প্রশাসনে ক্যাডার বৈষম্য, বাড়ছে ক্ষোভ by শফিকুল ইসলাম

পদোন্নতি ও আচরণ বৈষম্যের অভিযোগে সরকারি কর্মকর্তাদের সাধারণ ২৭ ক্যাডারের মধ্যে ‘প্রশাসন ক্যাডার’ ছাড়া বাকি ২৬ ক্যাডারের প্রায় ৪৬ হাজার কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। পেশাগত বৈষম্য দূর করতে প্রশাসন ক্যাডারের প্রায় পাঁচ হাজার কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে অন্য ক্যাডার সদস্যদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
এ সংগঠনের নেতাদের অভিযোগ— সরকারের উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে আদালতের রায় লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এছাড়া, এই মুহূর্তে জনপ্রশাসনে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সঠিকভাবে বিধি-বিধান ও রীতিনীতি অনুসরণ করা হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, বিসিএস ১৯৮৫ ব্যাচের ক্ষেত্রে পদের অতিরিক্ত পদোন্নতির সুযোগটি এখন সাধারণ রীতিতে পরিণত হয়েছে। অথচ সরকারের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি দেওয়ার বিধান নেই।
প্রশাসনের অন্য ক্যাডারগুলোর ক্ষেত্রে এই বিধান কঠোরভাবে অনুসরণ করা হলেও ‘প্রশাসন ক্যাডার’ এর উপসচিব বা তদূর্ধ্ব পদের ক্ষেত্রে কোনও নিয়মনীতি অনুসরণ করা হচ্ছে না। এছাড়া, প্রশাসনের শীর্ষ পদে অর্থাৎ সচিব বা সিনিয়র সচিব পদে ‘প্রশাসন ক্যাডার’ ছাড়া অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি পাওয়ার সুযোগ কম। চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সমান মর্যাদার পদে যোগদান করতে হয়। তবে শিক্ষা ক্যাডারের শীর্ষ পদের নাম অধ্যাপক হলেও তার পদমর্যাদা প্রশাসন ক্যাডারের যুগ্মসচিবের সমান।
শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালকের একটি মাত্র পদ দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদায় ছিল। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এ পদটি সচিবের পদমর্যাদায় উন্নীত করা হয়েছে। একইভাবে তথ্য ক্যাডারের শীর্ষপদ হচ্ছে প্রধান তথ্য কর্মকর্তা। এটিও অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার ছিল। সম্প্রতি এই পদটিকেও সচিব পদে উন্নীত করা হয়েছে। অথচ প্রশাসন ক্যাডারের সব মন্ত্রণালয় ও দফতরের শীর্ষ পদটি সবসময়ই সচিব পদমর্যাদার ছিল।
উল্লেখ্য, সরকারের জনপ্রশাসনে ইকোনমিক ক্যাডারকে প্রশাসন ক্যাডারে একীভূত করার মধ্য দিয়ে বর্তমানে মোট ক্যাডারের সংখ্যা ২৭টি। এই মুহূর্তে জনপ্রশাসনে উপসচিব পদে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১ হাজার ৩২৪টি। যুগ্মসচিব পদে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ৩৮৪টি। অতিরিক্ত সচিব পদে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১২০টি। সচিব ও সিনিয়র সচিব পদে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ৮৯টি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই মুহূর্তে (বৃহস্পতিবার, ৪ অক্টোবর) সরকারের প্রশাসনে সচিব পদে ৭৮ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৬২১ জন, যুগ্ম সচিব পদে ৭৬৪ জন, উপসচিব পদে ১ হাজার ৫৯৯ জন, সিনিয়র সহকারী সচিব পদে ১ হাজার ৪৬৪ জন কর্মকর্তা বিভিন্ন দফতরে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৭৫ সালে জাতীয় সংসদে অনুমোদিত ‘চাকরি পুনর্গঠন ও শর্তাবলী অ্যাক্ট ১৯৭৫’ অনুযায়ী একই গ্রেডে এবং স্কেলের কর্মকর্তাদের মধ্যে বেতন-ভাতা ও সুবিধার ক্ষেত্রে কোনও বৈষম্য করার সুযোগ নেই। কিন্তু উপসচিব বা তদূর্ধ্ব পদের কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত গাড়ি কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকার ঋণ ও সেই গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার আদেশ জারি করে ওই আইনকে লঙ্ঘন করা হয়েছে বলেও অভিযাগ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোথাও কোনও আইন লঙ্ঘন করা হচ্ছে না। কোনও ক্যাডার বৈষম্য নাই।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘সরকারের সক্ষমতা বেড়েছে, তাই গাড়ির সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এটা নতুন কিছু নয়। পর্যায়ক্রমে অন্যরাও পাবেন।’
তবে ক্যাডার বৈষম্যের বিষয়ে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে বিসিএস ক্যাডারগুলোতে রয়েছে বিবিধ মাত্রার বৈষম্য। কখনও পদোন্নতি বৈষম্য, কখনও কর্তৃত্ব বৈষম্য।’
তিনি বলেন, ‘ক্যাডারভিত্তিক বৈষম্যের নানা ধরন রয়েছে। যেমন ধরা যাক, কোনও এক বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সব ক্যাডারের সব শাখায় কর্মকর্তা নিয়োগ হলো। একই দিনে পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো, আবার একই দিনে তাদের যোগদান হলো। তারা যদি তাদের পদোন্নতির শর্ত পূরণ করেন, তাহলে তাদের একই দিনে পদোন্নতি হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তা হচ্ছে না। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা জটিলতা। যেমন স্বাস্থ্য ক্যাডারের পদোন্নতির জন্য তাদের অতিরিক্ত ডিগ্রি থাকা চাই। একই যোগ্যতা কিংবা চিকিৎসকদের চেয়ে কম যোগ্যতা নিয়ে পদোন্নতি পেয়ে হয়তো কেউ ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদে আসীন হচ্ছেন, আর চিকিৎসকদের হয়তো প্রবেশপদেই সারাজীবন থাকতে হচ্ছে। শিক্ষা ক্যাডারসহ অনেক ক্যাডারের জন্য শুধু বিভাগীয় পরীক্ষা, বুনিয়াদি কোর্স, সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই পদোন্নতি হয়। প্রশাসন ক্যাডার, পুলিশ ক্যাডারসহ কিছু কিছু ক্যাডারে কিছুদিন বেশি প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়। সব ক্যাডারের জন্য যদি আর কোনও উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজন না হয়,তাহলে স্বাস্থ্য ক্যাডারের জন্য কী কারণে অতিরিক্ত ডিগ্রির প্রয়োজন হবে? একইভাবে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তার সমান অথবা বেশি যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসা ক্যাডারদের পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, যা হওয়া উচিত নয়। ২৭টি ক্যাডারের মধ্যে স্বাস্থ্য ক্যাডার একমাত্র ক্যাডার, যেখানে প্রবেশকালীন যোগ্যতার চেয়ে আরও অনেক বেশি ডিগ্রি প্রয়োজন হয় পদোন্নতিতে। অন্য সব ক্যাডারে প্রবেশকালীন যোগ্যতাই তাকে সর্বোচ্চ পদে আসীন করার জন্য যথেষ্ট।’
অধ্যাপক তুহিন বলেন, ‘ক্যাডারগুলোতে পদ শূন্য সাপেক্ষে পদোন্নতি হয়। শুধু নির্দিষ্ট ক্যাডার ধরে নয়, যখন পদোন্নতি হবে তখন সেই বিসিএসের সব কর্মকর্তার পদোন্নতি হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি না হওয়ার কারণে একই ক্যাডারেও চলছে বিশৃঙ্খলা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে উপজেলায় যে প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষি কর্মকর্তা থাকেন, তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অধীনে থাকেন। প্রশাসন ক্যাডারের একজন তরুণ কর্মকর্তা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হন। অন্যদিকে সেই নির্বাহী কর্মকর্তার চেয়ে অনেক সিনিয়র এবং তার চেয়ে মেধায় ও যোগ্যতায় অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও একজন চিকিৎসক, কৃষিবিদ, প্রকৌশলী পদোন্নতি না পেয়ে প্রবেশ পদেই হয়তো থাকেন। জেলা পর্যায়েও একই অবস্থা। এতে করে প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করাটা সম্মানজনক হয় না। এ অবস্থার অবসান না হলে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর হবে না।’
তিনি বলেন, ‘সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চাকরিজনিত যেকোনও সিদ্ধান্তের জন্য যেতে হয় সচিবালয়ে। সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সব ক্যাডারের সিদ্ধান্ত দেন। এতে সব ক্যাডারের যে প্রধান কর্মকর্তা- মহাপরিচালকেরা রয়েছেন, তাদের ক্ষমতাকে ছোট করা হয়। সব মন্ত্রণালয়ের সচিব হওয়া প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের কর্মকর্তার। যেমন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব হবেন একজন কৃষিবিদ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হবেন একজন চিকিৎসক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হবেন একজন শিক্ষাবিদ। এতে সরকারি চাকরির কাজে গতিশীলতা আসবে। একই সঙ্গে স্বাধীনভাবে সব ক্যাডার দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন।’
উল্লেখ্য, বিসিএস ১৩তম ব্যাচের তথ্যসহ অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা যেখানে উপসচিব পদমর্যাদার পদে কাজ করছেন সেখানে একই ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা যুগ্মসচিব পদে দায়িত্ব পালন করছেন তাও এক বছরের বেশি আগে থেকে। অথচ অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির কোনও খবর এই মুহূর্তে নেই।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহম্মদ বলেন, ‘এগুলো নতুন কিছু নয়, দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসছে। তাছাড়া পদোন্নতি পাওয়ার সময় হলে তো তাকে পদোন্নতি দিতে হবে।’

No comments

Powered by Blogger.