গোয়েন্দাজাল: হত্যাকারীদের এলিট গ্রুপ মোসাদ by মোহাম্মদ আবুল হোসেন

চারপাশে বিছানো অদৃশ্য এক জাল। তা দিয়ে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে প্রতিজন মানুষের গতিবিধি, কর্মকা-। অথচ সেই মানুষটি এর কিছুই বুঝতে পারছেন না। অকস্মাৎ সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাসোগির মতো নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। তাদের সবার খবর পত্রিকার পাতায় আসে না। পৃথিবীর মানুষ জানতেও পারে না। জলজ্যান্ত মানুষ বাসা থেকে বের হয়ে আর কখনো ফিরে আসেনি। এমন অসংখ্য নজির আছে।
এর অনেকটার সঙ্গে জড়িত এক অদৃশ্য জাল। সেই জাল গোয়েন্দাজাল। তাতে ধরা পড়ে অনেকে জেলে বন্দি। অথবা তাকে ফাঁদে ফেলে বিমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। তাতে চেতনানাশক প্রয়োগ করে মেরে ফেলা হয়েছে। এমন অসংখ্য নজির আছে কিছু কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে। এসব নিয়ে নিয়মিত আয়োজন ‘গোয়েন্দাজাল’-এর প্রথম পর্ব প্রকাশিত হলো আজ। আজকের পর্বে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কর্মকা-।
মোসাদ ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের মূল কাজ তিনটি। এক. গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা। দুই. গোপন অপারেশন পরিচালনা করা ও তিন. সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতা। এর সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট কিদোন নামে পরিচিত। হিব্রু ভাষায় মোসাদের পুরো নাম ‘হামোসাদ লেমোদি’ইন উলেতাফকিদিম মেয়ুহাদিম’। এর ইংরেজি অনুবাদ হলো ‘ইনস্টিটিউট ফর ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অপারেশনস’। অর্থাৎ গোয়েন্দা ও বিশেষ অপারেশনবিষয়ক প্রতিষ্ঠান। ইসরাইলের জাতীয় গোয়েন্দা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান এই মোসাদ। ইসরাইলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে এটি প্রধানতম। এ ছাড়া আছে আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংগঠন। এর একটি হলো আমান। অন্যটির নাম শিন বেত। আমান হলো ইসরাইলের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা। শিন বেত হলো অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাবিষয়ক গোয়েন্দা সংস্থা। তবে সরকারি বা সামরিক লক্ষ্য, অবকাঠামো, শক্তির সঙ্গে মোসাদের তুলনা হয় না। কারণ, এ সংস্থাটি ইসরাইলের মৌলিক আইন অনুসরণ করে না। অর্থাৎ, তাদের জন্য রয়েছে আলাদা নীতি। তাদের কাজ হলো গোপন বা সিক্রেট তথ্য নিয়ে কাজ করা। তবে তা কখনোই প্রকাশ করা হয় না। এর পরিচালক সরাসরি গোয়েন্দা তথ্য নিয়ে রিপোর্ট করেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
নির্বাহী অফিস: মোসাদের সবচেয়ে বড় বিভাগ হলো কালেকশন বা সংগ্রহাগার। বিদেশে গুপ্তচর হিসেবে অনেক ইস্যুতে কাজ করে এ শাখা। কালেকশন ডিপার্টমেন্ট কূটনৈতিক বা অনুমোদনহীন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তারা কাজ করে নানা রকম ছদ্মবেশ ধরে। বিদেশি মিত্র-গোয়েন্দা সংস্থা ও দেশের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করার দায়িত্ব রয়েছে এ সংস্থার পলিটিক্যাল একশন অ্যান্ড লিয়াজোঁ ডিপার্টমেন্টের। যেসব দেশের সঙ্গে ইসরাইলের স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই সেখানে এভাবে কাজ করে তারা। এ ছাড়া মোসাদের রয়েছে একটি গবেষণা বা রিসার্স ডিপার্টমেন্ট। তারা কাজ করে গোয়েন্দাদের কাছ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেলো তা উপস্থাপনার বিষয়ে। আছে টেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট নামে একটি বিভাগ। তারা কাজ করে মোসাদের কর্মকা- উন্নত করার জন্য সরঞ্জামের আধুনিকায়ন করাতে।
ইতিহাস: মোসাদের প্রথম পরিচালক ছিলেন রুবেন শিলোয়া। তিনি এ দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত। তার সুপারিশ হিসেবে সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট ফর কোঅর্ডিনেশন নামে ১৯৪৯ সালের ১৩ই ডিসেম্বর প্রথম মোসাদ গঠন করেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গারিয়ন।  সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আমান, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সার্ভিস শিন বেত ও পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক বিভাগের বিদ্যমান নিরাপত্তা সেবাগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা উন্নত করার জন্য একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা গঠন করতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী বেন গারিয়ন। ১৯৫১ সালের মার্চে একটি ঘোষণা দেয়া হলো। তাতে একে স্বীকৃতি দেয়া হলো এবং প্রধানমন্ত্রীর অফিসের অধীনস্ত একটি অংশ বলে ঘোষণা দেয়া হলো। বলা হলো এ সংগঠন সরাসরি রিপোর্ট করবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। 
মোসাদের সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট: সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিটের মধ্যে অন্যতম হলো মোসাদা। এই ইউনিটটি শত্রুদের বিরুদ্ধে আক্রমণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। এটি পরিচালিত হয় যোদ্ধাদের ক্ষুদ্র ইউনিট দিয়ে। তাদের মিশনের মধ্যে রয়েছে হত্যা মিশন চালানো ও সাবোটাজ করা। এ ছাড়া রয়েছে কিদন নামে একটি ইউনিট। এটি সিসারিয়া বিভাগের (এটি হলো মোসাদের আটটি বিভাগের মধ্যে অন্যতম) অধীনস্ত। আমেরিকান বংশোদ্ভূত ইসরাইলি সাংবাদিক ও লেখক, দ্য জেরুজালেম পোস্ট পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ইয়াকভ কাটজ একে বর্ণনা করেছেন এভাবে “এটি হলো বিশেষজ্ঞ হত্যাকারীদের একটি এলিট বা অভিজাত গ্রুপ। গুপ্তচরবিষয়ক সংগঠনের হয়ে সিসারিয়া শাখার অধীনে তারা কাজ করেন। তবে রহস্যময় এই ইউনিট সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি কিছু জানা যায়নি। ইসরাইলি গোয়েন্দা সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোপনীয় গোয়েন্দা তথ্য গোপন অবস্থায় রয়েছে।” ইসরাইলের প্রতিরক্ষাবাহিনীর বিশেষায়িত একটি বিশেষ ইউনিট হলো অভিজাত আইডিএফ। এই ইউনিট থেকে সাবেক সেনা সদস্যদেরকে নিয়োগ করা হয় কিদন ইউনিটে। পরিচালনার জন্য মোসাদ খুলেছে একটি মূলধন বিষয়ক তহবিল। নতুন সব সাইবার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য উচ্চ মাত্রার প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের জন্য এটা করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয় না।
মোসাদের পরিচালকরা
রুভেন শিলোয়া। তিনি ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন পরিচালক হিসেবে।
ইসার হারেল ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
মেইর অমিত পরিচালক ছিলেন ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত।
জভি জমির ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
আইজাক হোফি ১৯৭৩ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন।
নাহুম আদমোনি ১৯৮২ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
শাবতাই শাভিট ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
ড্যানি ইয়তম ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। ইফ্রেইম হালভি ১৯৯৮ থেকে ২০০২ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
মেইর ডাগান ২০০২ থেকে ২০১১ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
তামির পারদো ২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০১৬ থেকে দায়িত্বে অব্যাহত আছেন ইয়োসি কোহেন।

No comments

Powered by Blogger.