কী বার্তা দেয় পাকিস্তানের নির্বাচন by মিসবাহুল হক

২৫শে জুলাই বুধবার পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ন্যাশনাল এসেম্বলির ২৭২টি আসনের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৬৭টি আসনের আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। এতে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ প্রথমবারের মতো একক দল হিসেবে সর্বাধিক আসনে জয় পেয়েছে। এ দিক দিয়ে বুধবারের নির্বাচনকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে অভিহিত করা যায়। দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরেই দু’দলের মধ্যে আধিপত্যের পালাবদল হয়েছে। কখনো ভুট্টো পরিবারের পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) আবার কখনো নওয়াজ শরীফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএল-এন) পিটিআই দেশটিতে শাসন করেছে। এবার ইমরান খানের দল পাকিস্তানে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা দুই দলের আধিপত্যের অবসান ঘটিয়েছেন। প্রথমবারের মতো পিপিপি ও পিএমএল-এন এর বাইরে কোনো দল দেশটির শাসন ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর সিংহভাগ সময়ই দেশটি সামরিক বাহিনী দ্বারা শাসিত হয়েছে।
বুধবারের নির্বাচনে পিটিআই নতুন দল হিসেবে দেশ পরিচালনা করার ম্যান্ডেট পেয়েছে। ন্যাশনাল এসেম্বলিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হলেও ইমরান খান পরবর্তী সরকার গঠন করবেন তা প্রায় শতভাগ নিশ্চিত। কেননা অন্য ছোট দল বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নতুন সরকার গঠন তার জন্য কঠিন কিছু হবে না। দু’টি বিষয় পিটিআইয়ের ঐতিহাসিক বিজয়কে সম্ভব করেছে। প্রথমত, পিটিআই দক্ষিণ ও উত্তর পাঞ্জাবে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। অথচ এ অঞ্চলটি পিএমএল-এন এর রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্র ও ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। সেখানে তারা নওয়াজ শরীফের দলের দীর্ঘদিনের আধিপত্যের অবসান ঘটিয়েছে। দ্বিতীয়ত, পিটিআই খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এর আগে ২০১৩ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় পেয়েছিল পিটিআই। এবারের নির্বাচনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
এদিকে, করাচিতে ৩৫ বছর ধরে আধিপত্য ধরে রেখেছিল মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম)। এই অঞ্চলটি তারা শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতো। কিন্তু ২০১৩ সালে দলটির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ তুলে সেখানে অভিযান চালানো হয়। দলটির শীর্ষ স্থানীয় কয়েক ডজন নেতা-কর্মীকে জেলে ঢুকানো হয়। চূড়ান্তভাবে দলটির মধ্যে বিভক্তি ঘটানো হয়। লন্ডনে নির্বাসনে থাকা দলটির প্রধান আলতাফ হোসেইন নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হন। ফলে এবারের নির্বাচনে সেখানে প্রথমবারের মতো অন্য দলগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। সেখানকার ২১টি আসনের মধ্যে ১৪টিতেই জয় পেয়েছে পিটিআই। এমনকি করাচিতে পিপিপি প্রধান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারিকেও পরাজিত করেছে পিটিআই। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সুন্নী মুসলিমদের প্রভাবশালী দল হিসেবে নিজেদের ভিত আরো মজবুত করেছে পাকিস্তানের ডানপন্থী দল তেহরিক-ই লাব্বাইক পাকিস্তান (টিএলপি)। দলটি সিন্ধুর প্রাদেশিক পরিষদে ২টি আসনে জয় পেয়েছে। তবে ন্যাশনাল এসেম্বলি নির্বাচনে বেশিরভাগ আসনেই বেশ ভালো ভোট পেয়েছে দলটি। অপ্রত্যাশিতভাবে ন্যাশনাল এসেম্বলিতে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া দলের তালিকায় টিএলপি বেশ এগিয়ে রয়েছে।
যদিও পিএমএল-এন ও অন্য বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলেছে। তবে দেশটির নির্বাচন মিশন ইসিপি এসব অভিযোগে তেমন কর্ণপাত করেনি। ইসিপি অভিযোগকারীদের প্রমাণ হাজির করতে বলেছে। বিরোধীদের অভিযোগ মূলত ভোট গণনা প্রক্রিয়া নিয়ে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্তত ছয়টি রাজনৈতিক দল দাবি করেছে, ভোট গণনার সময় তাদের পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে চূড়ান্ত ভোট গণনার সময় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। পাকিস্তানের বেসরকারি পর্যবেক্ষক সংস্থা ফাফিন বলেছে, অন্তত ৩৫টি আসনে বিজয়ী প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা নির্বাচনী কর্মকর্তাদের দ্বারা বাতিলকৃত ভোটের তুলনায় কম ছিল। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, নির্বাচনে আইন মেনে চলার বিষয়ে পাকিস্তানে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু মোটের ওপর নির্বাচনে বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। পাশাপাশি সবাই সমানভাবে প্রচারণা চালানোর সুযোগ পায়নি। এসব অভিযোগের বিষয়ে পিটিআই প্রধান ইমরান খান বলেছেন, তার দল নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির বিষয়ে যেকোনো তদন্তে পূর্ণ সহায়তা করবে। অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচনে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছে দেশটির প্রভাবশালী সেনাবাহিনী। সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী দেশজুড়ে তাদের ৩ লাখ ৭১ হাজার সদস্য মোতায়েন করে। এত বেশি পরিমাণে সেনা মোতায়েন আগের নির্বাচনগুলোতে দেখা যায়নি। বুধবারের নির্বাচনে দেশের ৮৫ হাজার ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সেনা সদস্যরা। পাশাপাশি সেখানে বেসামরিক নিরাপত্তাকর্মী ও নির্বাচনী কর্মকর্তারাও নিয়োজিত ছিলেন। সব ভোট কেন্দ্রেই জনসাধারণের প্রবেশ ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এমনকি কয়েক জায়গায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি থাকার পরেও গণমাধ্যমকর্মীদের ভোট কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী বলেছে, তারা নির্বাচনে সরাসরি কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি। সেনা সদস্যরা শুধুমাত্র নির্বাচন প্রক্রিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। তবে পিটিআই ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ তুলেছে, সেনাবাহিনী সরাসরি ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষরা এই বিষয়ে কোনো মূল্যায়ন করেননি। তারা বলেছেন, ভোট গণনার সময় নিরাপত্তাকর্মীরা তথ্য সংরক্ষণ করেছেন ও পরে ফল প্রকাশ করেছেন।
নির্বাচনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যারা-
যেভাবেই বলা হোক না কেন, দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন দল পিপিপি এখন অবস্থানগতভাবে পাকিস্তানের তৃতীয় দলে পরিণত হয়েছে। এছাড়া, জমিয়তক উলেমা ইসলাম ফজল (জেইউআই-এফ), জামাতে ইসলামি ও অন্য কট্টরপন্থী দলগুলোর শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। সারা দেশে এসব দল মাত্র ১৩টি আসনে জয় পেয়েছে। করাচিতে আধিপত্য হারানো এমকিউএমের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি। অন্যদিকে, পশতুন জাতীয়তাবাদীদের দল আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টিও নির্বাচনে বেশ খারাপ অবস্থানে রয়েছে। তবে এবারের নির্বাচন পাকিস্তানে রাজনৈতিক স্থীতিশীলতা আনতে পারে কিনা সেটিই দেখার বিষয়। এখন পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে শুধু জেইউআই-এফ বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। তারা পিএমএল-এন এর সঙ্গে মিলে প্রতিবাদ জানানোর চেষ্টা করছে। আর নীরব থেকে পিপিপি ভোটের ফলাফল অনেকটাই মেনে নিয়েছে। অন্যদিকে, নির্বাচনে জয় পাওয়া পিটিআই তাদের নতুন সরকারে কোন দলকে রাখা হবে তা নির্ধারণে ব্যস্ত সময় পার করছে। সিন্ধুতে বিএপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে পিটিআইর প্রাদেশিক সরকার গঠনের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। আর জনসংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় প্রদেশ পাঞ্জাবে পিএমএল-এন এর সঙ্গে সমানে সমান লড়াই করেছে পিটিআই। সেখানে পিএমএল-এনও প্রাদেশিক সরকার গঠন করতে পারে। বাস্তবেই যদি পিএমএল-এন একটি প্রদেশের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে সক্ষম হয়, তাহলে কেন্দ্র সরকারেও তারা পিটিআইয়ের শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হবে।

No comments

Powered by Blogger.