নির্বাচন-উৎসব এবং সুস্থ-অসুস্থ রাজনীতি by সাইফুল ইসলাম

বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে আরো একটি জমজমাট উৎসব সম্ভবত নির্বাচন। ভগবানগোলা, চণ্ডিমণ্ডপ, পঞ্চায়েতের আমলেও এ দেশের মানুষ আড্ডায় মশগুল হয়ে গ্রামের বিচার-শালিস বা শাসন করতো। সম্ভবত তারই ধারাবাহিকতায় এখনো নির্বাচন এলেই তাদের মধ্যে জেগে ওঠে দেশ শাসনের আকাঙ্খা। তাই মেতে ওঠে নির্বাচনী উৎসবে।
তবে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন-উৎসব জমেনি। কারণ দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছিল দুই মেরুতে। একপক্ষ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন করবে বলে ঘোষনা দিল। অন্য পক্ষ সেই নির্বাচন ঠেকাবে বলে মাঠে নামল। ফলে ভণ্ডুল হয়ে গেল জনগণের নির্বাচন-উৎসব। তারপরেও নির্বাচনের নাম শুনলেই ‘ঢাক গুড় গুড়’ তালে পা নাচায় এদেশের মানুষ। যেমন তালে তালে পা নাচিয়ে চলেছে বর্তমানে।
জনসমর্থন বিএনপির খারাপ নয়, কিন্তু মাঠে নেই দলটির নেতারা। জনগণ তাদেরই ভোট দেবে- এমন আশা করে যেন 'গাছে কাঠাল গোফে তেল' দিয়ে ঘুমুচ্ছে তারা। ভাব দেখে মনে হয়না যে, যথা সময়ে তারা উঠে দাঁড়াতে পারবে।
এদিকে, সরকারি দল আওয়ামী লীগ তার নেতা নির্বাচনের কৌশল হিসেবে ‘অভূতপূর্ব’ এক নির্বাচনের আয়োজন করে চলেছে সারাদেশে। এ কৌশলে তারা ওয়ার্ড কমিটি, ইউনিয়ন/পৌর কমিটি, এমনকী থানা কমিটি, জেলা কমিটির নেতা নির্বাচন করে চলেছে। এই নির্বাচনের ডামাডোলে নির্বাচনী একটা পরিবেশ তৈরি হচ্ছে সারা দেশে।
আওয়ামী লীগের পারিবারিক ও রাজনৈতিক সমর্থকদের নিয়েই করা হচ্ছে ওই ভোটের ভোটার তালিকা। তবে, এর মধ্যে ঢুকে পড়ছেন অন্যরাও। যেমন, সিরাজগঞ্জের জাসদ নেতা সোহরাব হোসেন খোকার নাম উঠে গিয়েছিল কামারখন্দ থানা আওয়ামী লীগের ভোটার তালিকায়। কারণ, ১৪ দলের নেতা হিসেবে তিনি বেশ কিছুদিন ধরে ভোট দিয়ে আসছেন নৌকা মার্কায়। পরে অবশ্য বিভিন্ন জনের আপত্তিতে তার নাম বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু যারা আপত্তি করছেন না বা চেষ্টা করছেন নিজেদের নাম আওয়ামী ভোটার তালিকায় তোলার; তারা সহজেই ওই তালিকায় উঠে পড়ছেন। বিএনপি, জামায়াতের লোকজন এভাবেই 'আওয়ামী লীগ' হয়ে পড়ছেন বলে অভিযোগ উঠছে। এ নিয়ে কখনো কখনো বিক্ষোভ, টুকটাক মারপিটের ঘটনাও ঘটছে।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে এ নির্বাচন হচ্ছে। পরে নির্বাচিত সভাপতি ও সম্পাদক কমিটির অন্য সম্পাদক ও সদস্যদের নির্বাচিত করবেন। ফলে আওয়ামী সংশ্লিষ্টরাও জড়িয়ে পড়ছেন নির্বাচনী তৎপরতায়। পোষ্টার, লিফলেট, ডিজিটাল সাইনে ছেয়ে যাচ্ছে এলাকা। দল বেধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চলছে ভোটের প্রচারণা। গুজব ছড়িয়ে পড়ছে ভোট কেনাবেচার। নির্দিষ্ট দিনে হচ্ছে ভোট। গণনা শেষে বিজয়ী প্রার্থীকে পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে জয়ের মালা। আতশবাজী ফুটিয়ে উৎসব করা হচ্ছে। এ ভাবেই আওয়ামী লীগ নিজেরা নিজেরাই নির্বাচনী উৎসব করছে।
এদিকে অনেক প্রার্থী নেতা নির্বাচিত হতে খরচও করছেন দু’হাত খুলে। সিরাজগঞ্জের আওয়ামী লীগ কর্মী লিটন জানালেন, পৌর কমিটির একটি ওয়ার্ডের এক সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী খরচ করেছেন ৩৫ লাখ টাকা। তিনি হিসাব কষে দেখালেন কী ভাবে কোথায় কোথায় এ খরচ হয়েছে। এসব নির্বাচনী খরচ আসছে কোথা থেকে? এমন প্রশ্নের উত্তরে লিটন জানালেন, বড় বড় নেতারা কেউ কেউ এ খরচ দিচ্ছেন তাদের গ্রুপ শক্তিশালী করার জন্য। আবার অনেকে নিজেরাও খরচ করছেন নেতা হওয়ার জন্য। খরচ করে কী লাভ? লাভ আছে- জানালেন লিটন। তিনি বললেন, তাদের ধারণা, নেতা হতে পারলেই কাজের ভাগ, ভিজিএফ, বিভিন্ন রিলিফের স্লিপ তাদের মাধ্যমে বিতরণ হবে। এ থেকে ‘টু-পাইস’ কামাই হতে পারে। না হলেও খরচের টাকা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করে নেবেন তারা।
না প্রকাশ করতে না চাওয়া বিএনপি ও ১৪ দলের (আওয়ামী লীগ নয়) দুই নেতা জানালেন, তারাও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছেন এসব নির্বাচনে। গোপনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন আওয়ামী লীগের নেতা নির্বাচনের জন্য, যাতে আওয়ামী লীগের ওই নেতা তাদের কথা শোনে, অন্তত সামাজিকভাবে অসন্মান না করে।
এক আওয়ামী লীগ নেতা দাবি করলেন, এভাবেই আওয়ামী লীগ অন্য রাজনৈতিক দলকে নিজের মধ্যে হজম করে ফেলছে, সারাদেশে একক রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু আরেক নেতা এতে দ্বিমত পোষণ করে বললেন, এতে রাজনৈতিক দলটি আর রাজনৈতিক দল থাকছে না, হয়ে পড়ছে সামাজিক সংগঠন। চর্চা হচ্ছে যেন-তেন সুস্থ-অসুস্থ রাজনীতির।
আসলে দল বড় হলেই শক্তিশালী হয়- এটা ঠিক নয়। বড় দল যদি রাজনীতি চর্চা না করে, তবে সে দল মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য।
লেখক: সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.