একজন আইএস যৌনদাসীর অগ্নিপরীক্ষা

জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস তাদের সর্বশেষ শক্ত ঘাঁটি হারিয়েছে। কিন্তু তাদের হাতে একসময় বন্দি থাকা নাদিয়া মুরাদের জন্য শুরু হতে যাচ্ছে নতুন এক যুদ্ধ। তিন বছর ধরে আইএসের হাতে যৌনদাসী হিসেবে বন্দি ছিলেন তিনি। এই সময়টুকুতে তাকে পার করতে হয়েছে বহু অগ্নিপরীক্ষা। মুক্ত হয়ে এখন সেসব কথাই প্রকাশ করছেন তার আত্মজীবনী ‘দ্য লাস্ট গার্ল’ বইয়ের মাধ্যমে। ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে তার কথা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মুরাদ ইয়াজিদি জাতিগোষ্ঠীর নারী। আইএসের হাতে অন্যান্য ইয়াজিদির সঙ্গে বন্দি হয়েছিলেন তিনিও। নিজের দুর্ভোগের কথা নিজেই প্রকাশ করতে চাইছেন। আর এ বিষয়ে তাকে সহায়তা করছেন মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী আমাল ক্লুনি। ইয়াজিদিদের ওপর আইএস যে অত্যাচার চালিয়েছে তার মধ্যে যুদ্ধ-অপরাধ ও গণহত্যাও রয়েছে। মুরাদ আইএস সদস্যদের সেসব অপরাধের জন্য শাস্তির আওতায় আনার জন্য কাজ করছেন। লন্ডন হোটেল থেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমি এটা বাছাই করে নেইনি। কাউকে এই গল্পগুলো বলতে হতো। এটা সহজ নয়। ২০১৪ সালে ইরাকের উত্তরাংশে হামলা চালায় আইএস। তাদের হাতে খুন হয় হাজার হাজার ইয়াজিদি। আরো কয়েক হাজারকে অপহরণ করা হয়- তাদের মধ্যে নারী ও মেয়েরাও ছিল যাদেরকে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, ইয়াজিদিদের ওপর চালানো আইএসের নির্যাতন গণহত্যার সমান। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইরাকে আইএস যে অত্যাচার চালিয়েছে তার প্রমাণ জোগাড় করতে একটি দল গঠন করেছে। ২০১৬ সালে মানব পাচার থেকে বেঁচে আসা মানুষদের জন্য শুভেচ্ছা দূতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন মুরাদ। বর্তমানে তিনি তার বইয়ের মাধ্যমে ওইসব হাজার হাজার ইয়াজিদি নারী ও মেয়েদের উদ্ধারের জন্য সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছেন- যারা হয়তো এখনো বন্দি অবস্থায় আছে। পাশাপাশি তিনি বন্দিদশা থেকে বেঁচে আসা মানুষদের দুর্ভোগের কথাও প্রচার করছেন। তিনি আশা করেন, তাদেরকে শিবির থেকে সরিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। মুরাদ বলেন, এই বইয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইয়াজিদিদের সঙ্গে যা ঘটেছে ও তারা কিভাবে নির্যাতিত হয়েছে সে বিষয়ে সবাইকে জানানো। আমার মতো আর অনেকে আছেন যারা বেঁচে এসেছেন এবং স্বপ্ন দেখেন যে তারা একদিন সাক্ষ্য দেবেন- আইএস তাদের সঙ্গে কি করেছে। আমাদের গল্পগুলো পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে।  ইরাকে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় মুরাদ একজন শিক্ষার্থী হিসেবে তার গ্রামে একটি শান্ত জীবন পার করছিলেন। তিনি বলেন, সবাই দরিদ্র ছিল। আমরা আমাদের সরল, নম্র জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম। আমরা শান্তিপ্রিয়, খোলামনের মানুষ ছিলাম। তার গ্রাম কচোতে আইএসের আগমন ঘটে ২০১৪ সালে। তারা এসেই সবাইকে স্থানীয় স্কুলের ভেতর যাওয়ার নির্দেশ দেয়। সেখান থেকে পুরুষদের অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর বন্দুকের আওয়াজে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। শত শত পুরুষকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে মুরাদের ছয় ভাইও ছিল। তার আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও অন্যান্য যুবতী মেয়েদের সঙ্গে তাকে একটি বাসে ঢোকানো হয়। এরপরই সবাইকে ধর্ষণ করা শুরু করে দেয় ওই পিশাচরা। এক জঙ্গি এসে তার শার্টের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দেয়। আর এরপর এমন সব কাজ করে,  যা বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঘটে থাকে। জঙ্গিরা এসে তার মা’কে নিয়ে যায় মেরে ফেলার জন্য। একজন বৃদ্ধার গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। জীবন্ত পুড়ে মারা যান তিনি। একসময় মুরাদ ও আরো কয়েকজন যুবতী মেয়েকে মসুলের একটি ধনী পরিবারের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পুরুষরা দলে দলে তাদের টেনে নিয়ে যায়। এক ব্যক্তি মুরাদের পেটে একটি জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। অপর এক ব্যক্তি তিন মেয়েকে পছন্দ করে কিনে নেয়। তাদের জন্য মার্কিন ডলারে অর্থ পরিশোধ করে। বাকিদের স্থানীয় বাজারে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। পিশাচরা মুরাদকে টেনে নিয়ে যায় পাশবিকতা চালানোর জন্য। তিনি বলেন, আমি ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা বইয়ে লিখেছি যাতে করে এগুলো আমায় বারবার না বলতে হয়। আইএস নেতারা ইয়াজিদি নারী ও মেয়েদের ওপর চালানো অত্যাচারকে ন্যায্য হিসেবে প্রমাণ করার জন্য তাদের নিজস্ব ধর্মীয় যুক্তি আবিষ্কার করে নিয়েছে। তাদের অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেক নারী আত্মহত্যা করেছে। মুরাদ একবার পালিয়ে আসার চেষ্টা করে, কিন্তু ধরা পড়ে যায়। শাস্তি হিসেবে তাকে গণধর্ষণ করা হয়। তিনি বলেন, সংখ্যায় হাজার না হলেও বন্দি দশায় থাকা ওই কয়েক শ’ মেয়েই আমাকে শক্তি জুগিয়েছে। আমি নিজেকে বলেছি, আমরা এখান থেকে বেঁচে বের হতে পারবো। একদিন সে সুযোগ এলো। একদিন এক বন্দুকধারী তাকে এক বাড়িতে একা রেখে চলে যায়। একটি খোলা দরজাও খুঁজে পান মুরাদ। ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে বের হন তিনি। দেয়াল টপকে রাস্তায় নেমে আসেন, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে। তিনি বলেন, এটা সাহসের বিষয় ছিল না। আমার মধ্যে মৃত্যুভয় ছিল। নির্যাতিত হওয়ার ভয় ছিল। তখন শুধু একটাই চিন্তা মাথায় ছিল- বাঁচতে হবে। মসুলের আধা-অন্ধকার রাস্তায় দৌড়াচ্ছিলেন মুরাদ। তার মুখ ঢাকা ছিল লম্বা এক ওড়নায়। এক বাড়ির সামনে গিয়ে জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দেন তিনি। দরজা খুললে আশ্রয় ভিক্ষা চান। ওই পরিবার তাকে আশ্রয় দেয়। একদিন আইএসের নাকের ডগা থেকে পালিয়ে আসার সুযোগ করে দেয়। এক ব্যক্তির স্ত্রী হিসেবে মসুল ছাড়েন মুরাদ। চেকপয়েন্টে এসে তিনি দেখতে পান, তার ও আরো কয়েকজনের ছবিসহ একটি পোস্টার, যেটিতে লেখা- ওয়ান্টেড। সেখান থেকে মুরাদ পালিয়ে একটি শরণার্থী শিবিরে পৌঁছায়। ২০১৫ সালে জার্মানিতে তাকে একজন শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করে নেয়া হয়। বর্তমানে তিনি তার বোনের সঙ্গে স্টুটগার্টে বাস করেন। তার বোন একজন যুদ্ধ-বিধবা। ফেলে আসা ইয়াজিদিদের অসহায়ত্বের চিন্তা এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় মুরাদকে। তিনি বলেন,  মসুলে মোট ২০ লাখ মানুষ ছিল। আর অপহরণ করে আনা মেয়ের সংখ্যা ছিল ২ হাজার। মসুলে এমন হাজার হাজার পরিবার ছিল যারা ওইসব মেয়েদের সাহায্য করতে পারতো। কিন্তু তারা করেনি। নারীদের পর্দা দিয়ে মুখ ঢেকে চলতে হতো সেখানে। এইভাবে ইয়াজিদি নারীদের সহজেই বের করে আনা যেত। অনেক পরিবার ইয়াজিদিদের পালাতে সহায়তা করার বদলে হাজার হাজার ডলার চেয়েছে। মুরাদ বলেন, তাকে নিরাপদে বের করে আনতে তার বোনের পরিবারকে ২০ হাজার ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। গত গ্রীষ্মে একজন বীরের বেশে নিজের শহরে ফেরত যান মুরাদ। তার ধংস হয়ে যাওয়া বাড়িতে প্রবেশ করে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু নামে তার। তার এক বক্তব্যে তিনি বলেন, আমরা ভেবেছিলাম যে, আমাদের পরিণতি পুরুষদের মতোই হবে- আমাদের মেরে ফেলা হবে। কিন্তু তার বদলে সৌদি আরবীয়, ইউরোপীয়, তুনিশীয় পুরুষ ও অন্যান্য জঙ্গিরা এসে আমাদের ধর্ষণ করছে। বিক্রি করে দিয়েছে। মুরাদ আশা করেন যে, একদিন তাদেরকে ধর্ষণের দায়ে তিনি ওইসব পুরুষদের চোখে চোখ রেখে শাস্তির কাঠগড়ায় নিয়ে যাবেন। আর তিনিই হবেন সর্বশেষ মেয়ে (দ্য লাস্ট গার্ল) যাকে এ ধরনের নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তার আরো একটি ইচ্ছা আছে। তিনি একজন মেকআপ আর্টিস্ট হতে চান। হেয়ার ড্রেসার (নরসুন্দর) হতে চান। সম্ভব হলে নিজের একটি সেলুন খুলতে চান। এমন একটি জায়গা যেটি প্রচলিত চিন্তা-ধারায় নারীদের কাছে নিরাপদ স্বর্গের সমান। তিনি বলেন, হয়তো মানুষ আমাকে একজন স্টাইলিস্ট হিসেবে মনে রাখবে, আইএসের কবল থেকে বেঁচে আসা কোনো নারী হিসেবে নয়। তারা সেটা ভুলে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.