্ত্রাসী হামলার পর শ্রীলংকা যে সঙ্কটের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল, পর্যটনের ক্ষেত্রে সেই সমস্যাটা তারা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছে। দেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো সন্ত্রাসীদের নির্মূল করা এবং ২১ এপ্রিলের সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দেয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

পর্যটন সূত্রগুলো জানিয়েছে, সরকার পর্যটক আকর্ষণে নীতিমালা গ্রহণ করেছে এবং জুলাই মাসে পর্যটকের সংখ্যা এক লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে।

জুনের তুলনায় জুলাই মাসে পর্যটকের সংখ্যা ৮৩% বেড়েছে। যদিও গত বছরের তুলনায় এই সংখ্যা ১০২,০০০ কম, তবে হোটেল মালিক এবং পর্যটন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষরা আত্মবিশ্বাস জানিয়েছেন যে, এই ঘাটতি শিগগিরই কাটিয়ে উঠতে পারবেন তারা।

পানগার হলিডেজ প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজারেন্দ্রান রাজেন্দ্রান বলেছেন, “এপ্রিলে বিস্ফোরণের পর ৪২% মানুষ সফর বাতিল করেছিল কিন্তু জুনে বাতিল করেছিল মাত্র ৭% এবং জুলাইতে কেউ বাতিল করেনি। আগস্টেও কেউ সফর বাতিল করেনি। আমাদের বাজার মূলত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো, তবে দক্ষিণ এশিয়াতেও আমাদের বাজার রয়েছে। হামলার পর এশিয়ান পর্যটন বাজারে সামান্যই প্রভাব পড়েছে”। দেশের আরও বহু পর্যটন ব্যবসায়ী একই কথা বলেছেন।

শ্রীলংকা ট্যুরিজম ডেভলপমেন্ট অথরিটির (এসএলটিডিএ) তথ্য মতে জুলাই মাসে পর্যটক এসেছে ১১৫,৭০১ জন, যেটা জুনের চেয়ে ৮৩% বেশি। জুনে পর্যটক এসেছিল ৬৩,০৭২ জন, আর মে মাসে পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৩৭,৮০২ জন। এর আগে ২১ এপ্রিল ইস্টার সানডেতে কলম্বোর সবচেয়ে বিখ্যাত তিনটি পাঁচতারা হোটেল এ তিনটি চার্চে সন্ত্রাসী হামলা হয় এবং হামলায় প্রায় আড়াইশ মানুষ নিহত হয়, যাদের মধ্যে ৫০ জন বিদেশী পর্যটক রয়েছে।

পর্যটন কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করেছে যে, বিগত বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে পর্যটনের বাজার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে এবং পুরো শ্রীলংকা জুড়ে হোটেলগুলোতে লোকসমাগম বাড়তে শুরু করেছে। এসএলডিটিএ ডিরেক্টর জেনারেল উপালি রত্নায়েকের মতে পর্যটন শিল্প অক্টোবর থেকে সন্তোষজনক মওসুম দেখতে পাবে। শ্রীলংকা গত বছর ২.৩৩ মিলিয়ন পর্যটককে স্বাগত জানিয়েছিল এবং ৪.৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশী মুদ্রা আয় করেছিল। লোনলি প্ল্যানেট গত বছর শ্রীলংকাকে ২০১৯ সালে পর্যটনের জন্য এক নাম্বার গন্তব্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল। আশা করা হচ্ছে, শ্রীলংকা তার সেই অবস্থানকে ধরে রাখতে পারবে।

ইস্টার সানডের সন্ত্রাসী হামলার পরও লোনলি প্ল্যানেট জুলাই মাসে বলেছে যে, শ্রীলংকা এখনও সফরের জন্য শীর্ষ গন্তব্য রয়েছে। এসএলটিডিএ বলেছে, বছরের শেষ নাগাদ তারা ১.৯ থেকে ২ মিলিয়ন পর্যটন পাবে বলে আশা করছে।

এদিকে, পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে শ্রীলংকা সরকার। এর মধ্যে বিশ্বের কাছে নিজেদের উন্মুক্ত করার জন্য পর্যটক আকর্ষণের উদ্দেশ্যে ছয় মাসের জন্য ভিসা-অন-অ্যারাইভাল প্রকল্প চালু করেছে সরকার।

পর্যটন মন্ত্রী জন আমারাতুঙ্গা গত সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পদক্ষেপের ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিঙ্গের উপস্থিতিতে শিল্প উদ্যোক্তা এবং কূটনীতিকদের নিয়ে আয়োজিত এক ফোরামে তিনি এ ঘোষণা দেন।

যে ৪৯টি দেশের নাগরিকরা ফ্রি ভিসা অন অ্যারাইভাল পাবে, সে দেশগুলো হলো: অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, কানাডা, কম্বোডিয়া, চীন, ক্রোয়েশিয়া, সাইপ্রাস, চেক রিপাবলিক, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, হাঙ্গেরি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, আইসল্যান্ড, ইসরাইল, ইটালি, জাপান, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, মালয়েশিয়া, মালটা, নেদারল্যান্ডস, নিউ জিল্যান্ড, নরওয়ে, ফিলিপাইন্স, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্লোভাক রিপাবলিক, শ্লোভেনিয়া, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, ইউকে এবং ইউএসএ।

পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, ছয় মাস পরে ফ্রি ভিসার সিদ্ধান্তটি পর্যালোচনা করা হবে যে, এটা উপকারী কি না। পর্যটন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতে, ইস্টার সানডের হামলার পরের তিন মাসে ১.৫ বিলিয়ন রুপির ক্ষতি হয়েছে সরকারের। সকল পর্যটককে ইলেকট্রনিক ট্রাভেল অথরাইজেশানের (ইটিএ) জন্য এই বিভাগের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে আবেদন করতে বলা হয়েছে, যাতে বিমানবন্দরে তাদের দেরি না হয়, অন্যদিকে বিমানবন্দরেও অন অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধা চালু করা হয়েছে। এদিকে, সিনামেন হোটেল এবং রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ পর্যটনের জন্য ‘ব্রিং অ্যা ফ্রেন্ড হোম’ কর্মসূচি শুরু করেছে। কাকতালীয়ভাবে গত সপ্তাহে ৩০ জুলাই বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবসে এই ব্রিং অ্য ফ্রেন্ড হোম প্রচারণা শুরু করা হয়।

এই প্রচারণার প্রধান উদ্দেশ্য হলো পর্যটকদের বন্ধুদেরকে শ্রীলংকা সফরে উদ্বুদ্ধ করা এবং পর্যটকদের মাধ্যমে কিছু বক্তব্য নিয়ে আসা এবং সেগুলো প্রচার করা যে এই দেশটি সফরের জন্য নিরাপদ। এই প্রচারণাটি পুরো পর্যটন পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য সিনামেনের অবদান, যেখানে স্থানীয় অন্যান্য শিল্পগুলোও সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। সৃজনশীল এই প্রচারণার মাধ্যমে শুধু শ্রীলংকাতে বসবাসরতদের নয়, বরং প্রবাসে অবস্থানরত লংকানদেরকেও তুলে ধরা হচ্ছে, যাতে তারা তাদের বিদেশী বন্ধুদের আগামী মাসগুলোতে শ্রীলংকা সফর করতে উৎসাহিত করে।

প্রচারণা কর্মকর্তাদের মতে, সাবেক মিস শ্রীলংকা এবং বর্তমান হলিউড অভিনেত্রী জ্যাকুলিন ফার্নান্দেজ সিনামেনের ‘ব্রিং অ্য ফ্রেন্ড হোম’ প্রচারণার অধীনে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে শ্রীলংকা সফর করবেন। সে অনুযায়ী এই প্রচারণার শুরুতে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বলিউডের ১৫ জন বন্ধুকে নিয়ে তিনি শ্রীলংকায় তার জন্মদিন উদযাপন করবেন।

বিক্রমাসিঙ্গে ইতোমধ্যে নিশ্চিত করেছেন যে শ্রীলংকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে, এবং সরকার দেশের পর্যটন শিল্প পুনরুদ্ধারের জন্য পুরোপুরি সচেষ্ট।

বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের নিরাপত্তা এখন শক্তিশালী। দেশে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি এবং শ্রীলংকাকে আমরা নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে গড়ে তুলতে চাই”।

শীর্ষ নিরাপত্তা প্রশাসকদের সাথে তাল মিলিয়ে লঙ্কান প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, এপ্রিলে আইসিস স্টাইলে হামলার সাথে জড়িত সবাই এখন কারাগারে। তিনি আরও বলেন যে, স্থানীয় সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ককে পুরোপুরি ধসিয়ে দেয়া হয়েছে এবং আত্মঘাতী হামলায় যারা সহায়তা করেছিল তাদেরকে বর্তমানে প্রিভেনশান অব টেররিজম অ্যাক্টের (পিটিএ) অধীনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

পর্যটনকে উৎসাহিত করার জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসায় সরকার সন্তুষ্ট উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, ক্যান্ডি পেরাহেরা, ফিস্ট অব আওয়ার লেডি অব মাধু, হিন্দু ভেল যাত্রাসহ সমস্ত প্রধান ধর্মীয় ঐতিহ্যবাহী উৎসবগুলো হবে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে। শ্রীলংকার সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান উৎসব ক্যান্ডি পেরাহেরা প্রতি বছর আগস্টে ক্যান্ডিতে অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে বিপুল সংখ্যক পর্যটকের সমাগম ঘটে।

No comments

Powered by Blogger.