শপথের পরেই দল থেকে বহিষ্কার: এমপি পদ টিকবে কী?

দল এবং জোটের নির্দেশনা অমান্য করে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। দলের নির্দেশ অমান্য করে শপথ নেয়ায় গতকালই তাকে বহিষ্কার করেছে গণফোরাম। শপথের পর তার নির্বাচনী এলাকায় (মৌলভীবাজার-২) মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। শপথ নেয়ার পর গতকালই সংসদ অধিবেশনে যোগ দেন ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মনসুর। ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের বিষয়ে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেছেন, বিরোধী জোটের হয়ে তিনি বিজয়ী হলেও জয় বাংলা এবং বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে আপস নেই। এদিকে শপথের পর দল থেকে বহিষ্কার হওয়ায় এখন এমপি পদে থাকতে পারবেন কিনা এ নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দল বহিষ্কার করায় এখন তিনি আর এমপি পদে থাকতে পারেন না। আবার কেউ কেউ বলছেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে অতীতে এমপি পদ থাকার রেকর্ড আছে। তাই সুলতান মনসুরও সংসদ সদস্য থাকতে পারবেন।
গতকাল বেলা ১১টার পর সংসদ সচিবালয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে শপথ নেন সুলতান মনসুর। শপথ নেয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের জানান, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতাকে জানিয়েই তিনি শপথ নিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত বাকি সাত সদস্যকেও শপথ নেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমি ছাড়া ঐক্যফ্রন্টের আরো যারা নির্বাচিত হয়েছেন, তারা সংসদে এসে জনগণের পক্ষে কথা বলুন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত ঐক্যফ্রন্ট নেবে। আমি এ কথা বলতে পারি যে, আমি যা করেছি তা আমাদের দলের শীর্ষ নেতার নলেজে করেছি। আমি এর আগেও সংসদ সদস্য ছিলাম। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ জেনে-বুঝেই শপথ নিয়েছি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের গণশুনানির বিষয়ে এ নেতা বলেন, আমরা ৮ জন জয়ী হয়েছি। বাকি ২৯২ আসনে তারা একটি মিছিলও বের করতে পারেনি। তারা জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারলে হয়তো আরো অনেকেই জয়ী হতে পারতো।
গণফোরাম থেকে বহিষ্কার: দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে একাদশ সংসদের সদস্য হিসেবে শপথ নেয়ায় সুলতান মোহাম্মদ মনসুরকে গণফোরামের স্টিয়ারিং কমিটিসহ প্রাথমিক সদস্য পদ থকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল বিকালে গণফোরামের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সিনিয়র নেতাদের বৈঠক শেষে দলটির সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টু সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, দলীয় শৃঙ্খলা বিরোধী ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আদর্শবিরোধী কাজ করায় সুলতান মোহাম্মদ মনসুরকে গণফোরাম থেকে বহিষ্কার করা হলো।
সেই সঙ্গে তার দলীয় প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হলো। তিনি জানান, সুলতান মনসুরের বহিষ্কারের চিঠি স্পিকার বরাবর পাঠানো হবে। সেই সঙ্গে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। মন্টু বলেন, দল বহিষ্কার করায় সংবিধান অনুয়ায়ী সুলতান মোহাম্মদ মনসুর সংসদ সদস্য থাকতে পারবেন না। অন্যদিকে সুলতান মোহাম্মদ মনসুরকে বহিষ্কারের বিষয়ে গণফোরামের পক্ষ থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৩০শে ডিসেম্বর ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে দেশব্যাপী প্রশাসনের সিলমারা ভোটে যে তামাশার জাতীয় সংসদ নির্বাচন নামীয় জাতীয় কলঙ্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার মধ্যেও আপনি বিজয়ী হওয়ায় দল এবং ঐক্যফ্রন্ট আপনাকে আগেই অভিনন্দন জানিয়েছে। প্রহসন, নির্বাচনী তামাশা এবং প্রতারণার কারণে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মোতাবেক এই নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে, যা আপনি অবহিত। প্রহসন ও ভোট ডাকাতির এই নির্বাচনে সৌভাগ্যবান বিজয়ী ঐক্যফ্রন্টের ৮ জন নির্বাচিত সংসদ সদস্যের অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে ঐক্যফ্রন্টভুক্ত সকল দল আলাদা ভাবে এবং ঐক্যফ্রন্ট-এর স্টিয়ারিং কমিটি সর্বসম্মতভাবে পরবর্তী সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত নির্বাচিত ৮ জন সংসদ সদস্য শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যা আপনি অবহিত রয়েছেন।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা-কর্মীদের নামে অসংখ্য গায়েবি মামলা, গ্রেপ্তার, কারাবরণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, আহত নিহত, নেতাকর্মীদের মুক্তি বা মামলার ফয়সালা হয়নি এবং ৩০শে ডিসেম্বরের প্রহসনের নির্বাচন বাতিল করে অবিলম্বে নতুন নির্বাচন ইত্যাদি জাতীয় সংকট প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীনদের কোনো উদ্যোগ না থাকা সত্ত্বেও আপনি শপথ গ্রহণ করেছেন যাতে দেশের মানুষ চরম হতাশ এবং বিক্ষুব্ধ। আমাদের দল গণফোরাম এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মনে করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ভোটের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে পদদলিত করে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়ে আপনি  নৈতিকতাবিরোধী, জনবিরোধী এবং সংসদীয় রীতি বিরোধী কাজ করেছেন। অতএব, আপনার বিরুদ্ধে দলের নীতিবিরোধী, আদর্শবিরোধী, জনবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে আপনার গণফোরামের প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিল করা হলো এবং গণফোরাম থেকে বহিষ্কার করা হলো। একইসঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো।
এমপি হিসেবে টিকতে পারবেন?
গতকাল শপথ নিলেও দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ায় সুলতান মনসুরের এমপি পদ থাকার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, গণফোরামের দুই নেতার ক্ষেত্রে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু দল থেকে বহিষ্কার হলে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ ও আরপিওর ১২(১) বিধি অনুযায়ী তাদের এমপি পদ থাকবে না। বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিষয়টি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে, তা এখন দেখার বিষয়। তিনি বলেন, যে দল তাদের (সুলতান-মোকাব্বির) মনোনয়ন দিয়েছে, সেখান থেকে বহিষ্কৃত হলে সংসদে এ দু’জনের অবস্থান কোথায় হবে? এখন অন্য দলে যোগ দেয়ার বা স্বতন্ত্র এমপি হয়ে থাকার সুযোগও নেই। কারণ, স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার শর্ত তারা পূরণ করেননি।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এ বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, দল কোনো সংসদ সদস্যকে বহিষ্কার করলে তার সদস্য পদ কি হবে এটার উত্তর সরাসরি আমাদের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে নেই। ৭০ অনুচ্ছেদে দল থেকে পদত্যাগ অথবা দলের বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার কথা বলা আছে। বহিষ্কারের বিষয়টি নিয়ে মামলা হলে তখন উচ্চ আদালত এ বিষয়ে নির্দেশনা দিতে পারেন। তবে আমার ধারণা শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা দাঁড়াবে পদত্যাগ ও বহিষ্কার শব্দটা সমর্থক কিনা। হাইকোর্ট হয়তো এটাই বলবেন যে, দল থেকে পদত্যাগ করা আর বহিষ্কার করা সমর্থক। তাহলে এই বিবেচনায় তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। তবে হাইকোর্ট কি বলবেন সেই সিদ্ধান্তের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
কারণ বহিষ্কারের ব্যাপারটা ৭০ অনুচ্ছেদে বলা নেই।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, সংবিধান ও আরপিও’র আইনে বহিষ্কার হওয়ার পর সংসদ সদস্য পদ বাতিল হবে কিনা সেটা অস্পষ্ট আছে। এক্ষেত্রে অতীতের উদাহরণের উপর সংসদ সদস্য পদ থাকা না থাকা নির্ভর করতে পারে। আর অতীতের উদাহরণ হলো দুই একজন এমপি বহিষ্কার হওয়ার পর তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়নি। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, গণফোরাম থেকে সুলতান মোহাম্মদ মনসুরকে বহিষ্কার করায় তার সংসদ সদস্য পদে কোনো প্রভাব পড়বে না। সংবিধান অনুযায়ী তার সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকবে। এর ব্যাখ্যায় শফিক আহমেদ বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যদি কোনো সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেন বা ইস্তফা দেন অথবা দলের বিপক্ষে ভোট দেন তাহলে তার পদ শূন্য হবে।
সংসদে যা বললেন সুলতান মনসুর
এদিকে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে অংশ নিয়ে ৭ই মার্চের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে সুলতান মনসুর বলেন, অপ্রিয় হলেও সত্য আজকে সংসদে যারা আছেন তারা এক জোটের পক্ষ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। আমিই বোধহয় একজন নীলমনি যে বর্তমানে আপাতত জোটের বাইরে অন্য জোট থেকে নির্বাচিত হয়েছি। এবং শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমি সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মৌলভাবাজর-২ আসনের কুলাউড়া মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে এখানে এসেছি।
সরকার প্রধান হিসেবে আজকে সংসদ নেত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি বলেন, নির্বাচনে অন্তত আমার নির্বাচনী এলাকায় কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। অন্য এলাকায় কি ঘটেছে জানি না। অন্যরা তাদের বিবেকের আদালতে তারাই বলতে পারবেন। সুলতান মনসুর বলেন, আজকে আমারও কিন্তু ওইখানে থাকার কথা ছিলো। অর্থাৎ যদি ওই জোটের পক্ষ হয়ে রাজনীতি করতাম। আজ থেকে ১৮ বছর আগে এই সংসদে আমার আসার সুযোগ হয়েছিলো। আপনি (স্পিকার) যে আসনে বসে আছেন ওই আসনে বসেছিলেন মরহুম আলহাজ হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। আর ছিলেন আজকের প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ সাহেব। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, রাজনীতির ছন্দপতনের কারণে হয়তো আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় আমি একটি রাজনৈতিক কারাগারের মধ্যে ছিলাম।
গত ১৮ বছরে যদিও আমি এমপি ছিলাম না বা এইখানে ছিলাম না তবে আমি রাজনৈতিকভাবে চিন্তার দিক দিয়ে নিষ্ক্রিয় ছিলাম না। আর যে বিশ্বাস নিয়ে আজ ৭ই মার্চ যাকে নিয়ে আলোচনা ১৯৬৭-৬৮ সালে স্কুল ছাত্র থাকা অবস্থায় যাকে ঘিরে, যার স্লোগান দিয়ে রাজনীতি জীবন শুরু করেছিলাম- পদ্মা, মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা, জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো, মিথ্যা অসত্য ষড়যন্ত্রমূলক মামলা মানি না মানবো না। সেই জায়গা থেকে সেই বিশ্বাস থেকে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিচ্যুত হয়নি। যদিও জোটগতভাবে বা রাজনৈতিকভাবে বর্তমানে হয়তো আমার নেতাদের সঙ্গে ওই জোটে নাই। কিন্তু আজ থেকে ৫২ বছর আগে যে বিশ্বাস নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছিলাম, সেই বিশ্বাসের জায়গা থেকেই আমি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মাধ্যমে নির্বাচন করে আপনাদের সকলের দোয়াতে এই জাতীয় সংসদে এসেছি।
তিনি বলেন, আমি নিজেকে আজকে এইভাবে সম্মানিত বোধ করি-জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙ্গালীদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন সেই ৭ই মার্চে শপথ নিতে পেরেছি। অনেকের মনঃপূত বক্তব্য হয়তো আমি আজকে না রাখতে পারি তবে আশা করবো আপনার (স্পিকার) কাছে মহাজোটের বিরোধী একজন অন্য জোটের ব্যক্তি হয়ে যাতে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারি, জনগণের কথা বলতে পারি, বাংলার মানুষের কথা বলতে পারি, সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলতে পারি। এবং বঙ্গবন্ধু যে কথা বলেছেন যে জনগণই ক্ষমতার উৎস সেই জনগণের স্বার্থে কথা বলে যাতে সারাজীবন রাজনীতি করতে পারি সেই শেল্টার পাবো বলে আশা করি। সেই সহযোগিতা পাবো বলে আশা করি। এমনকি সংসদ নেত্রীও সেই বিষয়টি বিবেচনায় রাখবেন মনে করি।   এখানে ৯৯ পার্সেন্ট হচ্ছে এক জোটে আর আমি অন্য জোট থেকে এসে রাজনীতি করছি। তবে জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু এই প্রশ্নে কোনো আপস নেই। সুলতান মনসুর বলেন, সংসদ নেত্রী বলেছেন জাতীয় ঐক্যের কথা। আজ সেই ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। সুলতান মনসুর প্রায় সাড়ে ১১ মিনিটের বক্তব্য শেষ করেন জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বলে।

No comments

Powered by Blogger.