টানা বর্ষণে বিপর্যস্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জীবন by কাফি কামাল

টানা বর্ষণে বিপর্যস্ত কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জীবন। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেয় পাহাড় কেটে ত্রাণের পলিথিন, ত্রিপল ও বাঁশ দিয়ে তৈরি করা সারি সারি ঝুপড়িঘরে। শীত-গ্রীষ্মের দীর্ঘ মৌসুম কাটিয়ে তারা এখন পার করছে বর্ষা। বৃষ্টি নামলেই পাহাড়ের শরীর বেয়ে নেমে আসা পানির স্রোত; ভাসিয়ে দেয় রোহিঙ্গাদের ঝুপড়িগুলো। ভিজে যায় চাল-ডাল আর সামান্য আসবাব। দিন নেই, রাত নেই, বৃষ্টি নামলেই থেমে যায় রোহিঙ্গাদের জীবন। রাতের পর রাত কাটছে   নির্ঘুম। ক্যাম্পে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সমস্যার অন্ত নেই। প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার মৌলিক অধিকার পূরণই দায়। ঘরে ত্রাণের চাল-ডাল আছে, পরনের কাপড়ও মিলছে। কিন্তু বাঁশ আর গাছের অভাবে একটু উঁচু ও শক্তপোক্ত করে বানানো যাচ্ছে না ঝুপড়িগুলো। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন তাই চাল-ডালের চেয়ে বেশি প্রয়োজন বাঁশ ও গাছের। অন্যদিকে জ্বালানি সংকটে একবেলায় রান্না করতে হচ্ছে দুই বেলার খাবার। সেই সঙ্গে সংকট দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে তৈরি হয়েছে ততৈবচ পরিস্থিতি। উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালীর শতাধিক পাহাড় ন্যাড়া করে ঝুপড়ি ঘর বানিয়েছে রোহিঙ্গারা। ফলে বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধস ও বন্যার মারাত্মক ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা।
প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্প। কয়েক দফা বৃষ্টি ও ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে শত শত ঝুপড়িঘর। বালুখালী ক্যাম্পের লালু মাঝি জানান, পাহাড় কেটেই তৈরি করা হয়েছে ক্যাম্পের অধিকাংশ ঘর। বর্ষা মৌসুমে ছোট ছোট পাহাড়ি ধ্বসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বহু ঝুঁপড়িঘর। প্রশাসন কিছু পরিবার নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে গেলে কয়েকশ পরিবার এখনও বসবাস করছে ঝুঁঁকিপূর্ণ অবস্থায়। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ নূর জানান, উখিয়ার যেসব পাহাড়ে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে তার থেকে সমুদ্রের দূরত্ব খুব বেশি নয়। ফলে বর্ষা মৌসুমে এখানে ভারি বৃষ্টি হয়। প্রায় প্রতিদিনই অঝোরধারায় বৃষ্টি নামে। পাহাড় থেকে গড়িয়ে নামা পানিতে সয়লাব হয়ে যায় ঝুপড়ি ঘরগুলো। কখনো কখনো ধসে পড়ে। বৃষ্টির সঙ্গে আসে প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া। উড়িয়ে নিয়ে যায় ঝুপড়ির পলিথিনের ছাউনি। বালুখালী-২ ক্যাম্পের ই-১৪ ব্লকে আশ্রয় নিয়েছে মিয়ানমারের বুসিদং থেকে আসা ওসমান গনির পরিবার। ওসমান জানান, বাঁশ এবং গাছের অভাবে ঘরটি ভালোভাবে তৈরি করতে পারছেন না। বৃষ্টি নামলেই ঘরের মধ্যে জমছে গোড়ালি সমান পানি। মংডু থেকে আসা আব্বাস নামে এক রোহিঙ্গা সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন বালুখালী ক্যাম্পে। তিনি জানান, চাল-ডালসহ সামান্য খাবার পেলেও তারা ঘরে থাকতে পারছেন না। কয়েক দিন ধরে বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত হয়ে পড়েছে ঘর। নিচে পলিথিন বিছানো হলেও তা ফুটো হয়ে পানিতে ভিজে গেছে সব। লাকড়ির অভাবে চুলাও জ্বলছে না।
বালুখালী ময়নার ঘোনা ক্যাম্পে যাওয়ার পথটি বড় করে তৈরি করে দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ক থেকে সে রাস্তা ধরে কিছুদূর এগোলেই চোখে পড়ে একটি অন্যরকম দৃশ্য। রাস্তার দুই পাশে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট অনেকগুলো দোকানপাট। সেখানে তরিতরকারি থেকে মুদি মালামাল সবই বিক্রি হচ্ছে। রোহিঙ্গা পুরুষেরা দোকানগুলোতে বসে অলস আড্ডা দিচ্ছেন। সে বাজারে রাস্তার দুই পাশে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ল জ্বালানি কাঠের আঁটি। ময়নার ঘোনা ক্যাম্পের আশ্রয় নিয়েছেন বুসিদং থেকে আসা রোহিঙ্গা আবদুর নূরের পরিবার। তিনি বলেন, ত্রাণের চাল-ডাল জুটেছে কিন্তু সেগুলো রান্নার জন্য জ্বালানি মিলছে না। জ্বালানি কাঠ কিনে রান্না করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সেগুলোও আবার অনেক দূর থেকে কিনে আনতে হয়।
সুপেয় পানির জন্য হাহাকার এখন তীব্রতর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। বালুখালী, ময়নার ঘোনা ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে অকেজো হয়ে গেছে বেশিরভাগ টিউবওয়েল। মো. সেলিম নামে এক রোহিঙ্গা জানান, বালুখালীর ময়নারঘোনা ক্যাম্পের অধিকাংশ টিউবওয়েলই অকেজো হয়ে পড়েছে। যার কারণে এ ক্যাম্পে তীব্র আকার ধারণ করেছে সুপেয় পানির সংকট। যে কয়টি টিউবওয়েল সচল আছে সকাল-সন্ধ্যা সেখানে পড়ে লম্বা লাইন। জ্বালানির অভাবে পানি ফুটানোর চিন্তাও আমাদের কাছে বিলাসিতা। বৃষ্টির পানি সংগ্রহের চেষ্টা করছে কিছু পরিবার। কিন্তু সেটাও পর্যাপ্ত হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশি-বিদেশি নানা সংস্থার অর্থায়নে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে টিউবওয়েল বসানো হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো বসানোর কাজ করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। কিন্তু চুক্তি লঙ্ঘন করে বেশিরভাগ টিউবওয়েল বসানো হয়েছে স্বল্প গভীরতার। ফলে পাহাড়ের শরীর জুড়ে বসানো এসব টিউবওয়েল অকেজো হয়ে পড়ে একপর্যায়ে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আরেকটি বড় সমস্যা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। দেশি-বিদেশি নানা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার অর্থায়নে ক্যাম্পে ল্যাট্রিনগুলো বসানো হয়। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীদের ব্যক্তিরাই এগুলো বসানোর ঠিকাদারি পান। প্রতিটি ল্যাট্রিন ৫ রিংয়ের গভীর করে বসানোর কথা থাকলেও সেগুলো বসানো হয় ২-৩ রিংয়ের। বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর কাটা পাহাড় থেকে বৃষ্টির জলের সঙ্গে কাদা ঢুকে বেশিরভাগ ল্যাট্রিনই ভরে গেছে। ফলে ক্যাম্পের অনেক জায়গায় রোহিঙ্গারা পায়খানা করছেন খোলা জায়গায়, আশপাশের জঙ্গল ও পাহাড়ি ছড়ায়; যা পুরো এলাকার পরিবেশ নষ্ট করছে দিন দিন। ময়নার ঘোনা ক্যাম্পের বাসিন্দা ইবরাহিম বলেন, ক্যাম্পের ল্যাট্রিনগুলো ভরে গেছে বৃষ্টির পানি ও কাদায়। আমাদের পরিবারের সদস্যরা ঠিকমতো ল্যাট্রিনে যেতে পারছে না। এ সমস্যা কেবল আমার পরিবারের একার নয়। একই রকম অবস্থা বেশির ভাগ পরিবারের ল্যাট্রিনগুলোর। ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ড্যাব মহাসচিব প্রফেসর ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ক্যাম্পগুলোর ছোট ছোট এক একটি ঝুপড়িতে বাস করে ৮-১০ সদস্যের পরিবার। বৃষ্টি নামলে ভেজা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, রোদ উঠলে পলিথিনের গরমে তৈরি হয় অসহনীয় পরিস্থিতি। ফলে তাদের মধ্যে চর্মরোগের প্রাদুর্ভাব চরমে। ক্যাম্পে সুপেয় পানির অভাবে ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত নানা রোগ। ল্যাট্রিনের অভাবে খোলা জায়গায় পায়খানা করার কারণে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ।

No comments

Powered by Blogger.