জিয়াকে নিয়ে দেয়া সেই বক্তব্য ধারণ করেন সিইসি

সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা উল্লেখ করে দেয়া বক্তব্য নিজেও ধারণ করেন বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। সিইসি বলেছেন, কাউকে খুশি করার জন্য তিনি এ বক্তব্য দেননি। এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও কোনো ব্যাখ্যা চাওয়া হয়নি। ১৫ই অক্টোবর বিএনপির সঙ্গে সংলাপে জিয়াউর রহমানের গুণগান করায় সমালোচনার মুখে পড়েন সিইসি। এ ধারাবাহিকতায় সংলাপ বর্জন ও সিইসির পদত্যাগ দাবি করেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ১৮ই অক্টোবর জানান, ইসির কাছে ব্যাখ্যা পেয়েছেন; সিইসি এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবেন।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে সিইসির ওই বক্তব্যের প্রসঙ্গ উঠে আসে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন- এমন বক্তব্য এখনো ওউন (ধারণ) করেন কিনা- এ সংক্রান্ত একাধিক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, হ্যাঁ। এখনো ওউন করি। আমি বিশ্বাস করি। এটা তথ্যভিত্তিক বলেছি। বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, জিয়াউর রহমান সাহেব ১৯৭৭ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর নতুন দল গঠন করেছিলেন। তার আগে ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত দেশে গণতন্ত্র ছিল না। তার আগে (১৯৭৫ সালের আগে) গণতন্ত্র ছিল। আমি বলেছিলাম, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন, প্রতিষ্ঠা নয়। তার আগে বহুদলীয় গণতন্ত্র ছিল। জিয়াউর রহমানের সময়ে গণতন্ত্র আবার ফিরে এসেছে। সেই ভিত্তিতে ১৯৭৮ সালে বহুদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগসহ বহুদল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। বহুদল সংসদে যোগ দিয়েছিল। বহু দল সংসদ পরিচালনা করেছিল। কাউকে খুশি করার জন্য এটা বলিনি, তথ্যভিত্তিক বলেছি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, সংলাপে আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা চায়নি। তবে আমরা যে বক্তব্য দিয়েছি তাতে হয়তো বুঝতে পেরেছেন আমাদের অবস্থান কী। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিবদমান ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার কোনো উদ্যোগ নির্বাচন কমিশন (ইসি) নেবে না বলে জানান সিইসি। তিনি জানান, বিদ্যমান সংবিধান ও আইন অনুযায়ী আগামী নির্বাচন আয়োজন করবে ইসি। সংসদ ভেঙে নির্বাচনের বিষয়ে সরকারকে আইন সংশোধনে বাধ্য করা বা চাপ সৃষ্টির কোনো সুযোগ নির্বাচন কমিশনের নেই। অপর এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, নির্বাচনের সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো চাপ আসলে তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করবো। সংলাপে উঠে আসা প্রস্তাব বই আকারে প্রকাশ করে তা রাজনৈতিক দল ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে পাঠাবেন বলেও জানান সিইসি। সংবাদ সম্মেলনে সংলাপে রাজনৈতিক সমঝোতার প্রস্তাব এসেছে, এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেবেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি সরাসরি উত্তরে বলেন, না। এমন উদ্যোগ নেবো না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ উদ্যোগ নেয়ার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই। রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান হওয়া উচিত। এ উদ্যোগে আমরা (ইসি) যেতে চাই না।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে আইনে কোনো পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করবেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- না, আইনে পরিবর্তন আনার দরকার নেই। যে আইন রয়েছে তাই যথেষ্ট। আইন প্রয়োগ করতে হবে। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে বাড়তি কোনো ব্যবস্থা নেয়ার দরকার নেই। যে আইন রয়েছে তাই প্রয়োগ করবো। কোনো কর্মকর্তা আইন অমান্য করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। অর্থাৎ কারো অপরাধ প্রমাণ হলে তাদের শাস্তি পেতে হবে। বর্তমান সংবিধানের আওতায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিষয়ে ইসি কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা সাংবিধানিক বিষয়। সংবিধান পরিবর্তন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। এটা রাজনৈতিক বিষয়। এদেশে তো বহুমুখী নির্বাচন হয়েছে। যখন যে সরকার এসেছে নির্বাচন করার দায়িত্ব কমিশনকে দিয়েছে, সেভাবে নির্বাচন করেছে। যেমন বলা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নির্বাচন হয়েছে। পাকিস্তান সরকারের সময়ে হ্যাঁ, না ভোট হয়েছে। বেসিক ডেমোক্রেসি হয়েছিল। অর্থাৎ যেই সময়ে সরকার যে আইন তৈরি করে দেয়, ইসি সেভাবে নির্বাচন করেছে। সেই আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সংবিধান মেনে ইসিকে চলতে হয়। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত সংবিধানে যেভাবে আছে, সেভাবে নির্বাচন হবে। নির্বাচনের এখনো সময় আছে কখন কী হবে তা জানি না। এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, আশা করি বিএনপিসহ সকল দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। আমরা আন্তরিকভাবে চাই বিএনপিসহ সব দল নির্বাচনে আসুক। কারণ বিএনপি একটি বড় দল। আমরা বিশ্বাস করি, আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
সংলাপে অনেক রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রস্তাব এসেছে- সরকার তা বাস্তবায়ন না করলে ইসির ভূমিকা কী হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, যেসব বিষয় ইসির এখতিয়ারভুক্ত তা সরকার করবেই। তবে জটিল কিছু বিষয় যেমন সহায়ক সরকার, সংসদ ভেঙে দেয়াসহ সাংবিধানিক বিষয়গুলোর বিষয়ে সরকারকে চাপ দেয়া বা বাধ্য করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ইসির এখতিয়ার যেগুলো সে বিষয়ে ইসি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।
বর্তমান আইনি কাঠামোতে সেনা মোতায়েন কোন প্রক্রিয়ায় হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, সেনা নিয়োগ কিভাবে হবে, তাদের দায়িত্ব কী হবে তা নির্ধারণ করবে ইসি। এ বিষয়ে সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। নির্বাচন আসুক তখন পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখা যাবে। তবে বিদ্যমান কাঠামোতে সেনা মোতায়েন করা যাবে। সংলাপে সেনা মোতায়েন, সংসদ ভেঙে দেয়াসহ অনেক প্রস্তাব এসেছে। এমন অবস্থায় সংলাপের পর ইসি ভারমুক্ত হলেন নাকি চাপে আছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন শেষ না করা পর্যন্ত আমরা ভারমুক্ত হই না। ভার তো আমাদের উপর থাকবে, চ্যালেঞ্জ থাকবে। সেগুলো সমাধান করতে হবে।
তফসিলের পর নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব সম্পূর্ণ মাঠ প্রশাসনের হাতে চলে যায়, তখন প্রশাসনের এসব লোক কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ মাঠ প্রশাসনের হাতে যাবে না। নিয়ন্ত্রণ যাবে এমন কথার দ্বিমত করি। সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসির হাতে। তারা আমাদের সহায়ক শক্তি মাত্র। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদের বিধান বলে প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের কর্মকর্তারাও নির্বাচনে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে সাংবিধানিকভাবে বাধ্য এবং তারা তা করে আসছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ধরনের সহযোগিতা নেয় ইসি। তিনি বলেন, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন পর্যন্ত ২-৩ মাস সময় লাগে। ওই সময়ে ১২ থেকে ১৩ লাখ জনবল দরকার হয়। এত জনবল স্থায়ীভাবে ইসির নেই। নির্বাচন কমিশনের এত জনবল সারাবছর পোষা সম্ভব নয়, দরকারও নেই। তাই নির্বাচনের সময়ে রিক্যুইজিশন দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী, সেনা বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োগ দেয়া হয়। তারা নির্বাচনে ইসিকে সহায়তা করে। তাদের উপর ইসির নিয়ন্ত্রণ থাকে ও থাকবে। তিনি আরো বলেন, আরপিওতে একটি অধ্যায় রয়েছে, যেখানে নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে শাস্তি দেয়ার বিধান রয়েছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেখানে আইনের ব্যত্যয় হবে সেখানে আইন অনুযায়ী শাস্তির বিধান কার্যকর করা হবে। রাজনৈতিক দলের কমিটিতে নারীদের উপস্থিতির প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, সংলাপে নারীদের ভূমিকার বিরুদ্ধে যেসব প্রস্তাব এসেছে তা গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংলাপে ইসি সরকারের কাছে কিছু চেয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, আওয়ামী লীগ সংলাপে এসেছে রাজনৈতিক দল হিসেবে, সরকার হিসেবে নয়। সীমানা পুনঃনির্ধারণ প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, সীমানা নির্ধারণের আইন প্রণয়নের কাজ চলছে। তারপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবো।
সংলাপের শুরুতে সিইসি কে এম নূরুল হুদা বলেন, সংলাপের মধ্য দিয়ে আমরা মূল্যবান ও দিকনির্দেশনামূলক সুপারিশ ও পরামর্শ পেয়েছি। আগামী নভেম্বরে এসব সুপারিশ ও পরামর্শ সংকলন করে ডিসেম্বরে বই আকারে প্রকাশ করা হবে। গত তিন মাসব্যাপী রাজনৈতিক দলসহ ৪৫টি সংগঠনের সঙ্গে সংলাপ করেছি। সংলাপের মধ্য দিয়ে যে সুপারিশ অর্জন করেছি, সচিব সাহেব তা তিন ভাগে বিভক্ত করে তা সংগঠন ও সংস্থাগুলোর সামনে উপস্থাপন করেছেন। সেগুলো হচ্ছে- সাংবিধানিক সংশ্লিষ্ট বিষয় যেমন নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার, নির্বাচনকালে সংসদ ভেঙে দেয়া ইত্যাদি। আইন বিষয়ক যেমন আরপিও সংশোধন, সীমানা নির্ধারণ আইন তৈরি করা ইত্যাদি। তৃতীয়ত: নির্বাচন কমিশনের করণীয় বিষয় যেমন নির্বাচনে সেনা নিয়োগ, আইনের সঠিক প্রয়োগ ও নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন। এভাবে চার শতাধিক সুপারিশ অর্জন করেছি। এ সময় তিনি আরো বলেন, মাত্র সংলাপ শেষ করলাম। নিজেরা বসে অ্যাসেসমেন্ট করে দেখবো সুপারিশগুলোর বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবো।
সংলাপের পর ইসিকে সরকার চাপে রাখবে নাকি ইসি সরকারকে চাপে রাখবে- এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, আমাদের কাছে সরকার বা কোনো মন্ত্রী, এমপির কোনো চাপ আসেনি। কখনও চাপ আসেনি। তবে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে চাপ এসেছে, যা সবসময় আসে। কখনো রাজনৈতিক দল পুলিশ বা প্রিজাইডিং কর্মকর্তার বিষয়ে ফোন করেছে। তখন ভেরিফাই করে ব্যবস্থা নিয়েছি। কিন্তু কখনো সরকারের দপ্তর পক্ষ থেকে আলাদা করে চাপ আসেনি। আগামীতে চাপ আসলে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করবো।
সুশীল সমাজের সঙ্গে গত ৩১শে জুলাই সংলাপে বসে ইসি। এরপর সাংবাদিকদের সঙ্গে দুইদিন, ৪০টি রাজনৈতিক দল, পর্যবেক্ষক, নারী নেত্রী ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপ করে। প্রায় তিন মাসব্যাপী সংলাপ গত মঙ্গলবার শেষ হয়। ওই সংলাপের পর বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করলো ইসি। এ সময় চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.