পোশাক শিল্পের ২২ শতাংশ নারী কর্মী হয়রানির শিকার- অ্যাকশনএইড

কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নারীরা যৌন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। এই সহিংসতা প্রতিরোধে আইনি কাঠামোতে নেই সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা। ফলে কর্মক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নারীর অংশগ্রহণ এবং উপস্থিতি। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। বাংলাদেশে ২২ শতাংশ  নারী পোশাক কর্মীরা কর্মক্ষেত্রে শারীরিক, মানসিক এবং যৌন হয়রানির শিকার হন। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের নতুন এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল ঢাকার গুলশান শুটিং ক্লাবে ‘নারীবান্ধব নিরাপদ কর্মস্থল’ নামে একটি আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই প্রতিবেদন তুলে ধরে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ।
অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নারীদের প্রতি সহিংসতাকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখা হয়।
আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এর কোনো প্রতিকার না থাকায় বর্তমান কাঠামো সহিংসতাকে আরো উসকে দেয়। যা নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। ‘কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা: প্রতিদিন প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রে ঘটছে’ নামের গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন। এতে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী, কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা মানবাধিকারের সর্বাধিক লঙ্ঘনের মধ্যে একটি। এক শুমারী অনুযায়ী, ১৫ বছরের বেশি বয়সী ৩৫ শতাংশ নারী (বিশ্বব্যাপী ৮১৮ মিলিয়ন নারী) তাদের বাড়িতে, কমিউনিটিতে অথবা কর্মক্ষেত্রে যৌন বা শারীরিক সহিংসতার শিকার হয়েছে।
বাংলাদেশে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং মানব উন্নয়নে অবদান রাখলেও কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, কর্মক্ষেত্রের উৎপাদনশীলতা এবং মুনাফাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাছাড়া, কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা নারীর মর্যাদা এবং শারীরিক ও মানসিক কল্যাণে বাধা দেয়। ‘সজাগ নেটওয়ার্ক’ কর্তৃক পরিচালিত একটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ২২ শতাংশ নারী পোশাক কর্মীরা কর্মক্ষেত্রে অথবা কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পথে শারীরিক, মানসিক এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উপর বিশ্বাসের অভাবের কারণে তাদের মধ্যে ৬৭ শতাংশ-ই নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ কমিটির কাছে প্রতিকার চায় না। এই পরিস্থিতিতে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে দেশের বিদ্যমান আইনেরও বিশ্লেষণ করেছে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ। বিশ্লেষণ বলছে, কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাকে চিহ্নিত করার জন্য সামগ্রিক আইনি কাঠামোয় কার্যকরভাবে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিভিন্ন ধরণ অনুযায়ী উল্লেখ নেই, যার মধ্যে  অন্যতম-যৌন হয়রানি। বিদ্যমান আইনে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি যৌন হয়রানিকে। গবেষণা বলছে, কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সুপ্রিম কোর্ট ২০০৯ সালে একটি নির্দেশনা দেয়।
এই নির্দেশনা প্রণয়নের নয় বছর পরও প্রতিষ্ঠানগুলো যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নির্দেশনা অনুযায়ী কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ-এর গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৭ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী উক্ত দিক-নির্দেশনা সম্পর্কে একেবারেই অবগত নয়, কর্মক্ষেত্রে যার হার ৬৪.৫ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্‌ কবির বলেন, একদিকে আইনে যৌন হয়রানিকে সজ্ঞায়িত করা হয়নি। অন্যদিকে বিদ্যমান আইনের প্রয়োগেও রয়েছে গুরুতর অভাব। মামলার বিলম্বিত নিষ্পত্তি এবং তদন্ত কর্মকর্তা এবং পাবলিক প্রসিকিউটরদের অদক্ষতা ও অবহেলার কারণে ক্ষতিগ্রস্থরা প্রায়ই বিচার পেতে ব্যর্থ হন। এর প্রভাব পড়ছে নারীর মনে, কাজে, সমাজে।
নারী নেত্রী খুশি কবির বলেন, দেশে নারীকে দমন করা ও নির্যাতন করাকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখা হয়। আবার তার শ্রমকে মর্যাদা দেয়া হয় না। আইনের পাশাপাশি দরকার মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। মানুষকে শ্রদ্ধা করতে না শিখলে আইনের উন্নতি হবে না। বাস্তবায়ন হবে না। এজন্য আমাদের পাঠ্যপুস্তকেও পরিবর্তন আনা দরকার। আওয়াজ ফাউন্ডেশন-এর নির্বাহী পরিচালক নাজমা আক্তার বলেন, আমাদের নিরাপত্তার কোন জায়গা নেই। আছে শারীরিক ও মানুষিক নির্যাতন। আছে বৈষম্য। সব মিলিয়ে নারীরা সব সময় ভয় নিয়ে কাজ করছেন। এর প্রতিকার দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন-এর অধ্যাপক ও বিজিএমইএ-এর পরিচালক এ. মোমেন বলেন,  কোন ক্ষেত্রেই আমরা নারীর অবমাননা চাই না। পিতৃতান্ত্রিক চিন্তা বদলাতে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। পোশাক শিল্প মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে আমি বলতে পারি, শেষ পর্যন্ত দায়টা আমাদের উপর। আমরা নিরাপত্তা নিশ্চিত কারার মধ্যমে একটি টেকসই ব্যবসা ব্যবস্থা পরিচালনা করতে চাই।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন বলেন, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রয়োজনে সরকার আইন সংশোধন ও নতুন আইন প্রনয়ন করবে। তবে শুধু আইন দিয়ে সহিংসতা বন্ধ করা সম্ভব না। এজন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন আনতে হবে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাই কমিশনার পেনি মর্টন বলেন, সহিসংতার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধান করতে হবে। আমরা চাই নারীর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংযুক্তি বাড়ুক। এজন্য নারীর প্রতি সহিংসতা একটি প্রতিবন্ধকতা। এটার সমাধান করতে হবে। কারণ সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা না হলে সমাজের উন্নতি হবে না।

No comments

Powered by Blogger.