সুন্দরী নারী দিয়ে ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদ: বিবস্ত্র করে নির্যাতন, মুক্তিপণ আদায় by শুভ্র দেব

অভিনব কৌশলে প্রতারণা। সুন্দরী নারী দিয়ে তৈরি করা হয় ফাঁদ। সেই ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারাতে হয় ভুক্তভোগীদের। নারীরা নিজেদের বড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেয়। আবার কখনো ব্যবসায়ী-শিল্পপতির মেয়ে-ভাগ্নি দাবি করে। চলাফেরাও করে দামি গাড়িতে। পোশাকে, চলনে থাকে আভিজাত্যের ছাপ। তাদের টার্গেট বিত্তশালীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সখ্য গড়ে তোলে। মোবাইল ফোন নম্বর  সংগ্রহ করে যৌন উত্তেজক কথা বলে। বশে আনার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে। লোভ দেখানো হয় একান্ত আপন করে পাবার। আয়োজন করা হয় ঘরোয়া পার্টির। আমন্ত্রণ জানানো হয় টার্গেট করা ব্যক্তিদের। সেখানে ইয়াবা, মদের আসর বসানো হয়। টার্গেট করা ব্যক্তিকে নেশার জালে ফেলে তারা তাদের প্রকৃত পরিচয় দেয়। মূলত তারা প্রতারক চক্র। একজন নয় একাধিক নারী-পুরুষ এসব প্রতারক চক্রে কাজ করে। নেশায় মত্ত থাকা পুরুষদের বিবস্ত্র করে ছবি তুলে।
এমনকি চক্রের নারী সদস্যরাও বিবস্ত্র অবস্থায় ভুক্তভোগীকে জড়িয়ে ধরে। বিছানায় নিয়ে আপত্তিকর অবস্থায় ভিডিও ধারণ করে। অনেক সময় গোপন ক্যামেরায় দৃশ্য ধারণ করা হয়। ধারণ করা এসব ভিডিও ও ছবি দেখিয়ে পরে ভুক্তভোগীর সঙ্গে করা হয় নানা প্রতারণা। এসব দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে দেয়ার হুমকি দিয়ে হাতিয়ে নেয়া হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। সম্প্রতি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে এরকম একটি প্রতারক চক্রকে গ্রেপ্তার করেছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, বেশ কয়েক মাস ধরে একটি চক্র সমাজের বিত্তশালী লোকদের টার্গেট করে প্রতারণা করছিলো। নারী দিয়ে ফাঁদ তৈরি করে অনেককে করেছে সর্বস্বান্ত। গোপনে ধারণ করা ভিডিও প্রতারক চক্রের কাছে থাকায় মান সম্মানের ভয়ে মুখ খোলে তারা কাউকে কিছু বলতে পারছিলো না। আবার অন্যদিকে দিনের পর দিন প্রতারক চক্রকে টাকা দিতে হয়েছে। একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে এরকম অভিযোগ আসার পর গোয়েন্দারা এ নিয়ে কাজ শুরু করে। কিন্তু কিছুতেই এই প্রতারক চক্রকে আটক করা যাচ্ছিলো না। কারণ তারা একই ঠিকানায় বেশিদিন থাকে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ফাঁকি দিতে একটি বাসায় কিছু মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে অন্যত্র চলে যায়। তাই তাদের অবস্থান শনাক্ত করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এরকম নানা অভিযোগ আসার পর গোয়েন্দা পুলিশের কয়েকটি টিম প্রতারক চক্রকে আটকের জন্য কাজ শুরু করেন।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ লালবাগ জোনের পরিদর্শক মো. শফিকুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, চকবাজার থানার নাজিমউদ্দিন রোড এলাকার দাউদ আহম্মেদ পাভেল নামের এক বাসিন্দা গত ৬ই সেপ্টেম্বর নিখোঁজ হোন। নিখোঁজ হওয়ার পরের দিন পাভেলের মোবাইল ফোন নম্বর থেকে তার স্ত্রীর মোবাইলে ফোন দিয়ে অজ্ঞাতনামা কিছু লোক ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এমনকি টাকা না দিলে তাকে মেরে ফেলার হুমকিও দেয় তারা। পরে পাভেলের পরিবারের পক্ষ থেকে ৭ই সেপ্টেম্বর চকবাজার থানায় একটি জিডি করা হয়। জিডি নিয়ে থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ জোনও কাজ শুরু করে। কিন্তু পাভেলের সন্ধান আর পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে পাভেলের মোবাইল ফোন নম্বর থেকেই টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে অপহরণকারীরা। গোয়েন্দা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, চক্রের সদস্যরা খুবই কৌশলী ভূমিকা পালন করে। তাদের ঠিকানা বা মোবাইল নম্বর আমাদের কাছে ছিল না। শুধু পাভেলের মোবাইল নম্বর নিয়ে আমরা কাজ শুরু করি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যাতে তাদের ঠিকানা শনাক্ত করতে না পারে সেজন্য তারা একাধিক স্থানে মোবাইল নিয়ে ঘুরেছে। এরকম অবস্থায় চক্রের সদস্যরা পাভেলের স্ত্রীকে টাকার জন্য আরো চাপ দিতে থাকে। পাশাপাশি তাকে মেরে ফেলারও হুমকি অব্যাহত রাখে। উপায়ান্তর না পেয়ে তার স্ত্রী আমেনা আক্তার কিছু টাকা দিতে রাজি হোন। প্রতারক চক্র সরাসরি টাকা নিতে রাজি হয়নি। বিকাশের মাধ্যমে কিছু টাকা পাঠানো হয়। সেই টাকা পাঠানোর পরও প্রতারক চক্র আরো টাকা পাঠানোর দাবি করে। পরে আমেনা বেগম চকবাজার থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
যেভাবে প্রতারক চক্র আটক হয়: গত মাসের ১৯শে আগস্ট হাউজিং প্রতিষ্ঠানের এক প্রমোশন কর্মকর্তা এরকম একটি প্রতারক চক্রের কবলে পড়েন। ওই কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশকে জানিয়েছেন, কোম্পানির বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তিনি মোবাইল ফোন গ্রাহকদের মোবাইলে এসএমএস করতেন। সেখানে তার মোবাইল নম্বর উল্লেখ করা থাকতো। প্রতারক চক্রের নারী সদস্যরা সেখান থেকে তার মোবাইল নম্বর নিয়ে প্রাথমিকভাবে ক্রেতা হিসেবে আলোচনা করে। একপর্যায়ে ওই কর্মকর্তার সঙ্গে নারী প্রতারক সখ্য গড়ে তুলে। কোম্পানির সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বিভিন্ন কাগজপত্র দেখার জন্য তাকে বাসায় আমন্ত্রণ জানায়। কোম্পানির স্বার্থেই তিনি ওই নারীর আমন্ত্রণে তার টঙ্গীর বাসায় গিয়ে উপস্থিত হোন। বাসায় গিয়ে ওই কর্মকর্তা প্রথমে শুধু একজন নারীকে দেখতে পান।
তারপর দরজা বন্ধ করার পর ভেতর থেকে বের হয়ে আসে কয়েকজন পুরুষ। একপর্যায়ে তারা তাকে মারধর শুরু করে। বিবস্ত্র করে ছবি তোলে। নিম্নাঙ্গে ইট বেঁধে নির্যাতন করে। এক নারী সদস্য বিবস্ত্র হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। এরকম অবস্থায় পুরুষ সহযোগীরা ভিডিও ধারণ করে। তার কাছে থাকা সমস্ত টাকা, এটিএম কার্ড ছিনিয়ে নেয় তারা। ধারণ করা ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে তার স্বজনদের কাছ থেকে বিকাশে আনে আরো টাকা। একপর্যায়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং মুখ খুললে রেখে দেয়া ভিডিও ও ছবির হুমকি দেয় তারা। পরে ওই কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে সবকিছু খুলে বলেন।
গোয়েন্দা পুলিশ উত্তরের গুলশান জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ- কমিশনার গোলাম সাকলায়েন মানবজমিনকে বলেন, শুধু ওই কর্মকর্তা নন এরকম আরো বেশ কয়েকটি অভিযোগ আমাদের কাছে আসে। এরকম প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে টঙ্গীসহ আরো কয়েকটি থানায় মামলা ছিল। প্রতারণার শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পাওয়ার পর থেকে আমরা তাদের শনাক্ত করে আটকের চেষ্টা করি। কিন্তু তারা ঘন ঘন ঠিকানা পরিবর্তন করার কারণে আটক করা একটু কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরও আমাদের নজরদারি তাদের ওপর অব্যাহত ছিল। গত ১৫ই সেপ্টেম্বর প্রযুক্তি ব্যবহার করে জানতে পারি তাদের অবস্থান দক্ষিণখান থানাধীন ফায়েদাবাদ ছাপড়া মসজিদের পার্শ্ববর্তী ১৫৮/৫৯ নম্বর বাসার ৬ তলার একটি ফ্ল্যাটে। ওইদিন বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে আমরা অভিযান চালাই। ওই বাসায় গিয়ে নক করলে ভেতর থেকে কেউ দরজা খুলছিলো না। আমরা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ একটি শব্দ পাই। তখন নিচে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের সদস্য জানান যে, তারা ছয়তলা থেকে গ্রিল বেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তখন আমরা নিচে গিয়ে দেখতে পাই দুজন পালিয়ে গেছে।
আর এক নারী উপর থেকে নামতে গিয়ে নিচে পড়ে আহত হন। এসময় উপরে থাকা আরেকজনকে আমরা গ্রেপ্তার করি। আহত ওই নারীকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করি। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। সাকলায়েন বলেন, যে নারী নিহত হয়েছেন তার নাম রীনা (৩০)। আর যাকে গ্রেপ্তার করেছি তার নাম আরমান (৩৬)। আরমান নিহত নারী রিনাকে তার স্ত্রী হিসেবে দাবি করছেন। এই প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে চক বাজার থানায় মামলা থাকার কারণে তদন্ত গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ জোন করবে বলে জানান তিনি। তাই তাদের কাছে আসামিকে হস্তান্তর করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার আরমানের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর তথ্য: ডিবির গুলশান জোনাল টিমের অভিযানের পর এই প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে করা মামলা নিয়ে কাজ করছে ডিবির লালবাগ জোনের কর্মকর্তারা। এই টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সহকারী কমিশনার আরাফাত লেলিন। আর মামলার তদন্ত করছেন পরিদর্শক মোহাম্মদ মোস্তফা আনোয়ার। তিনি মানবজমিনকে বলেন, আসামি আরমান দাবি করছে সে ওই প্রতারক চক্রের মূল হোতা। কিন্তু আমাদের কাছে আরো অভিযোগ আছে এধরনের কাজে আরো একাধিক চক্র জড়িত রয়েছে। আমরা তাদের আটকের চেষ্টা করছি। তবে আরমান তার জবানবন্দিতে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য দিয়েছে। সে বলেছে, একটি পোশাক কারখানায় সে কাজ করতো। তখন দুর্নীতে ধরা পড়ায় তাকে চাকরিচ্যুত হতে হয়েছে। এরপর থেকে প্রতারণার কাজে সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে পলাশ (২৬), রাজিব (৩০), সৌরভ (২২)। আর নারীদের মধ্যে ছিল রীনা, তুলি ও নাসিমা। মূলত এই নারীদের দিয়ে পুরুষদের ফাঁদে ফেলতো তারা। তাদের ফাঁদে বাদ যায়নি রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ও প্রবাসী। কৌশলে সখ্য বাড়িয়ে তাদের তাদের বাসায় এনে প্রতারণা করা হতো। তাদের পরিকল্পিত সবকিছু ঠিকঠাক মতো করে ভয়ভীতি দেখিয়ে ভুক্তভোগীর স্বজনদের কাছে ফোন দিয়ে আদায় করতো বিপুল পরিমাণ টাকা। গোয়েন্দা কর্মকর্তা আনোয়ার বলেন, এখন পর্যন্ত তারা অন্তত শতাধিক মানুষের সঙ্গে এরকম প্রতারণা করেছে। একই দিনে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে এরকম প্রতারণা করেছে বলে অভিযোগ আছে। হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। পাভেলের কাছ থেকেও নিয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা।
তিনি বলেন- তাদের মোবাইল থেকে একাধিক ভুক্তভোগীর ফাঁদে ফেলার একাধিক ভিডিও, ছবি উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া তাদের স্বীকারোক্তি মতে রিয়াজ, মামুন, মাহবুব ও পলাশ নামের আরো কয়েকটি গ্রুপের সন্ধান পাওয়া গেছে। যারা একই কায়দায় প্রতারণা করে থাকে। এমনকি তাদের এক চক্রের সঙ্গে আরেক চক্রের যোগসূত্র রয়েছে। আমরা তাদের মূলহোতাকে ধরার চেষ্টা করছি।

No comments

Powered by Blogger.