মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর সুপারিশ ট্যারিফ কমিশনের

অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি পর্যায়ে ধার্যকৃত মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এক স্তরে দেয়া-নেয়ার সুযোগ আরও এক বছর বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে এ সংক্রান্ত সুপারিশ করে চিঠি দিয়েছে। আগে ভোজ্যতেল বাজারজাতের ক্ষেত্রে আমদানি, উৎপাদন এবং ব্যবসায়ী পর্যায়ে পৃথকভাবে তিন স্তরে এ ভ্যাট আদায় করা হতো। সংশ্লিষ্টদের মতে, ভ্যাট আদায়ের এ পদ্ধতি জটিল। এতে রাজস্ব আদায়ে ফাঁক-ফোকরেরও সুযোগ রয়েছে। একইসঙ্গে ব্যবসায়ীকে এর মাধ্যমে হয়রানি ও ভোগান্তির মুখেও পড়তে হতো। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে গত বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশে তিন স্তরের পরিবর্তে এক স্তরে ভ্যাট আদায়ের প্রথা চালু করা হয়। এর মেয়াদ চলতি বছরের ৩০ জুন শেষ হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে হাতে প্রায় তিন মাস বাড়তি সময় রেখেই চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশে ভোজ্যতেলের সরবরাহ লাইন স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন এ সুপারিশ করল।
জানা গেছে, বাণিজ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ২০১৪ সালের ৯ জুন অনুষ্ঠিত এক সভায় তিন স্তরের পরিবর্তে একস্তরে ভ্যাট সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত হয়। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন সে সময়ও একই ধরনের সুপারিশ করেছিল। এ সুপারিশ আমলে নিয়েই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গতবছর ১৬ ফেব্র“য়ারিতে এ সংক্রান্ত দুটি প্রজ্ঞাপন (এসআরও) জারি করে। আর সে প্রজ্ঞাপনের এখতিয়ারের আওতায় তখন থেকেই উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট আদায় অব্যাহতি দেয়া হয়। একইসঙ্গে শুধুমাত্র আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট আরোপের বিষয়ে আদেশ জারি করা হয়। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আসা ট্যারিফ কমিশনের এক চিঠিতে ভোজ্যতেলের আমদানি পর্যায়ে একস্তরে ভ্যাট গ্রহণের সুযোগ চলতি বছরের ৩০ জুন থেকে বাড়িয়ে আগামী ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ এক বছর বাড়ানোর পক্ষে মতামত দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে জানান, তিন স্তরের পরিবর্তে একস্তরে ভ্যাট আদায়ের সিদ্ধান্তটি আগেই সেটেলড একটি বিষয়। তবে এর মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। ব্যবসায়ীদের দাবি ও সামনে রমজানের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে ভোজ্যতেলের মজুদ ও দাম স্বাভাবিক রাখতে ট্যারিফ কমিশন এ সুপারিশ করেছে। তিনি দাবি করেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেশের ভোক্তাসাধারণের স্বার্থ ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতি গতিশীল রাখতে এ ধরনের সুপারিশ সব সময় ইতিবাচক হিসেবেই দেখে থাকে।
জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এ সংক্রান্ত চিঠিতে কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও বাণিজ্য নীতি সদস্য শেখ আবদুল মান্নান বলেছেন, বর্তমানে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানিতে তিন স্তরের পরিবর্তে শুধু আমদানি পর্যায়ে এক স্তরে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। আগে এর আমদানি পর্যায়ে শুল্কায়নযোগ্য মূল্যের ওপর (অ্যাসেসেবল মূল্য) ১০ শতাংশ অথবা শুল্কায়নযোগ্য মূল্যের ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশের ওপর ১৫ শতাংশহারে ভ্যাট নেয়া হতো। একই সঙ্গে উৎপাদন পর্যায়ে ট্যারিফ মূল্য নির্ধারণ ছিল সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে ৪১১০ টাকা ও পামঅয়েলের ক্ষেত্রে ৩৭০০ টাকা। এ ট্যারিফ মূল্যের ওপর ভিত্তি করে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করা হতো। তাছাড়া ব্যবসায়ী পর্যায়ে ৪ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করা হতো। কমিশনের বাণিজ্য নীতি সদস্য শেখ আবদুল মান্নান অভিমত দিয়ে আরও বলেন, সরকারিভাবে তিন স্তরের ভ্যাট আহরণ করা জটিল পদ্ধতির। এতে ব্যবসায়ীদের জন্যও যেমন অসুবিধার সৃষ্টি করে, তেমনি সার্বিক প্রক্রিয়ায়ও কালক্ষেপণ হয়। অনেক ক্ষেত্রে তা ভোজ্যতেলের সরবরাহ লাইনেও সমস্যার সৃষ্টি করে।
এ বিষয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহাও জানান, তিন স্তরে ভ্যাট আরোপ করা হলে উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট প্রদানের সময় তাদের বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তির শিকার হতে হয়। বিশেষ করে পণ্য পরিবহনের সময় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ভোজ্যতেল পরিবহনকারী যানবাহনকে বিভিন্ন ধরনের হয়রানি করে। এর ফলে প্রায়শ বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহ লাইনে সংকট দেখা দেয়। তার মতে, তিন স্তরে প্রদানকৃত ভ্যাট এক স্তরে প্রদান করা হলে সরকার ১৫ শতাংশ ভ্যাট নিশ্চিতভাবে পেয়ে থাকে। এ কারণে এক স্তরে ভ্যাট প্রদান করাই যৌক্তিক। তিনিও মনে করেন, এর মেয়াদ আগামী ২০১৭ সালের ৩০ জুন অর্থাৎ আরও এক বছর বৃদ্ধি করা উচিত। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের উপসচিব মো. হারুন অর রশিদ বলেন, এক স্তরের পদ্ধতি সরকার এবং ব্যবসায়ী দু’পক্ষের জন্যই আদান-প্রদানে সুবিধাজনক। তাই এটির মেয়াদ বৃদ্ধি করা যেতেই পারে। তবে এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ট্যারিফ কমিশনের এ প্রস্তাব সময়োচিত। তবে আমরা মনে করি, এর মেয়াদ বছর বছর না বাড়িয়ে স্থায়ীভাবেই এটি এক স্তরে চালু করা উচিত। কারণ আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট সংগ্রহের সময় মূল্য বিবেচনায় আনলে সেটি সরকারের জন্যই লাভজনক হবে। এছাড়া ব্যবসায়ী পর্যায়ে ৪ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায়ের বিষয়টিও সব সময় নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে উঠে না।

No comments

Powered by Blogger.