কেন ব্যর্থ হলো বাংলাদেশ? by রবিউল ইসলাম

বিশ্বকাপ মিশন শেষ করে বাংলাদেশ দল এখন দেশের পথে। অথচ অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বকাপ মঞ্চে গিয়েছিল তারা। কিন্তু ৪৭ দিনের লড়াইয়ে শূন্য হাতে ফিরতে হচ্ছে মাশরাফি বাহিনীকে। এই ব্যর্থতা কেবল পারফরম্যান্সের কারণেই নয়, সঠিক পরিকল্পনার অভাব, খেলোয়াড়দের ইনজুরিসহ আরও অনেক কারণেই হয়েছে।
তার ওপর বিশ্বকাপ শুরুর আগ থেকে দলের বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার পুরোপুরি ফিট ছিলেন না। বিশেষ করে মাহমুদউল্লাহ। চলতি বছরের শুরুর দিকে নিউজিল্যান্ডে খেলতে গিয়ে কাঁধের ইনজুরিতে পড়েন। দেশে ফিরে কিছুটা সুস্থ হলেও বোলিং করার মতো অবস্থায় ফিরতে পারেননি। তাই আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের পাশাপাশি বিশ্বকাপে বোলার মাহমুদউল্লাহর সার্ভিস পায়নি বাংলাদেশ। এছাড়া ফিটনেসের ঘাটতি থাকায় পুরো বিশ্বকাপেই মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিং ছিল অস্বস্তিতে ভরা। মাশরাফি প্রায়ই বলতেন, ‘মাহমুদউল্লাহ বোলিংটা পেলেও দল উপকৃত হতো।’ কিন্তু বোলিংতো পেলোই না, ব্যাটিংয়েও ছিলেন না -আপ টু দ্য মার্ক।
মাহমুদউল্লাহর মতো অধিনায়ক মাশরাফিরও একই অবস্থা। মাশরাফি চোট নিয়ে নিয়মিতই খেলেন আসছেন। এইসব চোটকে পাত্তা দেননি কখনো। এভাবে ব্যথা সয়েও দলের জন্য আত্মনিবেদনের কারণে বরাবরই তিনি প্রশংসিত। কিন্তু আয়ারল্যান্ড সিরিজ ও বিশ্বকাপ মিলিয়ে ৬৪ দিনের লম্বা সফরে মাশরাফি খুব একটা স্বস্তি নিয়ে খেলতে পারেনি। পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে পা ফুলে যাওয়াতে খেলতেই চাননি তিনি! শেষ পর্যন্ত খেললেও পারফরম্যান্সের পরিবর্তন হয়নি। আগের ম্যাচগুলোর মতো শেষ ম্যাচেও তার হাতে সাফল্য ধরা দেয়নি।
মাশরাফি নতুন বলে সব সময়ই ব্রেক থ্রু এনে দেন। কিন্তু এবার মাশরাফিসহ দলের অন্য পেসাররা নতুন বলের ব্যবহারটি ঠিকমতো করতে পারেনি। পুরো টুর্নামেন্টে ৮ ম্যাচে ৫৬ ওভার বল করে ৩৬১ রান খরচ করে পেয়েছেন মাত্র ১ উইকেট। আলো ঝলমলে ক্যারিয়ারে এমনটা মাশরাফি আর দেখেননি। বলের গতি কমিয়ে লাইন-লেন্থ মেনে সাফল্য পাচ্ছিলেন নিয়মিত। কিন্তু এবার ইনজুরি ও টানা খেলার ধকল সামলাতে না পেরে মুদ্রার উল্টা পিঠও দেখতে হলো বাংলাদেশের সফলতম এই পেসারকে। তার এমন পারফরম্যান্সের প্রভাবটা পড়েছে পুরো দলের ওপরও।
অপর দিকে বিশ্বকাপের বেশ কয়েকটি ম্যাচে বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্টের পরিকল্পনার অভাবও স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে। এমনকি আবহাওয়া, উইকেট পর্যবেক্ষণের অদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে রীতিমতো। বিশেষ করে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে উইকেট পর্যবেক্ষণ করতে পারেনি বলেই বাংলাদেশ স্কোরবোর্ডে পর্যাপ্ত রান তুলতে ব্যর্থ হয়েছে!
যেমন ওভালে ব্যবহৃত উইকেটে খেলেছিল বাংলাদেশ। ওই ম্যাচের উইকেটটি ২৫৬/২৭০ রান হলেই যথেষ্ট। কিন্তু বাংলাদেশ তিনশো রানের পেছনে ছুটতে গিয়ে অলআউট হয়েছে ২৪৪ রানে। ড্রেসিংরুম থেকে বার্তাও পাঠানো হয়েছিল ৩০০ রান করো, নয়তো পারবে না! অথচ এই উইকেটটি কোনওভাবেই তিনশো রানের ছিল না। ভুল বার্তায় বাংলাদেশ ম্যাচটি হেরে গেছে ২ উইকেটে। একই ধরনের পরিস্থিতিতে সাউদাম্পটনে আফগানিস্তানেক হারিয়েছিল যথাযথ ভাবে উইকেট পর্যবেক্ষণ করেই।
বাংলাদেশের আরও একটি বড় ভুল- টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই প্রতিপক্ষদের জয়-পরাজয়ের বিন্দুতে ভাগ করে ফেলা। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে সেমিফাইনালে যাওয়ার ছক কষেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু টুর্নামেন্টের আগে এমন ছকই মূলত কাল হয়েছে শেষ পর্যন্ত। নির্ধারিত ম্যাচগুলোর তিনটি জিতলেও বাকি ম্যাচগুলোতে জয়ের মুখ দেখা হয়নি। তার ওপর ছিল বৃষ্টির বাধা।
নির্ধারিত ম্যাচের বাইরের বেশ কয়েকটি ম্যাচের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ সেরা ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করেছে। হয়তো ব্যাক অব দ্য মাইন্ডে এই দলের বিপক্ষে জেতা সম্ভব নয়-এই মানসিকতা কাজ করেছে। যে কারণে এই ম্যাচ জয়ের হিসেবের মধ্যে ছিল না!
টুর্নামেন্টের অষ্টম স্থানে থেকে বিশ্বকাপ শেষ করার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ দৃষ্টিকটু ফিল্ডিং ও ক্যাচ মিসের মহড়া। পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচের দিনও মাশরাফি নিজেদের এমন অবস্থানের জন্য বাজে ফিল্ডিং ও ক্যাচ মিসকেই দায়ী করেছেন।
আর টুর্নামেন্ট শেষে পুরো দলের আক্ষেপ হয়ে আছে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কেন উইলিয়ামসনকে নিশ্চিত রান আউট করতে না পারার ব্যর্থতা। এরপর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে সাব্বির রহমান ডেভিড ওয়ার্নারের ক্যাচ মিস করে তাকে জীবন দিয়েছিলেন। ভারতের বিপক্ষে বাঁচা মরার লড়াইয়েও দলের অন্যতম সেরা ফিল্ডার তামিম ওপেনার রোহিত শর্মার ক্যাচ ছেড়ে দিয়েছিলেন। আর তাতে ম্যাচ থেকে ছিটকে গেছে বাংলাদেশ। এমন একটি-দুটি ক্যাচ হলে হতো। কিন্তু সব মিলিয়ে ৮টি ক্যাচ মিস হয়েছে বাংলাদেশের। এই ক্যাচগুলো নিতে পারলে হয়তো সেমিফাইনাল খেলার প্রস্তুতি নিতে পারতো মাশরাফিরা।
মাশরাফিও প্রতিটি ম্যাচ শেষে প্রায়ই বলেছেন, ‘বোলাররা সব সময় ফিল্ডারদের উজ্জীবিত করতে পারবে না। যখন বোলারদের কোন কিছুই ঠিক মতো হবে না। তখন ফিল্ডাররা ভালো একটি ক্যাচ নিয়ে কিংবা ভালো একটি ফিল্ডিং করে বোলারদের উজ্জীবিত করতে পারে। কিন্তু আমাদের ফিল্ডাররা যেন আরও নেতিয়ে পড়ে।’
অবশ্য এত নেতিবাচকতার পরেও বাংলাদেশের একজন কেবল রাজার আসনে বসে আছেন। পুরো টুর্নামেন্টে এই রাজাকে খানিকটা সাহায্য করতে পারলেই বাংলাদেশের সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্নটা পূরণ হতো। কিন্তু সাকিবকে সেই সঙ্গ দিতে পারেনি তার সতীর্থরা। তাইতো পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ হেরে মাশরাফি সাকিবের কাছে ‍দুঃখ প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করলেন না।

No comments

Powered by Blogger.