আমি মাহফুজ আনামের পক্ষের কেউ নই by সিদ্দিকুর রহমান খান

‘খড়গ হস্তে নৃত্য কর জল্লাদ সময়/তোমার সুস্থির হওয়া বড় প্রয়োজন/সকলে বিশদ জানে তবু  হয় অন্ধকারে খুন/অস্ত্রহীন তাই  কেউ বিনা খুনে দায়ভাগী হয়।’ ৪০ বছর আগে লেখা কবি ও সমাজবিজ্ঞানী আহমদ ছফার ‘জল্লাদ সময়’ কবিতার ওই লাইনগুলোর আবেদন আজকের বাংলাদেশের জন্যও জ্বলজ্যান্ত।
ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডে ও  দৈনিক নিউএইজের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এ জেড এম এনায়েতুল্লাহ খানের মৃত্যুতে  শোকাহত ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম তাঁর নিজ পত্রিকার প্রথম পাতায় লিখেছেন ‘আমাদের কালের সেরা সম্পাদককে’ হারালাম। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই নভেম্বর দেহত্যাগ করা এনায়েতুল্লাহ খানের প্রসঙ্গ কেন আনলাম তার কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা দিয়ে  লেখাটা শুরু করছি। শুরুতেই বলে নিচ্ছি মাহফুজ আনামের পক্ষের আমি কেউ নই।
২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে নিউএইজের জন্মের সময় থেকেই আমি ছিলাম। ওই সময়ে জুনিয়র ও তস্য জুনিয়র প্রতিবেদক ও সহকারী সম্পাদকদের আলাপ-চারিতায় সমকালীন সেরা সম্পাদক কে তা নিয়ে তর্কে মাহফুজ আনামকে এগিয়ে রাখতেন অনেকে। মাহফুজ আনামকে সেরা অভিহিত করার দলে বিদগ্ধদের তুলনায় তরুণরা  বেশি ছিল। তরুণরা হয়তো বিবেচনা করতেন ডেইলি স্টার ইতিমধ্যে লব্ধ প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা। মাহফুজ আনাম যার সম্পাদক। বিদেশে থেকেছেন, জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। এস এম আলী প্রতিষ্ঠা করেছেন ডেইলি স্টার ইত্যাদি ইত্যাদি। অপরদিকে নিউএইজ নতুন পত্রিকা এনায়েতুল্লাহ খান যার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। খানের মৃত্যুর পর  ডেইলি স্টারের প্রথম পাতায় লেখা বিশেষ সম্পাদকীয়তে ‘আমাদের কালের সেরা সম্পাদক’ লিখে সেরা সম্পাদক বিতর্কের যবনিকাপাত ঘটিয়েছেন সমসাময়িক অপর সেরা সম্পাদক মাহফুজ আনাম।
পাঠক, এনায়েতুল্লাহ খান গত হওয়ায় আপনাআপনি মাহফুজ আনাম সেরা সম্পাদকের তকমাটি  পেয়ে গেলেন কি-না তা ব্যাখ্যা করতে দুটি ছোট্ট গল্প শোনাই।
এক কৃষকের ২১টি ফল-ফলাদির বাগান ও শস্যক্ষেত ছিল। এর মধ্যে একটি করে আঙ্‌গুর ও  বেদানার বাগান, আর বাদবাকিগুলো ধনচে ক্ষেত। ধনচের মধ্যে বাংলা ও ইংরেজি জাত রয়েছে। সবচাইতে বেশি অর্থ  যোগানদাতা ওই আঙ্‌গুর ও  বেদানার বাগান দুটি রক্ষার চিন্তায় রাতে কৃষকের ঠিকমতো ঘুম আসতো না। চোর, চুন্নি, টাউট, বাটপার, জল্লাদ ঠেকাতে লোহা-বাঁশ-কাঠ ইত্যাদির বেড়া নির্মাণ করতে হতো। বেতন দিয়ে নৈশ প্রহরী নিয়োগ দিতে হয়েছে কিন্তু ধনচে ক্ষেত রক্ষায় কোনো খরচ ছিল না কৃষকের। কারণ ওগুলো গরুর খাবার আর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার জন্যই।
দ্বিতীয় গল্পটি এরকম। যুদ্ধের মধ্যে এক দেশে হামলাকারী মিলিটারির ভয়ে তরুণীরা দলে দলে শহর  ছেড়ে গ্রামে পালাচ্ছিলেন। সঙ্গে ক’জন বুড়িও জুটলো। বুড়িদের প্রতি তরুণীদের প্রশ্ন ‘ও বুড়িরা  তোমরা কেন পালাও? তোমাদের কীসের ভয়?’ বুড়িদের জবাব মিলিটারির দলে বুড়ো মিলিটারিও  তো রয়েছে।
পাঠক, লেখাটির শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। ২০০৭-০৮ বছর দুটিকেও ছফা বর্ণিত জল্লাদ সময়ের সঙ্গে তুলনা করা যায় এই অর্থে যে ওই সময়ে ‘আহসান মঞ্জিলের পুকুরে জ্যান্ত কুমির পাওয়া যেত, রাস্তায় পড়ে থাকতো  কোটি টাকা দামের মালিকবিহীন হ্যামার, জাগুয়ার গাড়ি। ওই জল্লাদ সময়ে নানা বাহিনী তাদের নানাবিধ প্রয়োজনে টার্গেট করেছিল জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী পত্রিকাগুলোকে। মাহফুজ আনামের ডেইলি স্টার ছিল অন্যতম প্রধান টার্গেট। জল্লাদ সময়েও তিনি সাংবাদিকতার ন্যূনতম এথিকস মেনেছিলেন। সশস্ত্র ব্যক্তিদের সরবরাহ করা প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে কিছু কিছু প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এও বলে দিয়েছেন যে ‘এ প্রতিবেদনগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই-বাছাই না করেই প্রকাশ করতে হলো’। অর্থাৎ সম্পাদকীয় ওই ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশে-বিদেশে ডেইলি স্টারের বুদ্ধিমান পাঠকেরা বুঝে নিয়েছেন ওইসব প্রতিবেদনের তথ্যগুলো।

No comments

Powered by Blogger.