ভুট্টো ইয়াহিয়াকে নিয়ে খেলছিলেন

২ ডিসেম্বর পূর্বাঞ্চলের পাকিস্তানি সামরিক কমান্ডার লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি ইয়াহিয়ার কাছে একটি দুঃসংবাদ পাঠান, ‘ভারতীয় সেনাবাহিনী যশোর দখল করে নিয়েছে।’ যদিও যশোরের পতন হয়েছিল ৬ ডিসেম্বর। ইয়াহিয়া সিদ্ধান্ত নেন, পাকিস্তান বিমানবাহিনী একযোগে ভারতের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাবে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর শক্তি এত বেশি যে তারা আঘাত হানার আগেই পাকিস্তানকে তার কাজটি করে ফেলতে হবে। ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ খোলামেলাভাবে শুরু হয়ে যায়। রাত ১২টা ২০ মিনিটে এক বেতার ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী সারা ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের সমুচিত জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে আরেকটি চিঠি দেন। ৬ ডিসেম্বর লোকসভায় একটি বিবৃতি দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী জানান, বাংলাদেশকে ভারত আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশ সরকারের বারবার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, সতর্কতার সঙ্গে সবকিছু বিবেচনা করে ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ ইতিমধ্যে ভারতের পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লে.
জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন সামরিক বাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনী গঠন করা হয় এবং জেনারেল অরোরাকে যৌথবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা ওঠে। যুদ্ধবিরতির সব প্রস্তাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দেয়। জাতিসংঘে চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি হুয়াং হুয়ার সঙ্গে ১০ ডিসেম্বর এক বৈঠকে নিক্সনের বরাত দিয়ে কিসিঞ্জার বলেন, চীন যদি ভারতকে তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে এবং চীন যদি নিরাপত্তা চায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র চীনের ব্যাপারে অন্যদের নাক গলানোর বিরোধিতা করবে। আশু কর্তব্য হলো, পশ্চিম পাকিস্তানে আক্রমণ চালানো থেকে ভারতকে বিরত রাখা। যদি এ ব্যাপারে কিছু না করা হয়, তাহলে পূর্ব পাকিস্তান হবে ভুটান এবং পশ্চিম পাকিস্তান হবে নেপাল। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য নিয়ে ভারত অন্যান্য জায়গায় ইচ্ছেমতো তার শক্তি দেখানোর স্বাধীনতা পেয়ে যাবে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পূর্বাঞ্চলে অগ্রসরমাণ মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর মোকাবিলা করার সামর্থ্য পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিল। জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে আলোচনা করে জেনারেল রাও ফরমান আলী ঢাকায় জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব পল মার্ক হেনরির কাছে ১০ ডিসেম্বর একটি লিখিত প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়:
ক) যেহেতু রাজনৈতিক কারণে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, এটি রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে।
খ) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে আমি পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত সব প্রতিনিধির কাছে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তানের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে একটি সরকার গঠনের আহ্বান জানাচ্ছি।
গ) এই প্রস্তাবের সঙ্গে এটিও বলা দরকার যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ দাবি করছে ভারতীয় বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে যাবে।
ঘ) শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জাতিসংঘের কাছে আহ্বান জানিয়ে অনুরোধ করছি:
১) অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি;
২) পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সসম্মানে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়া;
৩) পাকিস্তানের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়া;
৪) ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী সব মানুষের নিরাপত্তা;
৫) কারও বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার নিশ্চয়তা;
ঙ) আমি পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে এটি একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব;
চ) সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে না এবং এ প্রশ্নই ওঠে না। এই প্রস্তাব গ্রহণ করা না হলে সেনাবাহিনীর শেষ সদস্যটিও জীবন থাকতে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট প্রস্তাবটি পেয়ে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধিকে এর সত্যতা নিশ্চিত করতে বলেন। স্থায়ী প্রতিনিধি এ ব্যাপারে সরকারের নির্দেশনা চান। পররাষ্ট্রসচিব প্রস্তাবটি ইয়াহিয়ার কাছে নিয়ে গেলে তিনি প্রস্তাব থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পাকিস্তানি বাহিনী সরিয়ে নেওয়ার অনুচ্ছেদ দুটি বাদ দিয়ে মহাসচিবের কাছে পাঠাতে বলেন। নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো নিউইয়র্কে পৌঁছান ১১ ডিসেম্বর। তিনি ফরমান আলী ও ইয়াহিয়া এ দুজনের কারও প্রস্তাবই আমলে না নেওয়ার জন্য মহাসচিবকে অনুরোধ করেন। ইয়াহিয়াকে পাঠানো এক বার্তায় ভুট্টো বলেন, ‘আপনি জানেন যে আমি এ যুদ্ধের বিরোধী। উত্তেজনা প্রশমনের জন্য প্রকাশ্যেই আমি এ কথা বলছি। কিন্তু আমরা যেহেতু এখন যুদ্ধের মধ্যে আছি, আপনার ভাষায় “ইসলামের সৈনিক” হিসেবে আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব।’ নিরাপত্তা পরিষদের অন্যতম সদস্য পোল্যান্ড একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। প্রস্তাবটি ছিল: তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি, সেনাবাহিনী পরস্পরের সীমান্তে ফিরিয়ে আনা এবং পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক মীমাংসা করা। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এ প্রস্তাবের কথা জানতে পারেন সংবাদপত্রের মাধ্যমে। ওই সময় জাতিসংঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ভুট্টো। তাঁকে খবর পাঠানো হলো, পোল্যান্ডের প্রস্তাব যেন গ্রহণ করা হয়। ইয়াহিয়া নিজে ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অনেক যোগাযোগ করেও ভুট্টোকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইয়াহিয়ার সঙ্গে তিনি আর যোগাযোগ করেননি। পোল্যান্ডের প্রস্তাব সাধারণ পরিষদে ১০৫ ভোট পায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত এবং পূর্ব ইউরোপীয় অন্য দেশগুলো প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। পোল্যান্ড সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের একটি দেশ হওয়ায় একটি আপসরফার ক্ষীণ সম্ভাবনা তখনো ছিল এবং প্রস্তাবটি গৃহীত হলে পাকিস্তানের মুখ রক্ষা হতো। কিন্তু ভুট্টোর সন্দেহজনক অনুপস্থিতির কারণে অনেক দেরি হয়ে যায় এবং প্রস্তাবটি তার কার্যকারিতা হারায়। ভুট্টো ইয়াহিয়াকে নিয়ে খেলছিলেন। ভুট্টো ভেবেছিলেন, যুদ্ধ যদি বেশি দিন চলে এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে যদি একটি মীমাংসা হয়, তাহলে তিনি এর কৃতিত্ব নেবেন। তিনি বলতে পারবেন, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে তাৎক্ষণিকভাবে রাজি না হয়ে তিনি পাকিস্তানকে রক্ষা করেছেন। সামরিক কমান্ডাররা আত্মসমর্পণ করতে চেয়েছিল এবং তিনি এটি ঠেকিয়েছেন। সেনাবাহিনী যদি পরাজয় মেনে নেয়, তাহলে তারা আর ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দলের নেতা হিসেবে তিনি (পশ্চিম) পাকিস্তানের ক্ষমতা হাতে নেবেন।
আগামী পর্ব: সপ্তম নৌবহর রওনা করার ঘোষণাটি ছিল ধাপ্পা
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.