বর্ণিল আলোয় হারিয়ে যাওয়া রাজনীতি

আওয়ামী লীগের সম্মেলন উপলক্ষে
নগরজুড়ে ছিল আলোকসজ্জা
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ঢাকা সফরের আগের দিন মানে ১৪ অক্টোবর ঢাকা শহর রঙিন আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। তারপর সেই আলো ঝলমলে শহরে পরের ১০ দিন রঙের খেলা আরও গাঢ় হয়েছে বৈ কমেনি। কারণ, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের কাউন্সিল। কাউন্সিলটি যেহেতু দেশের অন্যতম পুরোনো এবং বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের, সেহেতু সেই জৌলুশ ঢাকার বাইরেও ছড়িয়েছে।
জেলা শহরগুলোতেও আওয়ামী লীগের উৎসাহী সংগঠকেরা আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করেছিলেন। বাংলাদেশে আর কখনো এভাবে একটানা ১০ দিন আলোকসজ্জার কোনো রেকর্ড আছে বলে আমার জানা নেই। সুতরাং, সংবাদপত্রের বর্ণিল আয়োজন কিংবা জাঁকজমকপূর্ণ সম্মেলন শিরোনাম অথবা বিবরণকে যথার্থই বলতে হবে। এই আলোকসজ্জার জন্য বাড়তি বিদ্যুৎ কতটা খরচ হলো অথবা সম্মেলনের অন্যান্য খরচের পরিমাণ কত বা সেগুলোর উৎস সম্পর্কে কোনো তথ্য দলের তরফ থেকে প্রকাশ করা হয়নি। সুতরাং, অজানা বিষয়ে অনেক প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এখন আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপি বা অন্য কোনো দলের তুলনা চলে না। বিএনপির সঙ্গে আগে তুলনা চললেও এখন তা আর বাস্তবসম্মত নয়। আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায়, তা সে নির্বাচন নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক না কেন। রাষ্ট্রকাঠামোতে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে দল হিসেবে তাদের অবস্থান সুসংহত নয়। সংসদে তারাই সব—বিরোধী দলের অনুপস্থিতি যে প্রধানমন্ত্রী নিজেও উপলব্ধি করেন, সে কথা এই সেদিনই আমরা ভারতে দ্য হিন্দু পত্রিকার সাক্ষাৎকারে জানলাম। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, অন্যান্য সিটি করপোরেশন, পৌরসভা,
জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদগুলো সব জায়গাতেই আওয়ামী লীগ। হাতে গোনা যে কটিতে বিএনপির প্রার্থীরা জিতেছিলেন, তাঁরা হয় কারাগারে এবং অপসারিত, নয়তো পলাতক। এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই, যেখানে উপাচার্য এবং শিক্ষক সমিতিগুলো আওয়ামী লীগের পক্ষে নেই। আর সেসব জায়গায় ছাত্রলীগ ছাড়া আর কেউ কখনো ছিল কি না, সেটাই বোঝা মুশকিল। আইনজীবী সমিতি, শ্রমিক সংগঠন কিংবা কৃষক সংগঠনেও এখন আওয়ামী লীগের সমর্থক ছাড়া অন্য কারও অস্তিত্ব তেমন একটা অনুভূত হয় না। ফলে সাধারণ মানুষের চলাফেরা ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ওপর আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলের একটা সর্বব্যাপী প্রভাব পড়া মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়। ঢাকার সহৃদয় নাগরিককুল তাই পরিস্থিতির সঙ্গে ভালোই তাল মিলিয়ে চলেছে। ২২ ও ২৩ অক্টোবর শহরে না ছিল যানজট, না ছিল কোনো হাঙ্গামা। অনেকেই তাই বলেছেন যে আহা, প্রতিদিনই সবকিছু এমন গোছানো হয় না কেন? আওয়ামী লীগের সম্মেলনের আগে প্রধানমন্ত্রী অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে ৩৫ বছর তিনি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখন তরুণ নেতৃত্ব বাছাই করা দরকার। এরপর কাউন্সিলেও তিনি একই কথার পুনরুচ্চারণ করে বলেন যে তিনি দেখতে চান তাঁর জীবদ্দশাতেই দলে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে। তাঁর এই বক্তব্যের রেশ ধরেই রাজনৈতিক অঙ্গনে ধারণা জন্মায় যে দলের নেতৃত্বে সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী কে, তা এবারে স্পষ্ট হবে। জল্পনার কেন্দ্রে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।
দলের নেতা-কর্মীরাও জয়কে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখতে চাওয়ার আওয়াজ তোলেন। একই সঙ্গে তাঁরা স্পষ্ট করে দেন যে তাঁরা শেখ হাসিনাকেই আজীবন সভানেত্রী হিসেবে দেখতে চান। আর সজীব ওয়াজেদ জয় দলের জন্য কাজ করার প্রত্যয় ঘোষণা করলেও বিদেশে থাকার কারণে দলের কোনো পদ গ্রহণ ঠিক হবে না বলে জানিয়ে দেন। ফলে সম্মেলন থেকে নতুন নেতৃত্ব পাওয়ার আওয়াজ বাতাসেই মিলিয়ে গেল। এ পর্যন্ত ঘোষিত কমিটির যে আংশিক চিত্র তাতে দলের পুরোনো এবং নানা কারণে আলোচিত নেতাদের মধ্যেই শুধু দু-চারটি চেয়ার রদবদল ঘটল। আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিল যেদিন শুরু হয়, তার তিন দিন আগে ১৯ অক্টোবর প্রতিবেশী দেশ ভারতের সংবাদমাধ্যমে বেশ ফলাও করে একটি খবর প্রচারিত হয়। খবরটি হচ্ছে তামিলনাড়ু রাজ্যের। রাজ্যটিতে কয়েক দশক ধরে দুটি দল পালাক্রমে ক্ষমতায় আসে। দুটি দলই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সেখানে দলীয় প্রধানদের প্রতি ভক্ত-অনুসারীদের আনুগত্য হচ্ছে অবিশ্বাস্য রকম। একজন হলেন জয়ললিতা, ভক্তরা যাঁকে আম্মা সম্বোধন করেন। আর অপরজন করুণানিধি। এখন ক্ষমতায় জয়ললিতার দল। গত ২২ সেপ্টেম্বর জয়ললিতা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে কেউ জানে না তিনি কবে সুস্থ হবেন বা তাঁর রোগটা আদৌ নিরাময়যোগ্য কি না। প্রায় এক মাস ধরে রাজ্য কে চালাচ্ছিলেন কেউ জানে না এবং বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। অবশেষে রাজ্যপাল অর্থমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরগুলোর দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি যে খবরটির কথা বলছিলাম তাতে দেখা যাচ্ছে, তিন মাস পর ১৯ অক্টোবর তামিলনাড়ুর রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
তবে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর আসন খালি রেখে এবং টেবিলের ওপর তাঁর একটি ছবি রেখে ওই সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী সভাপতিত্ব করলেও ‘আম্মা’র অনুপস্থিতি এবং তাঁর স্বাস্থ্যগত অনিশ্চয়তার ছায়াই সেখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে (জয়ললিতা’স ফটো অ্যান্ড অ্যান এম্পটি চেয়ার প্রিজাইডস ওভার তামিলনাড়ু কেবিনেট মিটিং, এনডিটিভি, ১৯ অক্টোবর, ২০১৬)। ৬৭ বছরের পুরোনো রাজনৈতিক দল, যে দলটির নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, সেই দলের সম্মেলন ঘিরে আগ্রহ-কৌতূহলের কমতি থাকার কথা নয়। নতুন নেতৃত্বের আওয়াজ, নেত্রীর ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পাওয়ার দাবি, সব গুঞ্জন ‘ভুয়া’ কিংবা আকাশে ‘চাঁদ’ উঠলেই সব জানা যাবে ধরনের মন্তব্য আমাদের এই কৌতূহল অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে সংবাদমাধ্যম দলীয় প্রধান কাকে তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সিপাহসালার করে নেন, সেই দিকটিতেই নজর দিয়েছে। সম্মেলনে দলটির রাজনৈতিক আত্মানুসন্ধান, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন, সাংগঠনিক পর্যালোচনা এগুলোর সবই উপেক্ষা করেছে। সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে সদ্য বিদায় নেওয়া সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ যে আবেগঘন অলিখিত বক্তৃতা দিয়েছেন, তার তাৎপর্য নিয়ে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ হয়েছে। তাঁর স্বপদে বহাল থাকার কোনো আলামত মেলে কি না, সেটাই সবাই সন্ধান করেছেন। কিন্তু তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের যে ত্রিবার্ষিক রিপোর্টের কপিটা দেখিয়ে কাউন্সিলর-ডেলিগেটদের তা সংগ্রহ করতে বলেছিলেন, তার বিষয়বস্তু নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। রাজনৈতিক প্রচারপত্র এবং প্রকাশনা সাধারণ মানুষের হাতে গেলে তাঁরা তা পড়ুন অথবা না-ই পড়ুন,
সেগুলোর শেষ আশ্রয় সাধারণত ফেলে দেওয়া কাগজপত্রের স্তূপের মধ্যেই হয়। এ ক্ষেত্রে কী ঘটেছে সে প্রশ্ন না হয় না-ই করলাম! ২৪ ঘণ্টা টেলিভিশনের যুগে রাজনীতিতে এখন সারবস্তুর চেয়ে তার প্রলেপ বা খোলসটিই বেশি গুরুত্ব পায়। ফলে সবার কাছে প্রাধান্য পেয়েছে দেশি-বিদেশি অতিথিদের কারা এলেন অথবা এলেন না, দলের পদ-পদবিতে কার উন্নতি বা অবনতি হয় ইত্যাদি বিষয়। রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে সাফল্য বা ব্যর্থতার মূল্যায়ন হলে নিশ্চয়ই গরিবের জন্য বরাদ্দ চাল কেলেঙ্কারি, সরকারি খাদ্য সংগ্রহ অভিযান ঘিরে দুর্নীতি, গম কেলেঙ্কারি, নেতাদের জনবিচ্ছিন্নতার বিষয়গুলো আলোচিত হতো। সে রকম কোনো কথা কেউ কি শুনেছেন? আওয়ামী লীগের ১৯তম জাতীয় সম্মেলনটি হয়েছিল ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর ওই একই জায়গায়। কিন্তু দেশের রাজনীতি গত চার বছরে মোটেও এক জায়গায় স্থির ছিল না। স্বৈরশাসক এরশাদের সামরিক শাসনের পর একটানা দীর্ঘতম সময় ক্ষমতায় থাকা দলটি গত চার বছরে যেসব গুরুতর রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, তার কোনো মূল্যায়ন বা আত্মসমালোচনার লেশমাত্র এই সম্মেলনে দেখা গেল না। একনজরে যদি ওই সময়ে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়, তাহলেই বোঝা যাবে জাতীয় জীবনে সেগুলোর সুদূরপ্রসারী প্রভাব কতটা ব্যাপক।
—আওয়ামী লীগের ১৯তম জাতীয় সম্মেলনের পর মাত্র দুই মাস যেতে না–যেতেই যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের জন্ম। ওই গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের কারণে মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের আইন সংশোধন করে রাষ্ট্রপক্ষও ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অধিকার লাভ করে। শুরুতে আওয়ামী লীগ সমর্থন দিলেও তারপর থেকে গণজাগরণ মঞ্চ সরকারের জন্য কমবেশি মাথাব্যথার কারণ হয়ে আছে।
—হেফাজতে ইসলামের উত্থান এবং ২০১৩-এর ৫ মে তাদের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি। সরকার কঠোর নীতি অনুসরণ করে তা দমন করলেও হেফাজতে ইসলাম একটি ধর্মীয় জোট হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ধরনের প্রভাব ফেলছে। সম্প্রতি কওমি মাদ্রাসাগুলোর পাঠক্রম ঠিক করার লক্ষ্যে গঠিত কমিশনে হেফাজত প্রধানের চেয়ারম্যান পদের মেয়াদ আবারও বাড়িয়েছে সরকার।
—২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, যা বিদায়ী সংসদের প্রধান বিরোধী দলসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বর্জন করে এবং অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী ঘোষিত হন। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের বিষয়টি দলটির রাজনৈতিক কৃতিত্ব হিসেবে উদ্‌যাপনযোগ্য কোনো বিষয় হয়ে থাকলে সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে তার কোনো উল্লেখ না থাকার ব্যাখ্যা কী হতে পারে, তা রীতিমতো একটি রহস্য।
—দেশের তৃতীয় প্রধান দল জাতীয় পার্টি চরম নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। বিতর্কিত ওই নির্বাচনের পর সংসদীয় গণতন্ত্রে নতুন নজির তৈরি করে জাতীয় পার্টি সরকারেও অংশ নেয় আবার একই সঙ্গে বিরোধী দলের আসনেও আসীন হয়।
—ইসলামের নামে সহিংস উগ্রপন্থার বৈশ্বিক প্রভাবে দেশের ভেতরে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর ধারাবাহিক নৃশংস হামলা ও সংগঠিত হুমকি। সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে এর উল্লেখ অনেকটাই দায়সারা গোছের এবং তা-ও বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে উদ্দেশ করে। তবে সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে দলের গত চার বছরের সাফল্য-ব্যর্থতার কোনো মূল্যায়ন না থাকলেও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার বক্তব্যে তার সামান্য ইঙ্গিত আছে। তিনি দলের সবাইকে আগামী নির্বাচনের জন্য এখনই ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেছেন এবং ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে জন্য সবার কাছে উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে দিতে বলেছেন। আর দলের যে নতুন কমিটি ঘোষণা করেছেন তা করা হয়েছে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে। সভানেত্রীর কাছ থেকে দলের নতুন সাধারণ সম্পাদকের আশীর্বাদ নেওয়ার যে ছবি গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, তাতে এটি সুস্পষ্ট যে দলের অভিমুখ নির্ধারণের মূলকেন্দ্র একেবারেই অপরিবর্তিত আছে। আর যেহেতু দলীয় প্রধানই একটি প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন প্রত্যাশা করেন, সেহেতু তাঁর সরকার এখন সেই লক্ষ্যে অগ্রসর হবে বলেই আশা করি।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.