রাজনৈতিক গোষ্ঠী ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ধর্মের অপব্যবহার করছে

সামপ্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিভাজনের রাজনীতি ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে এমন মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেছেন, ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনীতি দিয়ে কোনো দেশ এগোতে পারে না। কিন্তু ক্ষমতা ধরে রাখতে এদেশে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী ধর্মের অপব্যবহার করছে। বক্তারা বলেন, সারা বিশ্বে যখন ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনীতির উত্থান ঘটছে, তখন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী  জেসিন্ডা আহডার্ন এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাই তারা ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিভাজনের রাজনীতি পরিহারের আহ্বান জানিয়েছেন। ক্রাইস্টচার্চে হামলার পর শান্তি ও সমপ্রীতির অনন্য নজির স্থাপনের জন্য জেসিন্ডাকে শান্তিতে নোবেল দেয়ার দাবি জানান বক্তারা। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ও আহতদের প্রতি শোক ও সংহতি শীর্ষক আলোচনা সভায় বিশিষ্টজনেরা এ আহ্বান জানান। জাতীয় প্রেস ক্লাবে সলিডারিটি এগেইনস্ট ইনটলারেন্স, হেইট্রেট অ্যান্ড এক্সট্রিমিজম’ এ শোক ও সংহতি সভার আয়োজন করে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, বর্তমানে ক্ষমতালোভীরা ধর্মের অপব্যবহার করে মানুষকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করার জন্য হিংসা করা উচিত নয়। রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার করা যাবে না। মানুষের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য করা যায় না। এটা সারা দেশের মানুষ বিশ্বাস করে। বৈষম্য হলো নীতি, ঐতিহ্য ও ধর্মের পরিপন্থী। ড. কামাল বলেন, স্বাধীনতার অর্জনগুলো ধরে রাখতে সমপ্রীতির মূল্যবোধকে ছড়িয়ে দিতে হবে। সংবিধানেও ধর্মের অপব্যবহার না করার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক, আমাদের দায়িত্ব সবধর্মের সঙ্গে সমপ্রীতি গড়ে তোলা। আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, মানুষের সব অধিকারকে রক্ষা করতে হবে।
মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারকে রক্ষা করার জন্য আমাদের কথা বলতে হবে। মানবাধিকার হত্যা করার জন্য নয়, সবার অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। তুমি মুসলমান না বাঙালি এই পরিচয় আমাদের বড় পরিচয় নয়। সবধর্মের মধ্যে সমপ্রীতি গড়ে তোলা ও ধর্মের অপব্যবহার না করার এ মূল্যবোধ জাগ্রত করেই এবারের স্বাধীনতা দিবস পালন করুন। তিনি বলেন, আজকে যারা এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন এটি খুবই সময় উপযোগী অনুষ্ঠান। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর থেকে অনেক কিছু শেখার আছে জানিয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, নিউজিল্যান্ড আজ দৃষ্টান্ত হলো। তাঁদের ধর্মের নয়, অন্য ধর্মের লোকদের নৃশংসভাবে হত্যার পর তাদের পাশে দাঁড়ানোয়।
মানবিক দৃষ্টান্ত থেকে তাঁরা এ ভূমিকা পালন করেছেন। আমরা দেখেছি রাষ্ট্রের নির্দেশে রেডিও-টিভিতে আজান প্রচার হয়েছে। নিউজিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট হিজাব পরে জুমার নামাজ পাহারা দিতে এসেছেন। তিনি বলেন, দেশেও অনেক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী গুম খুনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু কাউকে লজ্জিত হতে দেখা যায়নি। বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, ধর্ম যখন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়, তখনই তা মানবতাবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, নিউজিল্যান্ডের ঠিক একটা বিপরীত জগতে আমরা বসবাস করছি। আমরা মানবতার চাষ করি না, হিংসার চাষ করি। আমাদের মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র ও রাজনীতির মধ্যে ধর্ম আনা যাবে না। মান্না বলেন, নিউজিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট বিশ্বব্যাপী মানবতাবাদীর পরিচয় পাচ্ছেন। আর আমাদের রাষ্ট্র কিসের চর্চা করছে আমরা কি দেখছি না! এই দেশে আজ মানবতা নেই, গাড়ি চাপা দিয়ে মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে, গুম-খুনের কোনো বিচার নেই। মানুষ ভোট দিতে পারে না। তাহলে এ দেশে কি মানবতা আছে? নিউজিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করেনি। এজন্য তিনি মডেল। আর আমাদের দেশে এই ধর্মকে ব্যবহার করে ধর্ষণের পর দায়ভার অন্যের কাধে তুলে দেয়া হচ্ছে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশে হলি আর্টিজানের পর একজনকেও জীবিত ধরতে পারেনি। আর নিউজিল্যান্ডের ঘটনায় দেখেছি জীবিত ধরেছে। বাংলাদেশে এভাবে মানুষ মারার ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স আসতে হবে। তিনি বলেন, নিউজিল্যান্ডে কোনো প্রোগ্রাম করতে অনুমতি লাগে না। পুলিশকে জানালেই হয়। আর আজ পুরো বাংলাদেশ বসে আছে আগুনের উপর। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, বাংলাদেশে কোনো ঘটনা ঘটলেই ঘৃণা ও বিভাজন ছড়িয়ে দেয়া হয়। মতবিরোধ ও সমালোচনা থাকবে কিন্তু বিভাজন দূর করে রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বিভাজনের রাজনীতি বন্ধ করতে জেসিন্ডা নতুন দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। আলোচনা সভায় জেসিন্ডাকে ‘প্রকৃত মানবতার মা’ উপাধি দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, বর্বরোচিত হামলার মাধ্যমে হামলাকারী যে অন্ধকার ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন, তা প্রতিরোধ করে দিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ও সাধারণ মানুষ।
বাংলাদেশ কল্যান পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীকের স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে শুরু হওয়া শোক ও সংহতি সভাটি সঞ্চালন করেন জামায়াতের বহিষ্কৃৃত নেতা মজিবুর রহমান মঞ্জু। বিভেদ, বিদ্বেষ ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে সংহতি জানিয়ে অনুষ্ঠানে প্রফেসর দিলারা চৌধুরী, সাবেক সচিব মোফাজ্জল করিম, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. সুকোমল বড়ুয়া, বিজন কান্তি সরকার, মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর, মাওলানা সাইয়েদ কামাল উদ্দিন জাফরী, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা ও যায়যায়দিনের সাবেক ব্যবস্থাপনা সম্পাদক নূরুল ইসলাম ভূঁইয়া প্রমুখ বক্তব্য দেন। উল্লেখ্য, গত ১৫ই মার্চ ক্রাইস্টচার্চের আল-নূর ও লিনউড মসজিদে জুমার নামাজের সময় হামলা চালিয়ে অস্ট্রেলীয় বংশোদ্ভূত উগ্রপন্থী ব্রেনটন টারান্ট পাঁচ বাংলাদেশিসহ ৫০ মুসলিমকে হত্যা করে। এতে আহত হন অন্তত ৫০ জন।

No comments

Powered by Blogger.