এক বছরে যৌন নির্যাতনের শিকার ৮১২ শিশু -শিশু অধিকার ফোরামের রিপোর্ট

দেশে শিশুর উপর যৌন হয়রানির ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। গত বছর সারা দেশে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৮১২ শিশু। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮৯৪ জন। এ ছাড়া ২০১৮ সালে ২৯৮টি শিশু আত্মহত্যা করেছে। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ২১৩। শিশুদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে ৩৯ দশমিক ৯১ শতাংশ। শিশু নির্যাতনের এই চিত্রকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন মানবাধিকার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, কঠোর আইন  প্রয়োগ নিশ্চিতের মাধ্যমে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব।
গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘শিশু অধিকার পরিস্থিতি ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ)।
প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছরে সারা দেশে ৪৫৬৬ জন শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে অপমৃত্যুর শিকার হয়েছে ২৩৫৪ জন। অর্থাৎ প্রতিমাসে ৩৮০ জন শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে। ২০১৬ সালে শিশু হত্যা কমলেও ২০১৭  ও ২০১৮ সালে বেড়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী বিগত বছরের তুলনায় বাল্যবিবাহের পরিমাণ কমেছে। তবে ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে শিশুদের প্রতি সহিংসতার হার বেড়েছে ১৮.৭৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে বল হয়, শিশুদের আত্মহত্যার কারণগুলো হলো- পারিবারিক কলহ, অভিমান, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, বাল্যবিবাহ, যৌন নির্যাতন-নিপীড়ন ও পর্নোগ্রাফির শিকার হওয়া, প্রেম-ভালোবাসায় ব্যর্থ বা প্রত্যাখ্যাত হওয়া এবং শৌখিন জিনিস কিনে না দেয়া।
শিশু ধর্ষণের পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৭১ শিশু। এর মধ্যে ৯৪ শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে, ২৮ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ৬০ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ধর্ষণের পর অপমান সইতে না পেরে ৬ শিশু আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়া একই বছরে ৪৩ শিশু ইভটিজিং ও ৮৭ শিশু যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির শিকার হয়েছে।
বিএসএএফ প্রতিবছর গণমাধ্যমে ছাপা হওয়া খবরের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করে। এবারের প্রতিবেদনটি ১৫টি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হওয়া শিশু নির্যাতনের খবরের তথ্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
দেশে সামগ্রিকভাবে শিশুহত্যা বেড়েছে উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে হত্যার শিকার হয়েছে ৪১৮ শিশু, যা ২০১৭ সালে ছিল ৩৩৯ জন। অর্থাৎ শিশুহত্যা বেড়েছে ২৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। হত্যার শিকার ৪১৮ শিশুর মধ্যে ৮১ জন শিশু নিখোঁজ হওয়ার পর নিহত অবস্থায় পাওয়া গেছে, ৫৩ জন শিশু বাবা-মায়ের হাতে খুন হয়েছে, ৩১ শিশুকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৬২৭ শিশু এবং পানিতে ডুবে মারা গেছে ৬০৬ শিশু।
শিশু হত্যার কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তুচ্ছ ঘটনা, পারিবারিক সহিংসতা, দাম্পত্য কলহ, যৌতুক, পরকীয়া এবং শত্রুতা-প্রতিশোধের বলি হয়েছে নিরীহ শিশু। এছাড়া দরিদ্র শ্রমজীবী শিশুদের তুচ্ছ কারণে বা চুরির অপরাধে পিটিয়ে নির্যাতন করে মেরে ফেলা ও শিশুকে বিষ খাইয়ে বা গলায় ফাঁস দিয়ে খুন করে বাবা/মায়ের আত্মহত্যার বেশ কিছু ঘটনাও রয়েছে। 
অনুষ্ঠানে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে প্রায় ৪৫ ভাগই শিশু। তাদের ওপর অত্যাচার এবং সহিংসতার ঘটনা আসলেই একটা উদ্বেগের ব্যাপার। আমরা যদি এটার প্রতিরোধ করতে না পারি তাহলে শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর সব জায়গায়ও শিশুদের অধিকার লঙ্ঘন হবে। শিশু অধিকার রক্ষায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। শিশুর অধিকার রক্ষায় কাজ করতে হবে এবং বলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন আলাদা একটি শিশু মন্ত্রণালয়। আমরা ইতিমধ্যে এই বিষয়ে লিখিত প্রতিবেদন দিয়েছি প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
শিশু পরিস্থিতির এই প্রতিবেদন তুলে ধরেন বিএসএএফ’র পরিচালক আবদুস শহীদ মাহমুদ। তিনি বলেন, শিশুদের প্রতি সহিংসতায় বিচারহীনতা এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রতা অব্যাহত আছে। সমাজে শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে আইন করে তা করা সম্ভব নয়। আবার একা সরকারের পক্ষেও তা সম্ভব নয়। সরকারসহ প্রত্যেকের জায়গা থেকেই ভূমিকা রাখা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিএসএএফ’র চেয়ারপারসন খাজা শামসুল হুদা।
উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতিবছর এই ফোরাম গণমাধ্যমে প্রকাশিত শিশু অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে।

No comments

Powered by Blogger.