দেশে পা রেখেই হাউমাউ করে কাঁদছেন অনেক হাজি by ফয়েজ উল্লাহ ভূঁইয়া

সাতক্ষীরার দেবহাটার জগন্নাথপুরের হাজী আব্দুল কাদের মিনার দুর্ঘটনার কবলেই পড়ে গিয়েছিলেন। দুর্ঘটনায় যেখানে মানুষের ওপর মানুষের স্তুপ পড়েছিল সেই স্থানের সামান্য পিছনেই তিনি তার গ্রুপের অপর ৩২ জনের সাথে মিনায় বড় শয়তানকে পাথর মারার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলেন। হঠাৎ হুড়াহুড়ি শুরু হলে সামনে পিছনে কোনোদিকেই যেতে পারছিলেন না। এসময় সবাই প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ হয়ে দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার অবস্থা। অনেকে পানি পানি, বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিলেন। অনেকে তাকবির ধ্বনি দিচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে আব্দুল কাদের জ্ঞান হারিয়ে নিচে পড়েও যান। কিন্তু তার গ্রুপের দুইজন সাথে সাথেই তাকে তুলে কোনোভাবে পাশে নিয়ে নিতে সক্ষম হয়। তার সাথে থাকা বোতলের পানি চোখে মুখে ছিটানোর পর তার জ্ঞান ফিরে। ততক্ষণে সামনে মানুষের স্তুপ রাস্তায়। রাস্তায় পড়ে থাকা হাজিদের ডিঙিয়েই দুইজনের কাঁধে ভর করে হাজি আব্দুল কাদের তার অপর কয়েকজন সঙ্গীসহ সামনে এগিয়ে যান। কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েই কোনোভাবে পাথর নিক্ষেপ করে মক্কায় চলে যান। মসজিদুল হারামেই সারারাত কাটিয়ে দেন। পরের দুইদিন আর পাথর মারতে যেতে পারেননি। অন্যদের দিয়ে পাথর মারিয়েছেন। মিনার সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়তে গিয়ে অল্পের জন্য বেঁচে আসা হাজী আব্দুল কাদের আজ শুক্রবার বিকেলে সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছেই সাংবাদিকদের কাছে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। এসময় তার সাথে থাকা স্ত্রীও তার বক্তব্যের পক্ষে মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছিনে। গ্রুপের অপর হাজি ফজলুর রহমানও ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, অবস্থা এমন ছিল যে, কোনোভাবেই সেই স্থান ত্যাগ করাটাই ছিল সবার লক্ষ্য ফলে নিচে যে অনেক হাজি পড়ে আছে সেটি খেয়াল করার মত অবস্থাও ছিল না।
এভাবেই হজ পালন শেষে দেশে ফেরা হজযাত্রীদের বেশিরভাগই প্রতিদিনই বিমান বন্দরে পা রেখেই মক্কার অদূরে মিনায় গত ২৪ সেপ্টেম্বর সংঘটিত পদদলিত হয়ে হাজিদের হতাহত হওয়ার সেই ঘটনার বিষয় সাংবাদিক ও আত্মীয় স্বজননের কাছে জানাচ্ছেন। সেই দু:সহ ঘটনা হাজীদের এখনো তাড়া করে ফিরছে। ঘটনার পর হতাহতের খবরে হাজিদের মধ্যে যে আতঙ্ক ও শঙ্কার জন্ম দিয়েছে সেটি অনেকে ভুলতে পারছেন না। অনেকে দুর্ঘটনার কিছু আগেই পাথার মেরে মক্কার দিকে রওয়ানা হওয়ার পরই ঘটনার খবর শুনেন। আবার এমন অনেকে জামারাতে পৌঁছানোর পরই দুর্ঘটনার খবর জানতে পারেন-এমন বণর্ণা দিচ্ছেন।
আজ শুক্রবার জুমার নামাজের পর হজযাত্রীদের নিয়ে সৌদি এয়ারলাইন্সের দুটি ও বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ করে। দেশে ফেরার পর অনেকে বড় ধরণের অসুবিধা ছাড়াই হজ পালন করতে পারার জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছিলেন। অনেকে আত্মীয় স্বজনদের জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠছিলেন। অনেকে মিনার ঘটনার উল্লেখ করে আহত নিহতদের জন্য দোয়া করে সমবেদনা জানাচ্ছিলেন। নিজেরাও এমন দুর্ঘটনার শিকার হতে পারতেন এমন আশঙ্কার কথাও তারা বলছিলেন। অনেকে মিনার দুর্ঘটনাটি ছাড়া সার্বিক হজ ব্যবস্থাপনার প্রশংসা করছিলেন। কেউ কেউ মিনার দুর্ঘটনার জন্য অব্যবস্থাপনাকেও দায়ী করছিলেন। তবে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ কেউই বলতে পারছিলেন না। কেউ বলছিলেন কয়েকটি রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে হজযাত্রীদের সরু একটি রাস্তার দিকে পাঠিয়ে দেয়ার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে। কেউ বলছিলেন বিপরীত দিক থেকে কিছু লোক আসার কারণে হুড়োহুড়ি ও পদদলিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। প্রায় সবাই একে অপরের কাছে শোনা কথাকে উদ্ধৃত করছিলেন।
রাজধানীর ধানমণ্ডির হাজী রকিবুল হাসান মিনার দুর্ঘটনার মাত্র দুই মিনিট আগেই জামারাতে পৌছান। দূর থেকে তিনি দাঁড়িয়ে দুর্ঘটনাটি দেখারও চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, আর দুই মিনিট পরে হলে তিনি নিজেও মারা যেতেন। ঘটনাকে অত্যন্ত ভয়াবহ আখ্যায়িত করে বলেন, এখনো কিছুতেই ঘটনাটি ভুলতে পারছিনা। পিরোজপুরের হাজি দেলোয়ার হোসেন বের হয়ে হেসেই আত্মীয় স্বজনকের জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কান্নাকাটি করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, মিনায় যারা মারা গেছেন তাদের একজন আমিও হতে পারতাম। আল্লাহ আমাকে সুস্থ্যভাবে ফিরিয়ে এনেছেন। যারা মারা গেছেন তাদের আপনজনদের কি অবস্থা সেটা আমি বুঝতে পারি। তিনি জানান, তারা সামনে চলে যাওয়ার পরই পিছনে ঘটনাটি ঘটেছে। প্রচণ্ড গরমে একজন আরেকজনের ওপর পড়ে যাওয়ার কারণে দম বন্ধ হয়েই বেশির ভাগ হাজি মারা গেছেন বলে তিনি মনে করছেন।
রাজধানীর গোপীবাগের হাজি মিয়া হোসেন এসেই ছেলে সন্তান আত্মীয় স্বজনদের জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছিলেন।
তিনি বলেন, মিনায় যারা মারা গেছেন তাদের ছেলে মেয়েরাওতো আজকে তাদের জন্য এভাবে বিমান বন্দরে আসতো। একথা মনে করে আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। ঢাকা নবাবপুরের জাহিদ হাসান বলেন, আসলে দুর্ঘটনা কি জন্য ঘটেছে সেটা আমরা লোকমুখে শুনেই বলছি। কেউ বলছে সৌদি প্রিন্সের জন্য রাস্তা বন্ধ করে দেয়ার কারণেই এটা ঘটেছে।
তবে সাতক্ষীরার হাজি আব্দুল কাদেরের সঙ্গী ফজলুর রহমান বলেন, কয়েকটি হুইল চেয়ারের ওপর মানুষ পড়ে যাওয়ার কারণে ঘটনাটির সূত্রপাত হয়। মানুষ তখন একজন আরেকজনের ওপর পড়তে থাকে। তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সময় কি পরিমান মানুষকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছেন- জানতে চাইলে ফজুলুর রহমানও আব্দুল কাদের এক সাথেই বলেন, সেটা বলতে পারব না। সে দিকে খেয়াল করার মতোও অবস্থা ছিল না।
বাংলাদেশ বিমানের যাত্রীদের ভোগান্তি
এদিকে সৌদি এয়ার লাইন্সের সব হজ ফ্লাইট প্রায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ছেড়ে আসলেও বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাটটের সময় কোনোভাবেই ঠিক থাকছে না। ৩০ সেপ্টেম্বরের নির্ধারিত একটি ফ্লাইটের হজিদের দুইদিন পর আজ বিকেলে একটি ফ্লাইটে আনা হয়। সেই ফ্লাইটটিও সাড়ে চারঘণ্টা বিলম্বে ছাড়ে। এসব হজি ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে পুরো একদিন জেদ্দা হজ টার্মিনালে অপেক্ষা করার পর এক পর্যায়ে তাদেরকে জেদ্দায় একটি হোটেলে নিয়ে রাখা হয় বলে ফ্লাইটের যাত্রী ধানমন্ডির হাজি আব্দূল লতিফ জানান।
তিনি বলেন, হজ টার্মিনালে হজিদের কষ্ট দেখার কেউ নেই। আমি মনে করি সরকার ও হজ মিশনকে সেখানে হাজিদের খোঁজ খবর নেয়ার দিকে নজর দেয়া উচিত। তিনি বলেন, হজ টার্মিনালে এমন অবস্থা যে, একটু পানিও পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশ বিমানের হজ ফ্লাইটের ভোগান্তির কথা জানিয়ে অপর যাত্রী আহমেদ ফারুক এই প্রতিবেদককে জানান, তার ফ্লাইট ছিল সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে। কিন্তু তাদেরকে জানানো হয় সেটি সৌদি সময় রাত ৯টায় ছাড়বে। এটা জানার পর সাথে থাকা মায়ের কথা বলে অনেক অনুরোধ করে অবশেষে বিকেল তিনটায় ঢাকায় অবতরণ করা ফ্লাইটে আসতে সক্ষম হন বলে জানান।
ফ্লাইটের অপর হজিরা জানান, জেদ্দা হজ টার্মিনালে এখনো সহস্রাধিক বাংলাদেশি হাজি ফ্লাইটের অপেক্ষায় কষ্ট করছেন।

No comments

Powered by Blogger.