ওদের কান্নার যেন শেষ নেই

আমার বাবা কই? বাবাকে ফেরত চাই। বাবাকে ফিরিয়ে দিন। বাবার সঙ্গে ঈদ করতে চাই। এসব বলতে বলতে কেঁদে ফেলে ছোট্ট লামিয়া আক্তার মীম। কান্নায় ভেঙ্গে পড়া মেয়েটি আর কিছুই বলতে পারেনি। ছোট্ট মীমের কান্না দেখে কেঁদেছেন আরও অনেকেই। মীম নিখোঁজ গাড়ি চালক কাওসারের মেয়ে। শুধু ছোট্ট মীম নয় এমন অনেক স্বজন উপস্থিত হয়েছিলেন গত ২৫ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে। হাতে নিখোঁজ স্বজনের ছবি। কেউ এসেছেন বাবার খোঁজে, কেউবা ভাই আর স্বামীর খোঁজে। হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের ছবিটাই বুকে আকড়ে ধরে বেঁচে আছেন তারা। আর তাদের অশ্রুসিক্ত নয়নই জানান দিয়েছে আপনজন হারানোর বেদনা কতটা কষ্টদায়ক। স্বজন হারানোর পরে অনেকের পরিবারে চলছে গুমোট পরিস্থিতি। তাদের দাবি একটাই ঈদের আগে যেন তাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দেয়া হয়।
গত ২৫ মে শনিবার শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক গুম সপ্তাহ। ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের উদ্যোগে মানববন্ধনে উপস্থিত হন নিখোঁজদের স্বজনরা।
প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর ধরে মিলছে না ভাইয়ের খোঁজ। তার ভাই বেঁচে আছে না মৃত্যু বরণ করেছে সেই তথ্যটাও জানা নেই তার। বোন মুন্নির চোখের জল শুধুই ভাই সেলিম রেজা পিন্টুকে ফিরে পাবার জন্য। তিনি বলেন, আমার বাবা-মা প্রতিদিন পথ চেয়ে বসে থাকেন এই বুঝি ছেলে ফিরবে। ভাই হারানোর কষ্ট প্রকাশ করতে পারি না। বাবা মায়ের কাছে শক্ত থাকার অভিনয় করি। এভাবে চলে গেলো সাড়ে পাঁচ বছর। আর এভাবে পারছি না এবার ভাইকে ফিরে চাই। আমরা প্রতিদিন মরছি। ভাইকে ফেরত দিন নয়তো আমাদেরও মেরে ফেলুন।
সন্তান হারা এক মা প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি নিজেও স্বজনহারা। স্বজন হারানোর বেদনা আপনি বোঝেন। আমরা মা। আমারা সন্তানকে ফেরত চাই।
মায়ের ডাকের সমন্বয়ক ও গুম হওয়া সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন আফরোজা ইসলাম আঁখি মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন। জাতীয় মানবাধিকার সমিতির চেয়ারম্যান মঞ্জুর হোসেন ইসার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান, মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন প্রমুখ। গুম হওয়া পরিবারের মধ্যে বক্তব্য দেন নিখোঁজ সাজেদুল ইসলাম সুমনের বড় বোন মারুফা ইসলাম ফেরদৌসি, বংশালের নিখোঁজ ছাত্রদল নেতা পারভেজ হোসেনের মেয়ে আদিবা ইসলাম প্রমুখ।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বছরের পর বছর গুম হওয়া পরিবারের কাঁন্না প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছায়নি। অনুগ্রহ করে ঈদের আগে নিখোঁজদের ফিরিয়ে দিন। দেশে গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্র থাকলে গুম খুনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, গুম করছে কারা তা খুঁজে বের করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যারা এরসঙ্গে জড়িত তাদের অতিদ্রুত খুঁজে বের করতে হবে। সেই দায়িত্ব থেকে পিছু হটে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর রাষ্ট্র চুপ। মামলা নিতে চায় না তারা। তদন্ত হয় না। ঝুলে থাকে বিচার কাজ। আবার ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার অভিযোগও পাওয়া যায়। গুমের সঙ্গে জড়িত থাকে প্রভাবশালীরা। তিনি বলেন, গুম যতদিন থাকবে ততদিন আমাদেরও প্রতিবাদ অব্যাহত থাকবে।
নাসির উদ্দিন এলান বলেন, দেশে গুমের একটি সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। সেখান থেকে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আমরা মনে করি, এসব গুম সরকারের নির্দেশেই হচ্ছে। কারণ সবাইকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে। তবে তাকে সরকারের দায়িত্ব ফিরিয়ে দেয়া। দেশে ৫শ’র অধিক গুমের ঘটনা ঘটলো। কিন্তু ফিরে এসেছে কজন? হাতে গোনা কয়েকজন।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, গুমকে নির্যাতনের হাতিয়ার করে ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। যারা ফিরে আসছেন তারা একটি শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করছেন না। কারণ তারা ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এসেছে। যার ফলে একটি শব্দও তারা উচ্চারণ করতে পারছেন না।
নিখোঁজ সাজেদুল ইসলাম সুমনের বড় বোন মারুফা ইসলাম ফেরদৌসি বলেন, ছেলের শোকে কাতর আমার মা। কাঁদতে কাঁদতে কুঁজো হয়ে গেছে। আমার ভাইয়ের মতো আপনাদের সকলের একই অপেক্ষা। অভিযোগ নেই কারো বিরুদ্ধে, তারা ফিরে পেতে চান প্রিয় ব্যক্তিকে। ঈদ মানে আনন্দ এই আনন্দ ভাগাভাগি করতে চায় স্বজনদের সঙ্গে।
মায়ের ডাকের সমন্বয়ক আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, গত পাঁচ ছয় বছর ধরে নিখোঁজ আমাদের স্বজনরা। আমাদের স্বজনদের র‌্যাব, ডিবি পরিচয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে নিয়ে গেছে। আমরা বিভিন্ন সময় সরকারের কাছে জানিয়েছি কিন্তু কোন সমাধান পাই নাই। রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান ফিরে আসার পর কিছিুটা আশার আলো দেখতে পাই। তার মতো আমাদের স্বজনরা ফিরে এলে কতোই না ভালো হতো।

No comments

Powered by Blogger.