নারী নির্যাতন মামলায় কম সাজার নেপথ্যে by মরিয়ম চম্পা

নারী নির্যাতন মামলা হয়। কখনো কখনো আসামিরা জেলও খাটে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শেষ পরিণতি হয় মীমাংসা। সামাজিক মর্যাদা, সম্মানহানি, কখনো কখনো আসামি পক্ষের সঙ্গে সমঝোতায় মাঝপথে থেমে যায় মামলার গতি। এমন অনেক ঘটনার মধ্যে মোহনার কাহিনীও একটি। আবেগ আর ভাবাবেগে ভেসে বেড়িয়েছে সুমন ও মোহনা। দীর্ঘ সময় প্রেমের হাওয়ায় দুলে তারা সিদ্ধান্ত  নেয় বিয়ে করার। বিয়েও করে। বছর দুয়েক ভালোই চলছিল তাদের সংসার। এ সময়ের মধ্যে মোহনার কোলজুড়ে আসে এক পুত্র সন্তান। হঠাৎ ঠুনকো এক বিষয় নিয়ে শুরু হয় দাম্পত্য কলহ। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, মোহনা তার স্বামী সুমনকে ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়। উঠেন বাবার বাড়ি। রাগে-ক্ষোভে মোহনাকে নিয়ে তার পিতা রহিম মাতব্বর ছুটেন আদালতে। আইনজীবীর পরামর্শে  মোহনাকে ভর্তি করা হয় স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। একদিন পর ফিজিক্যাল এ্যাসাল্ট সনদ নেয়া হয়। কাজী অফিস থেকে কাবিননামার কপি সংগ্রহ করে ফের ছুটে যান আইনজীবীর কাছে। এরপর দেয়া হয় নারী নির্যাতন মামলা। মোহনা বাদী হয়ে স্বামী, বৃদ্ধ শ্বশুর ও শাশুড়িকে আসামি করে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল’ আদালতে মামলা করেন। বিজ্ঞ বিচারক মোহনার জবানবন্দি শুনে মামলাটি আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইনচার্জকে মামলা এজাহার হিসেবে গণ্য করে নিয়মিত মামলা রুজু করার নির্দেশ দেন। ওসি মামলাটি এজাহার হিসেবে রুজু করে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রেরণ করেন। চার্জশিট দাখিলের আগ পর্যন্ত স্বামী সুমন ও তার বৃদ্ধ মা-বাবা ওই মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যায়। প্রথমত জামিন অযোগ্য ধারার অপরাধ, দ্বিতীয়ত এ মামলায় জামিন দেয়ার এখতিয়ার সাধারণত নিম্ন আদালতের নেই। মামলা থেকে বাঁচতে আসামিরা বাদী মোহনার সঙ্গে আপোষের চেষ্টা চালায়। মোহনাও নিজ সন্তান ও ভবিষ্যতের কথা ভেবে আপোষে রাজি হন। কিন্তু এরই মধ্যে স্বামী সুমন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়। মোহনা ছুটে যায় থানায়। ওসি ও তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আপোষের কথা খুলে বলেন এবং তার স্বামীকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু এখানে রয়েছে আইনের মারপ্যাঁচ। ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিকে থানা থেকে ছেড়ে দেয়ার সুযোগ নেই। বাদী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যান আদালতে। সুমনের আইনজীবী জামিনের আবেদন করেন, বাদী মোহনা ও তার আইনজীবী আদালতে দাঁড়িয়ে ‘আসামির সঙ্গে আপোষ-মীমাংসা হয়ে সুখে দাম্পত্য কাটানোর কথা বলে আসামির জামিনে অনাপত্তির আবেদন জানায়। মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচার্যযোগ্য হওয়ায় এবং ম্যাজিস্ট্রেটের জামিন দেয়ার এখতিয়ার না থাকায় ম্যাজিস্ট্রেট জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। সুমনের জায়গা হয় জেল হাজতে। নিম্ন আদালতের নথি তলব, জামিন শুনানির পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ শেষে প্রায় দেড় মাস পর সুমন জামিনে মুক্তি পায়।
আরেক ঘটনা। রাজধানীর শ্যামলীতে ১৩ বছরের পিংকীকে উত্ত্যক্ত করতো এলাকার দুই যুবক। ২০১০ সালের ১৯শে জানুয়ারি পাড়ার ওষুধের দোকানে অপেক্ষারত দুই যুবক মেয়েটির হাত ধরে টানাহেঁচড়া করে, চড়-থাপ্পড় মারে। রাগে ক্ষোভে ও অপমানে ঘরে ফিরে পিংকী আত্মহত্যা করে। মারা যাওয়ার আগে আত্মহত্যার কারণ চিরকুটে লিখে যায়। অভিযুক্ত দুজন গ্রেপ্তার হয়ে বছর না ঘুরতেই জামিনে বেরিয়ে আসেন। গত সাড়ে সাত বছর ধরে এ ঘটনার আদালতে বিচার চলছে। এ পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনজন আত্মীয়। ২০০৭ সালে ঢাকায় আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ফিরছিল ১৩ বছরের এক মেয়ে। পূর্বপরিচিত দুজন তরুণ তাকে ডেকে নিয়ে সারা রাত আটকে রেখে ধর্ষণ করে। পরে ধর্ষিতার মা মামলা করেন। ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পেয়েছিলেন ডাক্তার। কিন্তু পুলিশ এক আসামির হদিস বের করতে না পারায় তিনি অব্যাহতি পান। অন্যজন প্রায় আট বছর বিচার চলার পর সাক্ষীর অভাবে খালাস পান। মেয়েটির পরিবার বলছে, দুজনই এখনও এলাকায় আছেন।
ঢাকা জেলার একাধিক ট্রাইব্যুনালে আসা ট্রাইব্যুনালগুলোর বিচারিক নিবন্ধন থেকে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, যৌতুকের জন্য হত্যা, আত্মহত্যায় প্ররোচনা আর যৌন পীড়নের মতো গুরুতর অপরাধে ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আসা ৭ হাজার ৮৬৪টি মামলার প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করেছে একটি গণমাধ্যম। তখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছিল ৪ হাজার ২৭৭টি মামলা। সাজা হয়েছিল মাত্র ১১০টি মামলায়। অর্থাৎ সাজা হয়েছিল ৩ শতাংশের কম ক্ষেত্রে। বাকি ৯৭ শতাংশ মামলার আসামি হয় বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়েছে, নয়তো পরে খালাস হয়ে গেছে। মামলাগুলো বেশির ভাগ থানায় করা। কয়েক শ’ মামলা হয়েছে সরাসরি ট্রাইব্যুনালে। সবক’টিরই তদন্তের ভার পুলিশের। তদন্তে অবহেলা, গাফিলতি ও অদক্ষতাও দেখা গেছে। আদালতে সাক্ষী আনা আর সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে পুলিশ আর পিপিদের অযত্ন ও গাফিলতি থাকে। অনেক মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। কখনো আদালতের বাইরে আপোষ হয়। অভিযোগকারীদের বড় একটি অংশ দরিদ্র। এসব অভিযোগকারীরা স্বল্প আয়ের পোশাককর্মী, গৃহকর্মী, বস্তিবাসী বা ছিন্নমূল নারী ও শিশু। তারা থানা আর আদালতে ঘুরে ঘুরে খরচপত্র করে একটা সময় গিয়ে আর মামলা টানতে পারেন না।
সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, নারী নির্যাতনের মামলায় নির্যাতিত নারীর দায়িত্ব হচ্ছে সঠিক সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করা। আর যে মামলায় সঠিক সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকবে উক্ত মামলা তো খারিজ হয়ে যাবে এবং আসামিও খালাস পেয়ে যাবে। কাজেই এই জাতীয় মামলায় বাদীকে অবশ্যই সঠিক সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করতে হবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে মামলার আইনজীবীকে নির্দিষ্ট তারিখ বা কর্মদিবস সম্পর্কে সচেতন ও দায়িত্ববান হতে হবে। এক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় যে, বাদীপক্ষের আইনজীবী মামলার শুনানির তারিখে অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে। একইভাবে কখনো কখনো বাদী পক্ষের সাক্ষী নির্দিষ্ট তারিখে হাজির হতে পারে না। ফলে মামলা দীর্ঘমেয়াদি হয় এবং বাদীপক্ষ আগ্রহ বা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। কাজেই মামলার আইনজীবী, বাদী ও সাক্ষীর কনটিনিউটি ঠিক থাকলে মামলা তাড়াতাড়ি অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এতে করে বাদীপক্ষ যেমন আগ্রহ হারাবে না একই ভাবে আসামিরও খালাস পাওয়ারও সুযোগ থাকে না। 
মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী বলেন, প্রাথমিকভাবে এই জাতীয় মামলা সিরিয়াস হলেও পরবর্তী কিছু দিন পরে আসামি কোনো না কোনোভাবে জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায়। এরপর নির্যাতিতাকে ভয় দেখানো, মামলা তুলে নেয়ার চাপ দেয়া থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে হ্যারাস করতে থাকে। এই ধরনের মামলায় আসামির বেল পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট সময় শেষে আসামি কোনো না কোনো ভাবে জামিন পেয়ে যায়। প্রথমত অধিকাংশ বাদীই মামলা করার কিছুদিন পর উক্ত মামলার প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। যার জন্য মামলার ধীরগতিই দায়ী। তাই এই জাতীয় মামলা নির্দিষ্ট কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। ১৫ দিনের মধ্যে পুলিশের চার্জশিট প্রদানসহ যাবতীয় কার্যক্রম নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। এছাড়া মামলার নিয়মিত নজরদারি ও একইসঙ্গে আইনের যথাযথ প্রয়োগ থাকতে হবে। মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ, ডাক্তার, ভিকটিম, সাক্ষী, আইনজীবী ও বিচারক সকলকেই হেল্পফুল ও পজেটিভ হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এ বিষয়ে সরকারকে সবচেয়ে বেশি আন্তরিক হতে হবে। 
সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার এবং সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ বলেন, নারী ও শিশু আইনের অধিকাংশই হচ্ছে মিথ্যা মামলা। কাজেই মামলা মিথ্যা হলে সেটা তো আর প্রমাণ হবে না। এই জাতীয় মামলার বেশির ভাগই সঠিক তদন্ত ও সঠিকভাবে পরিচালনার অভাব রয়েছে। কাজেই যেকোনো মামলার সুষ্ঠু তদন্তের অভাবে বা তদন্তের গাফিলতি থাকায় সে মামলা সঠিক ভাবে পরিচালিত হয় না। এছাড়া মামলা পরিচালনা করেন যে পাবলিক প্রসিকিউটর তাদের অধিকাংশেরই অদক্ষতা এর সঙ্গে জড়িত। একই সঙ্গে কিছু কিছু বিচারকের কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় ৯৫% আসামি খালাস পেয়ে যায়। লিগ্যাল এইড সার্ভিস (ব্লাস্ট)’র আইনজীবী শারমিন আক্তার বলেন, এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে নির্যাতিত অধিকাংশ নারীই যে ভুলটি করে সেটা হচ্ছে তারা মামলার এজাহারে শুধুমাত্র যৌতুকের জন্য স্বামী মারধর করেছে কথাটি লিখে। একই সঙ্গে তাকে তালাকও দিতে চায় এ কথাটি না লিখে শুরুতেই মামলাটি হালকা করে ফেলে। অথচ প্রাথমিকভাবে তালাকের কথা উল্লেখ করলে আসামির খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। এছাড়া সরাসরি আদালতে পিটিশন মামলার ক্ষেত্রে ইনভেস্টিগেশনে যদি না আসে যে বাদিনী থানায় মামলা করতে গেলে স্থানীয় থানা মামলা না নেয়ায় বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা করেছে তাহলে আসামি খুব সহজেই খালাস পেতে পারে। অর্থাৎ অধিকাংশ ঘটনাই সত্য হওয়ার পরেও আইনের মারপ্যাঁচে বেশির ভাগ আসামি খালাস পেয়ে যায়। এক্ষেত্রে আইনজীবীরা যদি মামলাটিকে প্রপারলি পরিচালনা করে এবং বিচারকরা একটু কেয়ারফুল হলে আসামিদের খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

No comments

Powered by Blogger.