সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যকার ঐক্য সবচেয়ে জরুরি

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয় লাভের জন্য সন্ত্রাসীদের শেকড় উপড়ে ফেলা এবং তাদের অর্থের যোগান বন্ধ করে দেয়া জরুরি। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধের এখনো অবসান ঘটেনি এবং হুমকি রয়ে গেছে। এ অবস্থায় এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতির প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলীর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমেরিকার নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টির জন্য উগ্র সন্ত্রাসীদেরকে ব্যবহারের চেষ্টা করছে যাতে এ অঞ্চলের মুসলিম দেশগুলোকে ভেঙে টুকরো টুকরো করা যায় এবং রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বর্তমানে সন্ত্রাসবাদের এমন ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে যে একে মোকাবেলা করতে হলে শুধু আঞ্চলিক ঐক্য নয় একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পারস্পরিক সহযোগিতা ও চেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে। সন্ত্রাসবাদের এই অভিন্ন হুমকি মোকাবেলায় ইরান তার প্রতিবেশী সব দেশকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে। ইরাক ও সিরিয়ায় উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয় প্রমাণ করেছে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এ অঞ্চলে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করার জন্য ২০১৫ সালে ইরান, রাশিয়া, সিরিয়া ও ইরাক চারপক্ষীয় কমিটি গঠন করে। এই চারটি দেশের নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইরাকের রাজধানী বাগদাদে। এই কমিটির বিশেষজ্ঞরা গত কয়েক বছরে পরস্পরের সঙ্গে তথ্য বিনিময় ও নিরাপত্তা সহযোগিতার মাধ্যমে ইরাক ও সিরিয়ার অভিন্ন সীমান্ত এলাকায় সন্ত্রাসীদের তৎপরতা ও গতিবিধি চিহ্নিত করেছে। এই দেশগুলোর যৌথ সামরিক অভিযানে এ পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের বহু ঘাঁটি ধ্বংস হয়েছে, শত শত সন্ত্রাসী নিহত এবং ইরাক ও সিরিয়ায় দায়েশ সন্ত্রাসীদের প্রভাব ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ এই দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতায় এ অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঠেকানো গেছে। গত বছর ডিসেম্বর রাশিয়ার সোচি শহরে ইরান, তুরস্ক ও রাশিয়ার শীর্ষ নেতাদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ দমনের বিষয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ত্রিদেশীয় ওই বৈঠকে ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেছেন, "মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে ইরানের নীতি হচ্ছে, পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করা কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা নয়, পারস্পরিক ঐক্য ও সমন্বয় করা কোনো বিভাজন নয়, জাতিগুলোর ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো কোনো বিদেশিদের অনুসরণ করা নয় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কোনো সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করা ইরানের উদ্দেশ্য নয়।"  সোচি বৈঠকে ইরানের প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, "ইসলামি ইরানই ছিল প্রথম দেশ যে কিনা সন্ত্রাসীদের মোকাবেলায় সিরিয়ার সরকার ও জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমরা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং এ ব্যাপারে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে সহায়তা করতে তেহরান প্রস্তুত।"
যাইহোক, ইরান জাতিসংঘের নীতিমালা অনুসরণ করে চলে এবং সে অনুযায়ী আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য সহযোগিতামূলক সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইরাক ও সিরিয়ার সেনাবাহিনী ইরানের সামরিক উপদেষ্টাদের সহযোগিতায় এবং রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে দায়েশ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিরাট বিজয় অর্জন করেছে।    
ইরানের সংসদ মজলিশে শুরায়ে ইসলামির প্রধান আলী লারিজানি গত বছর পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে "সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় চ্যালেঞ্জ ও আঞ্চলিক সহযোগিতার ভূমিকা" শীর্ষক বৈঠকে ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের আত্মপ্রকাশ এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের দাবির আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি প্রশ্ন করেন আমেরিকা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের দাবি করলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সন্ত্রাসবাদ কমেছে নাকি বেড়েছে? জনাব লারিজানি বলেন, আমেরিকা সামরিক জোট গঠন করে আফগানিস্তান থেকে সন্ত্রাসীদের উৎখাত করা এবং মাদক চাষ ও উৎপাদন বন্ধে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে দাবি করেছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, এর কোনো কিছুই আমেরিকা করেনি বরং আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটেছে এবং রমরমা মাদক ব্যবসা চলছে। এমনকি এসব মাদক ব্যবসার সঙ্গে খোদ মার্কিনীরাই জড়িত।
ইরানের পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির প্রধান ড.কামাল খাররাজি এ ব্যাপারে বলেছেন, "মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নিরাপত্তা আজ হুমকির সম্মুখীন এবং এ সংকটকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ এ অঞ্চলের দেশগুলোর জাতীয় নিরাপত্তা সংকট সামগ্রীকভাবে এ অঞ্চলের সবার জন্য অভিন্ন হুমকি।"
যাইহোক, ইরান সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও রাশিয়াসহ প্রতিবেশী সব দেশের সঙ্গে সহযোগিতা বিস্তারের নীতিতে বিশ্বাসী। বাস্তবতা হচ্ছে, সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদ শুধু আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক কিংবা সিরিয়ার জন্যই হুমকি নয় বরং তা গোটা বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। খ্যাতনামা মার্কিন বিশ্লেষক জেফরি সাকেস এক নিবন্ধে লিখেছেন, দায়েশ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয় এতো সহজ কাজ নয়। কারণ তাদের সদস্য সংখ্যা অনেক এবং আমেরিকা ও তার মিত্ররা দায়েশকে প্রধান সহযোগী ও বন্ধু বলে মনে করে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, যেসব দেশ ইরাক ও সিরিয়ার জনগণের ওপর জুলুম নির্যাতন চালানো ও নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য দায়েশ সৃষ্টি করেছিল এদের পতনের পর তারাই দায়েশকে আফগানিস্তানে পাঠাচ্ছে।
ইরান মনে করে, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নির্ভর করছে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যকার ঐক্য ও সংহতি জোরদারের ওপর। গত কয়েক দশক ধরে পাশ্চাত্যের নানা ষড়যন্ত্রের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। একদিকে, এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য আমেরিকা ব্যাপক সামরিক হস্তক্ষেপ করছে অন্যদিকে এ অঞ্চলের সহিংসতা বিশ্বের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। খ্যাতনামা মার্কিন চিন্তাবিদ নওম চমস্কি প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর প্রশ্ন করেন আমেরিকা কি আদৌ চায় সন্ত্রাসবাদের অবসান ঘটুক? তিনি বলেন,  আমরা যদি সন্ত্রাসবাদের অবসান ঘটাতে চাই তাহলে সন্ত্রাসী হামলা কেন ঘটছে, এর কারণগুলো কি এবং এদের পেছনে কারা মদদ দিচ্ছে সেসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে।
ইরানের পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির প্রধান কামাল খাররাজি বলেছেন, "এ অঞ্চলে কারা নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে রেখেছে তা খুঁজে দেখতে হবে। ইরান যদি সন্ত্রাস কবলিত ইরাক ও সিরিয়াকে সহযোগিতা না করত তাহলে বাগদাদ ও দামেস্ক এতোদিনে দায়েশ সন্ত্রাসীদের দখলে চলে যেত এবং সমগ্র এ অঞ্চলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতো।" কামাল খাররাজি প্রশ্ন করেন, বাগদাদ ও দামেস্কের যদি পতন ঘটত তাহলে কি আজ ইউরোপ নিরাপদে থাকতে পারত?
সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার ক্ষেত্রে ইরান সবসময়ই প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার ওপর জোর দিয়ে আসছে। এটা কেবল মুখের কথা নয় বাস্তবেও ইরান তার আন্তরিকতার প্রমাণ দিয়েছে ইরাক ও সিরিয়া যুদ্ধে।

No comments

Powered by Blogger.