ফ্রম ক্রসফায়ার টু লাঠি-বাঁশি!

‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নিয়ে কথা উঠেছে। কথা আগেও ছিল। এখন একের পর এক যেভাবে ক্রসফায়ার চলছে, অনেকেই চিন্তিত। এটা ঠিক যে ক্রসফায়ারে মূলত দাগি কিছু আসামি, জঙ্গি সন্ত্রাসী বা গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিই মারা যান। কিন্তু মারা যেতে হবে কেন? এখানেই প্রশ্ন। আদালতে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কি তঁাদের অপরাধী হিসেবে সাজা দেওয়া যায়? তাই পুলিশের কাজ হলো অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ধরে বিচারের সম্মুখীন করা। তারপর আদালত জানেন কী করতে হবে। কিন্তু তার আগেই পুলিশ তঁাদের নিয়ে যাচ্ছে ‘স্বীকারোক্তি’ অনুযায়ী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার বা অন্য অভিযুক্ত অপরাধীদের ধরতে এবং সেখানে চিরাচরিত প্রথায় ‘ওত পেতে থাকা কিছু অপরাধী পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ শুরু করে এবং আসামি মারা যায়’! এখন পুলিশ আরেক কৌশল নিয়েছে। জনপ্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন এলাকায় মানুষকে জড়ো করে তাঁদের হাতে লাঠি-বাঁশি তুলে দেওয়া হচ্ছে। ২৯ জুন জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে বাগেরহাটে সাধারণ মানুষের মধ্যে লাঠি বিতরণ করেছে জেলা পুলিশ। এর আগে আরও কয়েকটি জেলা-উপজেলায় জনতার হাতে লাঠি-বাঁশি তুলে দেওয়া হয়েছে। ক্রসফায়ারের চেয়ে লাঠি-বাঁশি যে ভালো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু তাতে কি বন্দুকযুদ্ধ বন্ধ হচ্ছে? দুদিন আগেও তো বন্দুকযুদ্ধে একজন মারা গেছেন। তারপরও বলব, বন্দুকযুদ্ধের পরিবর্তে পুলিশ যদি লাঠি-বাঁশি অপারেশনের পরিকল্পনা করে থাকে, মন্দের ভালো। অন্তত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার পাওয়ার সুযোগ থাকবে। পুলিশ বলছে, ওই লাঠি আক্রমণের জন্য নয়, আত্মরক্ষার জন্য। তাহলে তো ভালো, খুব ভালো। কিন্তু লাঠি যে কে কার মাথায় মারবে, সেটা কে পাহারা দেবে? পুলিশ তো লাঠি দিয়েই খালাস। তারপর কেউ ডাক দিল আর পিল পিল করে লোকজন লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল, হুজুগের মাথায় নিরীহ কারও মাথা ফাটিয়ে দিল। এসব হাঙ্গামা সামলাবে কে? পুলিশ কি পূর্বাপর সব বিবেচনা করেই লাঠি-বাঁশির চাল দিচ্ছে? আরও প্রশ্ন হচ্ছে লাঠি-বাঁশি কি বিচার? না, বিচার না, কিন্তু জনপ্রতিরোধের একটা ব্যবস্থা। এটা সুশৃঙ্খলভাবে না চালানো হলে সমস্যা আছে। আত্মরক্ষার যে কথা পুলিশ বলছে, সেটা যদি ঠিক ঠিক পালন করা হয়, তাহলে অবশ্য দোষ নেই। কিন্তু এই সুযোগে গণ-অরাজকতা শুরু হবে কি না, সেটা দেখতে হবে। লাঠি-বাঁশির খবরে মনে পড়ল নাটোরে প্রায় দেড় যুগ আগে গড়ে ওঠা লাঠি-বাঁশি আন্দোলনের মূল নেতা আবদুস সালামের কথা। আমরা মনে করতে পারি যে তাঁর নেতৃত্বে ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে নাটোরে লাঠি-বাঁশি সমিতি সফল ভূমিকা পালন করেছিল। তখন সেখানে নির্বিচারে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি চলছিল।
নাটোরের ব্যবসায়ীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লাঠি-বাঁশি আন্দোলন গড়ে তোলেন। কোথাও কেউ চাঁদাবাজি করতে গেলেই বাঁশিতে ফুঁ, আর সঙ্গে সঙ্গে দলে দলে লাঠি হাতে ব্যবসায়ীরা এসে হাজির। কাউকে মারধর না, কারও মাথা ফাটানোর ব্যাপার নেই। একজোট হয়ে রুখে দাঁড়ানোই যথেষ্ট। হাতের লাঠি শুধু মনের জোর আনার ব্যবস্থা মাত্র। সেই ১৯৯৯ সালে ছিল আওয়ামী লীগ সরকার। সে সময় সরকার এবং বিরোধী দল, বিএনপির নেতারাও এই লাঠি-বাঁশি আন্দোলনকে সমর্থন করেন। কারণ, ব্যবস্থাটা সুফল দিচ্ছিল। প্রথম দিকে যেখানে নাটোর থানায় মাসে সোয়া দু শ-আড়াই শ মামলা হতো, ধীরে ধীরে তা কমে আসে। কয়েক বছরের মধ্যে থানায় অপরাধের মামলার সংখ্যা কোনো কোনো মাসে প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এল। কিন্তু বিএনপির আমলে লাঠি-বাঁশির সাফল্য সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠল। ২০০৫ সালে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় সবাই বললেন, নাটোরে লাঠি-বাঁশির আর প্রয়োজন নেই। কারণ, তাঁদের কাজের ফলে নাটোরে সন্ত্রাস দূর হয়ে গেছে। আর তা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা দেখার জন্য তো পুলিশই রয়েছে, তাহলে লাঠি-বাঁশির দরকার কী? এরপর লাঠি-বাঁশি সমিতির মূল নেতা আবদুস সালামসহ অন্য নেতাদের সরিয়ে দিয়ে একটি অ্যাডহক কমিটি গঠন করে ওই আন্দোলনের সমাধি রচনা করা হলো। আমি মোবাইলে কথা বললাম সালাম সাহেবের সঙ্গে। তিনি বললেন,
লাঠি-বাঁশি সত্যিই সফল হতে পারবে, যদি তা জনগণের নিজস্ব ব্যবস্থা হিসেবে দাঁড় করানো যায়। সাধারণ মানুষ নিজস্ব মেধা, প্রজ্ঞা ও শক্তি দিয়ে নিজেদের সংগঠন হিসেবে দাঁড় করালে সেটা সফল হবে। এখন যেটা হচ্ছে, সেখানে লাঠি-বাঁশি আছে বটে, কিন্তু তাতে প্রাণ নেই। অর্থাৎ এটা আসছে পুলিশ, তথা প্রশাসনের উদ্যোগ হিসেবে; সাধারণ মানুষের উদ্যোগ হিসেবে এখনো আসেনি। পুলিশ কেন মানুষকে লাঠি দেবে? সাধারণ মানুষের কি একটা করে লাঠি সংগ্রহ করার সামর্থ্য নেই? আবদুস সালামের নাটোরের লাঠি-বাঁশি আন্দোলন দেশের জন্য একটি মডেল হিসেবে দাঁড় করানো যায়। এর মূল কথা হলো, লাঠি-বাঁশির উৎস সাধারণ মানুষ। আর প্রশাসন সেখানে পাশে থাকবে। মানুষ যখন প্রাণশক্তিতে জেগে ওঠে, তখন বিশৃঙ্খলা দূরে চলে যায়। সুশৃঙ্খল আন্দোলন তখনই গড়ে ওঠে, যখন তার পেছনে তৃণমূলের উদ্যোগ থাকে। আমরা উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই রোধে পাড়ায় পাড়ায় আক্ষরিক অর্থেই লাঠি-বাঁশি কমিটি গঠন করেছিলাম। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে প্রতিটি পাড়ায় ছাত্রদের নেতৃত্বে আমরা গড়ে তুলি রাত জেগে পাহারার ব্যবস্থা। যেন কেউ খুনখারাবি বা চুরি-ডাকাতি করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলন নস্যাৎ করতে না পারে। মানুষের অফুরন্ত সমর্থনই ছিল আমাদের লাঠি-বাঁশি ব্যবস্থার প্রাণ। সেটা ছিল অন্য মেজাজের আন্দোলন।
সাধারণ মানুষ ছিল ৬ দফা, ১১ দফার পক্ষে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গর্জে উঠেছিল বাংলাদেশ (পূর্ব বাংলা)। এরই ধারাবাহিকতায় শুরু হলো স্বাধীনতার সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। আমরা স্বাধীন হলাম। ৩০ লাখ বাঙালির রক্তে রঞ্জিত এই বাংলাদেশ কি জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসীদের হাতে পরাজিত হবে? আমরা কি তা মেনে নেব? না, আমরা কখনোই তা মেনে নিতে পারি না। প্রতিরোধ গড়ে তুলব। কিন্তু সেটা হতে হবে আইনের পথে। গণতন্ত্রের পথে। আমরা তো দেখেছি জনগণ এমনকি জীবন বাজি রেখেও হত্যাকারীদের ধরে ফেলছে। সম্প্রতি মাদারীপুরে একজন অভিযুক্ত জঙ্গি ঘাতক ফয়জুল্লাহ ফাহিমকে জনতা হাতেনাতে ধরে পুলিশে দিল। এর আগেও ঢাকার বেগুনবাড়ীতে তৃতীয় লিঙ্গের একজন সাহসী ব্যক্তি ঘাতক জঙ্গিকে ধরে ফেলেন। তাঁর সাহসের তারিফ করি। কিন্তু পুলিশ কী করল? বেগুনবাড়ীতে জঙ্গি হামলায় নিহত ওয়াশিকুরের হত্যাকারীর বিচার কত দূর? পুলিশ কি তাঁর বিচারের অগ্রগতি সময়-সময় জনগণকে দয়া করে জানাবে? ফাহিমের কথা কী বলব। বিচারের আগেই তিনি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হলেন। কেউ জানতে পারল না কোথা থেকে কে বা কারা কলকাঠি নাড়ছে। কে কিশোর-তরুণদের মাথা খাচ্ছে, খুনোখুনির নেশার সর্বনাশা পথে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা বলি, ‘ক্রসফায়ার’ নিপাত যাক। সেখানে লাঠি-বাঁশি আন্দোলন জনতার সুশৃঙ্খল প্রতিরোধ হিসেবে গড়ে উঠুক। তবে সেটা পুলিশের প্রজেক্ট হলে সফল হবে না। একে হতে হবে জনতার আন্দোলনের একটি রূপ। আমাদের সামনে রয়েছে নাটোরের লাঠি-বাঁশি মডেল। সরকার তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.