তরুণদের বিনোদনহীন নগর ঢাকা

সবাই জানি,একটি দেশের প্রধান শক্তি তরুণ প্রজন্ম৷ তাদের সঠিক বিকাশের জন্যে বিনোদন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়৷ অথচ রাজধানী ঢাকায় এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির বিষ্ময়কর রকমের অনুপস্থিতি৷ সে বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা৷
১. মেধা বিকাশের সঙ্গে শারীরিক সক্ষমতা বা সুস্থতার সঙ্গে বেড়ে ওঠা অপরিহার্য৷ তরুণরা কতটা খেলাধুলার সুযোগ পান, তার উপর নির্ভরকরে শারীরিক-মানসিক সুস্থতা৷ ঢাকা শহরের তরুণদের খেলার মাঠ নেই৷ এক সময় যেগুলো খেলার মাঠ ছিল, সেগুলো দখল হয়ে গেছে৷ কোনো কোনো মাঠে উঠেছে বড় বড় ভবন৷
বিশ পঁচিশ বছর আগেও ঢাকা শহরে অনেকগুলো পুকুর ছিল৷ বিশেষ করে পুরনো ঢাকায় অত্যন্ত মানসম্পন্ন পুকুর ছিল৷ সেগুলোতে গোসল-সাঁতার কাটা যেত৷ কিশোর-তরুণদের সাঁতারে মুখরিত হয়ে থাকতো পুকুরগুলো৷ পুকুরগুলো ভরাট করে ভবন তৈরি করা হয়েছে৷ সাঁতারও যে বিনোদন, তা আমাদের ‘উন্নয়নবিদদের' বোধের মধ্যেই নেই৷
বুড়িগঙ্গার তীরের ঢাকার চারপাশেই নদী৷ অথচ একটি নদীতেও গোসল বা সাঁতার কাটা যায় না৷ পানি এতটাই বিষাক্ত হয়ে গেছে যে নদীগুলোর কাছাকাছি গেলেও দুর্গন্ধে দম আটকে আসার উপক্রম হয়৷ নদীতে ঘুরতে যাওয়ার মত পরিবেশ নেই৷
২. ঢাকা শহরের ভেতরে রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেনের মত বেশ কয়েকটি পার্ক এখনো আছে৷ রমনা পার্কে সকাল-বিকেল যাওয়া যায়৷ সন্ধ্যা-রাতের রমনা পার্ক সন্ত্রাস- অপকর্মের স্বর্গ৷ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা চন্দ্রিমা উদ্যানের পরিবেশও তরুণ-তরুণীদের সময় কাটানোর মত নয়৷ সন্ধ্যার পরেতো নয়ই৷ বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাওয়া মানেই বিপদে পড়া৷ কথাগুলো বলছি একারণে যে, তরুণ-তরুণীরা একটি পার্কে গিয়ে বসে কথা বলবে, এমন কোনো পার্ক রাজধানী ঢাকায় নেই৷
৩. শুধু বাইরে নয়, ঘরোয়া বিনোদনেরও বড় আকাল ঢাকা শহরে৷ একসময় পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি ছিল৷ পড়াশোনা ছাড়াও লাইব্রেরিকে কেন্দ্র করে নানা রকমের সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছিল৷ এখন লাইব্রেরি নেই৷ নেই কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড৷ এলাকায় এলাকায় কমিউনিটি সেন্টার আগের চেয়ে বেড়েছে৷ কিন্তু সেখানে তরুণ-তরুণীদের সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি৷ কমিউনিটি সেন্টারগুলো হয়ে গেছে মানুষের বিরক্তির কারণ৷ বিয়ে বা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান উপলক্ষে সারা রাত বিকট আওয়াজে হিন্দি গান বাজে কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে৷
৪. ঢাকা নগরের তরুণ-তরুণীরা এক ধরনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে উঠছে৷ তারা ফুটবল-ক্রিকেট খেলে স্ক্রিনে৷ চোখ সরায় না স্মার্টফোন থেকে৷ তরুণদের একটা অংশ সারারাত জেগে ফোনে কথা বলে৷ সারাদিন বা দিনের অর্ধেকটা সময় ঘুমায়৷ তরুণ-তরুণীদের বাইরে বের হয়ে কোথাও যাওয়া মানে রেস্টুরেন্টে যাওয়া৷ রেস্টুরেন্টে গিয়ে আলো-আঁধারীতে বসে খাওয়াটাই প্রধান, সঙ্গে দু'একটি কথা৷ ঢাকা শহরের মত এত বিনোদনের অভাবহীন কোনো রাজধানী পৃথিবীতে আছে কিনা সন্দেহ৷ বসবাসের জন্যে নিকৃষ্টতম শহরের তালিকায় ঢাকা দ্বিতীয়৷ তরণ-তরণীদের বিনোদনহীন শহর হিসেবে তালিকা করা হলে, ঢাকার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে৷
৫. বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকার ভয়ঙ্কর কুফলের শিকার হচ্ছে ঢাকার তরুণ-তরুণীরা৷ একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এককোটির বেশি তরুণ জীবন সম্পর্কে হতাশ৷ এদের একটি বড় অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে৷ বাংলাদেশের তরুণরা যে মাদকের প্রতি আসক্ত হচ্ছে, তা সম্ভবত বিরল নজির তৈরি করছে৷ সব মাদকের কম-বেশি ক্ষতি হয়৷ কিন্তু ফেনসিডিল বা ইয়াবার মত ক্ষতিকর মাদকে পৃথিবীর খুব কম দেশের তরুণ-তরুণীরাই আসক্ত৷ বাংলাদেশে এই মাদক চোরাকারবারিরা রাষ্ট্রীয় আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়৷ তরুণদের কথা ভাবার মত কোনো মানুষই যেন সমাজে নেই৷
৬. পৃথিবীর প্রায় সব দেশে একটি সেন্টার থাকে, বিকেল-সন্ধ্যা-রাতে তরুণরা সেখানে সময় কাটাতে পারে৷ ঢাকা নগরে এমন কোনো সেন্টার নেই৷ ছোট আকারে হলেও টিএসসি ছিল তেমন একটি জায়গা৷ বিশ ত্রিশটি সাংস্কৃতিক সংগঠন সেখানে সক্রিয় থাকতো৷ কিন্তু পর্যায়ক্রমে সেই কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷
দেশে ভালো সিনেমা তৈরি হয় না বললেই চলে৷ সিনেমা হলগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে৷ কয়েকটি সিনেপ্লেক্স তৈরি হয়েছে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম৷ সবকিছু মিলিয়ে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, নগর ঢাকায় তরুণদের বিনোদনের সুবিধা অত্যন্ত অপ্রতুল৷ সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয়, তরুণদের বিনোদনের এই বিষয়টি দেশ পরিচালনাকারীদের এজেন্ডার মধ্যেই নেই৷
সূত্র- ডি ডব্লিউ বাংলা

No comments

Powered by Blogger.