কিশোরী আহেদ তামিমি প্রতিরোধের প্রতীক by মর্তুজা নুর

ঘটনাটির সূত্রপাত হয়েছিল গত ৮ ডিসেম্বর। সেদিন ছিল শুক্রবার। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণার প্রতিবাদে জুমার নামাজের পর জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদের বাইরে এবং গাজা উপত্যকায় বিক্ষোভে অংশ নেন হাজার হাজার মুসল্লি। বিক্ষোভে ইসরায়েলি বাহিনী বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। ইসরায়েলি বাহিনীর কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেটের জবাবে পাল্টা পাথর নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীরা। ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ বিক্ষোভ ঠেকাতে পশ্চিমতীরে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করে ইসরায়েল। কিন্তু রাস্তায় টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ চালাতে থাকে বিপুলসংখ্যক মানুষ।
এ সময় ১৬ বছরের ফিলিস্তিনি কিশোরী আহেদ তামিমি ও তার পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। বিক্ষোভের সময় তামিমির পরিবারের এক সদস্যকে মাথায় গুলি করে ইসরায়েলি সেনারা। এতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে কিশোরী তামিমি।
এ ঘটনার একপর্যায়ে সে একজন দখলদার ইসরায়েলি সেনাকে চড় দেয়। এ দৃশ্য মোবাইল ফোনের ক্যামেরার মাধ্যমে ভিডিও করে সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে তা ভাইরাল হয়ে যায়।
পরে ইসরায়েলি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তামিমি ও তার ২১ বছরের চাচাতো বোনকে অপহরণ করে। তাদের খবর নিতে গেলে তামিমির মাকেও আটক করে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি জেরুজালেম ইস্যুতে ইসরায়েলি সেনার গালে চড় মেরে আলোচনায় উঠে আসা ১৬ বছরের ফিলিস্তিন কিশোরী আহেদ আত তামিমিকে নিয়ে তোলপাড় চলছে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে ব্রিটিশ মন্ত্রণালয় পর্যন্ত তামিমির চর্চা এখনো বহাল তবিয়তে। তামিমির গ্রেপ্তারের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। গ্রেপ্তারকৃত এই ফিলিস্তিন কিশোরী আহেদ তামিমির নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান ব্রিটিশ এমপিরাও।
১৬ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি কিশোরী আহেদ তামিমি তার এক আত্মীয়ের মাথায় রাবার বুলেটের আঘাতের পর ইসরায়েলি বাহিনী তাদের বাড়ি তছনছ করছিল। ওই সময় তামিমি ইসরায়েলি সেনাদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে। তামিমি চিৎকার করে সেনাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলে। তখন ইসরায়েলি সেনারা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। পুরো ঘটনাটি মোবাইলে ধারণ করা হয়। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে।
এ সময় সেই সেনারা অনেকটাই নিষ্ক্রিয় থাকে, খবরটি প্রধান প্রধান গণমাধ্যমের শিরোনাম হলে সেনাদের নীরবতার এই চিত্র ইসরায়েলিদের কাছে অপমানকর বলে বিবেচিত হয়।
ইসরায়েলে সেনারা দ্রুতই প্রতিক্রিয়া জানায়, আহেদ তামিমিকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়, ডিসেম্বরের ১৯ তারিখের শুরুতে তাকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আটকাবস্থায় থাকা তামিমিকে দেখতে গেলে তার মাকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ঘটনার পর তামিমি বীর হিসেবে অভিহিত হচ্ছে। তার ছবি নিয়েও কার্টুন এবং আরবি ও ইংরেজি ভাষায় স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভিডিও তৈরি হয়েছে। জর্ডানের প্রিন্স আলি বিন হুসেইন পর্যন্ত এই ফিলিস্তিনি কিশোরীর প্রশংসা করে টুইটারে ছবি প্রকাশ করেছেন।
এর মধ্যে তামিমির মুক্তির দাবি জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টি নেতা জেরেমি করবিন। সামাজিক মাধ্যমে মুক্তির দাবিতে শুরু হয়েছে দুটি হ্যাশট্যাগ।
জেরুজালেম নিয়ে মার্কিন সিদ্ধান্তের বিষয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের জরুরি বৈঠকের মন্তব্যে ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিয়াদ আল মালিকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া তিনটি ছবিকে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে তামিমির ঝড় তোলা সেই প্রতিবাদের ছবি।
ঘটনার সূত্রপাত ইসরায়েলি সেনার গালে চড় মারা থেকে হলেও তামিমি কিন্তু অনেক আগে থেকেই তার আন্দোলন শুরু করেছিল। ২০১৪ সালে ইসরায়েল সৈন্যরা তার ভাইকে গ্রেপ্তার করার পর সে বেশ স্পর্ধা দেখিয়েছিল।
এ কারণে তখনকার তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী (বর্তমানের প্রেসিডেন্ট) রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তামিমির সাহসিকতার অনেক প্রশংসা করেছিলেন। আর তুরস্কের ইস্তাম্বুল বাসাখেইর নগরী তাকে ‘হানজালা কারেজ অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কার দিয়েছিল।
তামিমির গ্রামের নাম নাবিহ সালেহ। সেখানে ইসরায়েলি অথরিটির অধীনে চলে গেছে। হালামিশ সেটেলাদের (ইহুদি সেটেলার) ইসরায়েলি অথরিটি তাদের গ্রামের অনেকাংশ জমি দিয়ে দিয়েছে। ইহুদিদের বাড়িঘর বানিয়ে দিয়েছে সেখানে। প্রায় জন্মের পর থেকেই আহাদ দেখছে, তাদের অস্তিত্ব হাতের নাগাল থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে।
তামিমির মামা আইডিএফের গুলিতে শহীদ হন। তার মা বিগত বছরগুলোতে তিনবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, সেনাদের গুলিতে জখমও হয়েছেন একবার। তার বাবা দুবার গ্রেফতার হয়েছেন, ১৮ মাস ছিলেন শত্রুদের জেলে।
এখান থেকেই মূলত তামিমির সংগ্রামী চেতনার জন্ম। সে আজ কোনো কিছুতেই ভয় পায় না। বর্তমানে ফিলিস্তিন তরুণীদের কাছে তামিমি ‘ইয়ং ফিমেল লিডার অব টিনএজার’ নামে পরিচিত হয়ে উঠছে। ইসরায়েলি কাপুরুষদের সঙ্গে অকুতোভয়ে লড়ে যাওয়া হিরোর নাম তামিমি। তাকে ডাকা হচ্ছে ‘ফেস অব দ্য রেসিসটেন্স’।
সূত্র : মেমো, দ্য নেশন, বাংলা ট্রিবিউন, আওয়ার ইসলাম।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

No comments

Powered by Blogger.