ভেনিজুয়েলা সংকট: কোন ভূমিকায় সেনাবাহিনী?

নিকোলাস মাদুরোর সরকার ভেনিজুয়েলার সেনাবাহিনীর কাজের প্রশংসা করেছে এবং তাদের ক্ষমতা বিস্তৃত করেছে। কিন্তু বিরোধীদের দাবি সেনাবাহিনী যেন দেশটির সংবিধানের প্রতি অনুগত থাকে।
ভেনিজুয়েলার ভবিষ্যৎ দেশটির সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের দ্বারা কতটা নিয়ন্ত্রিত হয়?
গত ২৫ বছরে ভেনিজুয়েলায় তিনবার অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছে - এবং সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেশটি তার সবচেয়ে খারাপ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
এ কারণে এখন সবার দৃষ্টি ভেনিজুয়েলার সেনাবাহিনী দিকে।
এই সেনাবাহিনী কি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর প্রশাসনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে, নাকি এটি পক্ষ পরিবর্তন করে বিরোধী দলের নেতা এবং স্ব-ঘোষিত অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট জুয়ান গুয়াইদোকে সমর্থন দেবে?
মাদুরো বলেছেন যে তিনি ভেনিজুয়েলার একমাত্র বৈধ প্রেসিডেন্ট।
যুক্তরাষ্ট্র দেশটির বিরোধী দলীয় নেতা গুয়াইদোকে অন্তর্বর্তীকালীন নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর মাদুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেন।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো লোপেজ প্রেসিডেন্ট মাদুরোর প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে সব ধরণের সন্দেহকে উড়িয়ে দিলেও মাদুরোর ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
মিস্টার গুয়াইদোর সেনাবাহিনীকে পক্ষ বদলানোর যে আহ্বান জানিয়েছিলের কার তীব্র নিন্দা জানান প্রতিরক্ষামন্ত্রী লোপেজ।
এক টুইটার বার্তায় তিনি বলেন, "যিনি সন্দেহজনক স্বার্থ হাসিলের জন্য আইন বহির্ভূতভাবে নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তাকে দেশের সেনারা কখনোই প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেবে না।
সরকারের শক্তিশালী বন্ধন
প্রেসিডেন্ট মাদুরোর মন্ত্রীসভার প্রায় এক তৃতীয়াংশ জুড়েই রয়েছেন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তা।
যদিও ভেনিজুয়েলার সংবিধানে সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনীতির বাইরে রাখার কথা বলা আছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী পাদ্রিনো লোপেজও সেনাবাহিনীর কর্নেল হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন।
২০০২ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সময় হুগো শ্যাভেজ সরকারের প্রতি অনুগত ছিলেন তিনি।
একটি সরকারি প্রজ্ঞাপন প্রচারের কারণে তিনি বেশ পরিচিতি পেয়েছেন।
সেখানে তিনি বলেছিলেন "শ্যাভেজ এখনও বেঁচে আছেন। তার মাতৃভূমি এগিয়ে চলছে। স্বাধীন ও সমাজতান্ত্রিক মাতৃভূমি।"
পাদ্রিনো লোপেজ যৌথ বাহিনীর প্রতিরক্ষা প্রধান হিসেবে এবং পরে দেশটির সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান।
এরপর ২০১৪ সালে মাদুরো তাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন।
তার ক্যারিয়ারের অগ্রগতি অন্যান্য উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের মত ভিন্ন নয় - তার মতো শীর্ষ কর্মকর্তাদের আনুগত্য ভেনিজুয়েলার ভবিষ্যৎ নেতা নির্ধারণ করতে পারে।সরব উপস্থিতি
পক্ষ বদলানোর ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর জন্য কোন বিষয়টি প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে?
প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ ১৯৯৯ সালের সংবিধানে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা বাড়িয়েছেন এবং রাজনীতিতে তাদের পথ তৈরি করে গেছেন।
যেখানে তাদের ভূমিকা শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তায় সীমাবদ্ধ থাকবেনা। এর চাইতে আরও বেশি কিছু হবে।
বর্তমানে ভেনিজুয়েলা উচ্চ মুদ্রাস্ফিতি ও ঘাটতিতে ভুগছে। এ অবস্থায় দেশটির সেনা সদস্যদের ওপর নানা দায়িত্ব আরোপ করা হয়েছে।
যেমন: সাধারণ মানুষের মধ্যে তেল, চাল, কফিসহ অন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী বিতরণ, সেইসঙ্গে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সংশ্লিষ্ট পণ্য যেমন টয়লেট পেপার, স্যানিটারি টাওয়েল, ন্যাপি ইত্যাদি বিতরণেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বিক্ষোভ কর্মসূচি বা খাদ্য লুটপাটের অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের শাস্তি সামরিক ট্রাইব্যুনাল দ্বারা বিচার করা হয়। সরকারের এমন পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে নাগরিক অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত এনজিওগুলো।
কারাকাসের সিমন বলিভার ইউনিভার্সিটির পলিটিকাল সায়েন্সের অধ্যাপক এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ হার্নান ক্যাস্তিলো বলেন, "দৈনন্দিন সমাজে সেনাবাহিনী, এর আগে এতোটা সরবভাবে উপস্থিত ছিল না।"
সামরিক শক্তি
প্রেসিডেন্ট মাদুরো পরবর্তীতে সামরিক শক্তি ও রাজনীতিকে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে দেন।
আলকালা বলেছেন " দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় উন্নয়নে সশস্ত্র বাহিনী আগের চেয়ে বেশি সম্পৃক্ত হয়েছে।"
সাবেক সেনা কর্মকর্তা ক্লিভর আলকালা প্রয়াত নেতা শ্যাভেজের সমর্থক হলেও তিনি মাদুরো সরকারের সমালোচনা করেন।
তিনি বলেন, দেশের প্রশাসন ও অর্থনীতির বড় অংশ সামরিক প্রশাসনের দায়িত্বে চলার বিষয়টি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
"মাদুরো সশস্ত্র বাহিনী ও সেনাবাহিনীর প্রধানের উপর অত্যধিক নির্ভর হয়ে পড়ায় তিনি রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের সমর্থন হারিয়েছেন।
এ অবস্থায় তিনি ক্ষমতায় থাকার জন্য সমর্থন পেতে সামরিক বাহিনীর কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন"। জানান আলকালা।সেনাবাহিনীর মধ্যেই অসঙ্গতি
শীর্ষ সামরিক নেতারা এখনো প্রেসিডেন্ট মাদুরোর কাছাকাছি থাকতে পারে। তবে সেনাবাহিনীর নিচু স্তরের সাথে তার সম্পৃক্ততা এতোটা নেই।
দেশের অন্য সকলের মতো সমস্ত সামরিক সদস্যদেরও ভেনিজুয়েলার অর্থনৈতিক সংকট সহ্য করে চলতে হয়েছে।
তবে সেনাবাহিনীর উচ্চ-পদের কর্মকর্তাদের চাইতে এই নিচু পদের কর্মকর্তারা জ্বালানি, খাদ্যের অভাব এবং তীব্র মুদ্রাস্ফীতি সংকটের শিকার হয়েছে বেশি।
এ কারণে তাদের মধ্যে অসন্তোষ বেড়েই চলছে।
চলতি সপ্তাহের বিক্ষোভের সময়ে, সৈন্যদের একটি অংশকে দেখা যায় বিক্ষোভকারীদের দমন করার পরিবর্তে তাদের সমর্থন দিতে।
সাম্প্রতিক মাস গুলোয়, সশস্ত্র বাহিনীর শতাধিক সদস্যকে বিশ্বাসঘাতকতা, বিদ্রোহ, লুটপাট আর পক্ষ-ত্যাগের অভিযোগে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
আলকালা বলছেন, সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যন্তরে অনিশ্চয়তা আর অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে: গত বছর তিন সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়। পরে তারা কলম্বিয়া পালিয়ে গিয়ে সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চান।
এতদূর পর্যন্ত, ভেনিজুয়েলার সশস্ত্র বাহিনী মাদুরোর পক্ষেই আছে। - তার প্রতি আনুগত্য দেখানোয় আনুমানিক ১৬ হাজার ৯শ সৈন্যকে পদন্নোতি দেয়া হয়েছে। যদিও তারা দেশটির বর্তমান সংকটের মূল হোতা।
সূত্রঃ বিবিসি

No comments

Powered by Blogger.