কিশোরীদের জন্য বিনিয়োগ বৃথা যাবে না

‘কিশোরীদের জন্য বিনিয়োগ, আগামী প্রজন্মের সুরক্ষা’। এটা ছিল চলতি বছরের বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের প্রতিপাদ্য। গত ১১ জুলাই বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়েছে। বাংলাদেশেও দিবসটি উপলক্ষে সরকারি–বেসরকারি নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল। এসব কর্মসূচির মধ্যে ছিল সভা ও সেমিনার। এসব সভা ও সেমিনারে কিশোরীদের উন্নয়নের জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়। তাদের জন্য বিনিয়োগ করার কথা বলা হয়। বলা হয়, কিশোর-কিশোরীদের পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিশ্চিতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে হবে এবং এই বিনিয়োগের সুফল যেন তারা পায়, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। সভা-সেমিনারে বলা এসব কথার কোনোটিই বাগাড়ম্বর নয়। প্রতিটি কথা একেবারে সত্য। কিন্তু আমাদের দেশের কিশোরীদের প্রকৃত অবস্থা কী?
দেশের অনেক মেয়েরই কৈশোর বয়সে না পৌঁছাতেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, তারা খুব অল্প বয়সে মা হচ্ছে। বাংলাদেশ জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে এক-তৃতীয়াংশ কন্যাশিশুর ১৫ বছরের আগে এবং দুই-তৃতীয়াংশ কন্যাশিশুর ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়। গ্রামে এ হার ৭১ শতাংশ এবং শহরে ৫৪ শতাংশ। ২০১৪ সালে এ গবেষণা করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ বলছে, কিশোরীদের ৪৯ শতাংশের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে। অল্প বয়সে বিয়ের ফলে একটি কিশোরী অল্প বয়সে মা হচ্ছে। অথচ তার শরীর কোনোভাবেই গর্ভধারণ বা মা হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। আগামী প্রজন্মের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা এবং সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে বাল্যবিবাহ একটি বড় বাধা। একটি কিশোরী যখন সন্তানের মা হয়, তখন সে মারাত্মক অসুবিধায় পড়ে। সে যেখানে নিজেকে সামলাতে পারে না, সেখানে কী করে একটি শিশুকে সে লালন পালন করবে। এর কিছুই তো সে জানে না। ফলে শিশুটিও নানা অসুবিধায় ভোগে। সে ঠিকভাবে বেড়ে ওঠে না। নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, অপুষ্টিতে ভোগে।
বাল্যবিবাহের কারণে কিশোরীরা পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়ে। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৪ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েদের অন্তর্ভুক্তি প্রায় শতভাগ এবং মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণও আশাব্যঞ্জক, প্রায় ৬৯ শতাংশ। তবে ঝরে পড়ার হার এখনো অনেক বেশি, ৪৭ শতাংশ। এতে স্পষ্ট হয় যে অধিকাংশ মেয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারছে না। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় ঝরে পড়ার উচ্চ হারের নেপথ্যে একটি বড় কারণ হচ্ছে বাল্যবিবাহ। এ তো গেল কিশোরীদের অল্প বয়সের বিয়ের কথা। এ ছাড়া তারা নানা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাদের উত্ত্যক্ত করা হচ্ছে, যৌন নিপীড়ন করা হচ্ছে, ধর্ষণ করা হচ্ছে; এমনকি খুনও করা হচ্ছে। এই তো সেদিনের কথা, বখাটের ছুরিকাঘাতে খুন হলো রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিসা। তারও আগে থেকে ওই বখাটে রিসাকে মোবাইল ফোনে উত্ত৵ক্ত করে আসছিল। রিসার মতো আরেক কিশোরী কণিকা ঘোষ একইভাবে বখাটের ধারালো অস্ত্রের কোপে প্রাণ হারায়। গত মে মাসে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে এ ঘটনা ঘটে। এ রকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে।
কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয় পরিবারে। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় কিশোরী নির্যাতনের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। এখানে প্রায় প্রতি দুজনের একজন (৪৭ শতাংশ) বিবাহিত কিশোরী (১৫ থেকে ১৯ বছর) স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয়; বিশেষ করে মামা, চাচা কিংবা ভাইয়ের হাতে নির্যাতন, এমনকি যৌন নিপীড়নেরও শিকার হচ্ছে কিশোরীরা। এ ঘটনাগুলোয় আইনের আশ্রয় নেওয়া হয় না বলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশ পায় না। পাঠক বলুন, কিশোরীদের এই পরিস্থিতিকে আপনি কী বলে অভিহিত করবেন? এরপরও বলবেন, তারা ভালো আছে? তাহলে করণীয় কী? আজকের কিশোরীরাই আগামী দিনের মা। তারাই মা হিসেবে জন্ম দেবে ভবিষ্যতের কান্ডারিদের। তাই পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কিশোরীদের উন্নয়ন না হলে দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে না। তাই জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে আজকের কিশোরীদের জন্য আমাদের বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। কিশোরীদের উন্নয়নে সরকারের অনেক কর্মসূচি চালু আছে। বেসরকারি সংস্থাগুলোও প্রজননস্বাস্থ্যের উন্নতিসহ কিশোরীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উন্নয়নের জন্য কাজ করছে। কিন্তু দেশের সব কিশোরী এসব কর্মসূচির আওতায় নেই।
সে জন্য সরকারকে আরও ব্যাপকভিত্তিক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। আরও অনেক বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। তবে কিশোরীদের জন্য বিনিয়োগের প্রথম দায়িত্বটি পরিবারকে নিতে হবে। দেশের প্রতিটি পরিবারকে তার কিশোরী সদস্যের প্রতি বেশি খেয়াল রাখতে হবে। তার শিক্ষার ব্যবস্থা প্রথমে পরিবারই করবে। তার যাতে বাল্যবিবাহ না হয়, সেটা নিশ্চিত করবে পরিবার। তার সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। তার নিরাপত্তার দিকটিও পরিবারকে দেখতে হবে। নিজ ঘরেই তারা যাতে কোনো ধরনের নির্যাতনের বা যৌন হয়রানির শিকার না হয়, সে জন্য পরিবারকে সচেতন হতে হবে। বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে চায়। মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী ও সুস্থ শ্রমশক্তি, যেখানে নারী ও পুরুষ উভয়েই থাকবে। তাই এ দেশের মেয়েদের অবশ্যই সংশ্লিষ্ট শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারে। কিশোরীদের উন্নয়ন ছাড়া দেশ কখনো প্রকৃত মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে পারবে? কাজেই আসুন, কিশোরীদের উন্নয়নে আমরা তাদের জন্য আরও অনেক বেশি বিনিয়োগ করি। এই বিনিয়োগ বৃথা যাবে না, এটা নিশ্চিত।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.