কারাফটকে যে চিত্র নিত্যদিনের by মারুফ কিবরিয়া

শুক্রবার সকাল ১০টা। কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকে জটলা। উদ্দেশ্য কারাগারে বন্দিদের সঙ্গে দেখা করা। কারো মা, কারো বোন, ভাই, বাবা কিংবা স্ত্রী এসেছেন দেখা করতে। ঢাকা ও আশেপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা এই স্বজনরা সকাল থেকেই লাইন ধরেন স্লিপ নেয়ার জন্য। লম্বা সারিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর মেলে কাঙ্ক্ষিত স্লিপ। স্লিপ পেয়ে আবার যেতে হয় মূল ফটকে। সেখানে কারারক্ষীদের কাছে স্লিপ জমা দিলে কিছু সময় অপেক্ষার পর বন্দি থাকা মানুষটি আসেন স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে।
তবে এক্ষেত্রেও ফটকের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার ভিড়টা তুলনায় বেশি থাকে। এদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে। স্লিপ সংগ্রহ করার সারিটাও বেশ দীর্ঘ হয়। পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা সারির ব্যবস্থা রয়েছে নতুন কেন্দ্রীয় কারাগারে। মাঝে মাঝে এই ভিড় বেশি হয়ে গেলে তা সামাল দিতে গিয়ে খানিকটা বেগ পেতে হয় কারারক্ষীদের। অবশ্য, দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনেক দর্শনার্থীও খুব বিব্রত হন। তাতেও যখন স্লিপ পেয়ে বন্দি থাকা স্বজনের সঙ্গে একবার দেখা করে কথা বলতে পারেন তখন প্রাণটাই ভরে যায়। প্রিয় মানুষের সঙ্গে দেখা করে অনেকেই হাসিমুখে বাড়ি ফেরেন। তবে অনেককে কান্নায় ভেঙে পড়তেও দেখা যায়।
বিশেষ করে কারাবন্দি সন্তানকে দেখতে এসে অনেক মা-ই ধৈর্যহারা হয়ে পড়েন। দেখা করার নির্দিষ্ট সময় শেষে বেরিয়ে আসার পরও কারাগার প্রাঙ্গণ ছেড়ে যেতে চান না মা। এমন চিত্রও চোখে পড়ে কেরানীগঞ্জের কারাগারে। শুক্রবার সকালে জামালপুর থেকে এসেছিলেন হেনা নামের এক নারী। কারাফটকের সামনে হাউ মাউ করে কাঁদছিলেন। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ছেলের নাম হাবিব। দুই সন্তানের বাবা। নভেম্বর মাসে ঢাকায় বোনের বাসায় বেড়াতে আসছিল। মুড়ি কিনতে বাসা থেকে বের হলে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর খুঁজে পাইনি। হেনা জানান, নির্বাচনের আগে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে ঘটে যাওয়া পুলিশ-বিএনপির সংঘর্ষে গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় হাবিবকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। হাবিব জামালপুরেই থাকেন। তার মা হেনা বলেন, আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করে না। বাড়িতে থাকে। বোনের বাড়িতে বেড়াতে আসছিল। পুলিশ শুধু শুধু মামলা দিয়েছে। তিনি জানান, গ্রেপ্তারের পর গত তিন মাস ধরে কেরানীগঞ্জ কারাগারেই আছেন হাবিব।
কারাফটকে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন আরো একজন। তার নাম আবিদ উল্লাহ। তিনি জানান, তার ভাইয়ের নাম আদু। সদ্য শেষ হওয়া জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। আবিদ উল্লাহ বলেন. ‘আমার ভাইকে মামলা দেয়ার বয়সই হয়নি। সে এখনো অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। তাকে আটক করে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ছোট ভাইয়ের জামিন নিয়েও প্রতিদিন এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন. প্রতিদিন কত নেতার কাছে ঘুরি। কোনো কাজ হয় না। একটা অবুঝ ছেলে সে মামলার কি বুঝে। উকিল ধরছি, এখনো জামিন কবে পাইবো জানি না।’
সৈয়দপুর থেকে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন আব্দুর রশিদ। তার ছেলের নাম আজগর। নারী নির্যাতন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে গত এক মাস ধরে কারাভোগ করছেন বলে জানান আব্দুর রশিদ। সত্তরোর্ধ্ব এই পিতা বলেন, আমার সাত ছেলের মধ্যে আজগর চতুর্থ। বাড়ির পাশের একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। আজগর বিয়েও করতে চায়। কিন্তু মেয়ের বোন মাঝে একটা ঝামেলা করে আমার ছেলেকে নারী নির্যাতন মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। এরপর পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। এই বয়সে নির্দোষ ছেলেটা জেল খাটছে। এসব সহ্য হয় না। সেই সৈয়দপুর থেকে ঢাকায় আসছি। এখানে এত ভিড়, খুব কষ্ট হচ্ছে।  কেন্দ্রীয় কারাগার প্রাঙ্গণে গেলে প্রতিদিনই এমন অনেক বাবা, অনেক মায়ের আহাজারির চিত্র দেখা যায়।
বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে এসে অনেকেই প্রতারক চক্রের ফাঁদেও পড়েন। তবে এক্ষেত্রে কারাগারের প্রধান ফটক থেকে শুরু করে ভেতরের বিভিন্ন জায়গায় ফেস্টুন আকারে সতর্ক বার্তা দিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। সেটা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন। রাফসানা এসেছেন স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে। অচেনা এক ব্যক্তি এসে আসামি দ্রুত সময়ে জামিন নিয়ে দেয়ার কথাবার্তা শুরু করেন। এসময় কারারক্ষীরা আসছেন এমনটা দেখতে পেয়ে দ্রুত সটকে পড়ে ওই প্রতারক চক্রের সদস্য। রাফসানা বলেন, আমি শুরুতে বুঝি নাই। পরে দেখি তার ভাব ভালো না। পুলিশ দেখেই সে আমার সঙ্গে আর কথা বলে নাই। পরে আর ওই লোককে খুঁজে পাইনি।
কারাগারের বাইরের এই পরিবেশ নিয়ে বেশ প্রশংসার কথা শোনা গেলেও বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে আসা স্বজনদের অনেকেই নাখোশ কারা প্রাঙ্গণে স্থাপিত নিত্যপণ্যের দোকানগুলো নিয়ে। বাইরের সাধারণ দোকান থেকে কারাকর্তৃপক্ষের দ্বারা পরিচালিত ওই দোকানের পণ্যের দাম তুলনামূলক বেশিই বলে অভিযোগ অনেকের। আফরোজা নামের এক দর্শনার্থী বলেন, আমরা বাইরে যে জিনিসগুলো নিয়মিত দামে পাই সেখান থেকে এখানে প্রত্যেকটাই ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি। এটা আমাদের জন্য বেশিই হয়ে যায়। বাইরের দোকানের জিনিসের সঙ্গে এখানকার পণ্যের তো কোনো পার্থক্য নেই। তাহলে বেশি কেন?

No comments

Powered by Blogger.