কারাগারে ঈদ কাটবে যাদের by কাফি কামাল

কারাগারে ঈদ কাটবে অর্ধশতাধিক শীর্ষস্থানীয় বিরোধী রাজনৈতিক নেতার। কয়েকজন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বসহ সাবেক শীর্ষস্থানীয় একাধিক পেশাজীবীরও ঈদ কাটবে চার দেয়ালের মাঝে। এছাড়া সারা দেশের তৃণমূল পর্যায়ের হাজার হাজার নেতাকর্মী ঈদ কাটাবেন কারাগারের একচিলতে উঠোন আর সেলে সেলে। কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠেই যাদের অনেকের কেটেছে বিগত ২-১৬টি ঈদ। তাদের কারও সাজা হয়েছে, কেউ রয়েছেন বিচারপ্রক্রিয়ায়। সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ অনেক ভিআইপি বন্দির ঈদ আনন্দ এবারও গুমরে মরবে কনডেম সেলের ছোট্ট পরিসরে। বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বেশিরভাগই রয়েছেন কাশিমপুর কারাগার, কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ঈদের পরদিন তারা অপেক্ষায় থাকবেন কবে সাক্ষাৎ করতে যাবেন তাদের পরিবারপরিজন ও স্বজনরা। কারাবন্দি বিরোধী দল ও মতের রাজনীতিক এবং সাংবাদিকদের অনেকেই বয়সজনিত নানা জটিল ব্যাধিতে ভুগছেন। আবার গ্রেপ্তারের পর দফায় দফায় রিমান্ডে নেয়ার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন কেউ কেউ। কিছুদিন আগে কারাগারে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে সংজ্ঞা হারান বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। রিমান্ডে নেয়ার পর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। ডিভিশন না পাওয়ায় কারাগারে দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব শারীরিকভাবে পঙ্গু রিজভী আহমেদ। সবমিলিয়ে দমবদ্ধ পরিবেশ, তিক্ত অভিজ্ঞতা আর জামিনের অপেক্ষায় প্রহর গোনার মধ্যে দিয়ে কারাগারে ঈদ কাটাবেন বিরোধী দল ও মতের রাজনীতিক নেতাকর্মীসহ কারাবন্দি পেশাজীবীরা।    
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ ছাড়াও কয়েকজন সাংবাদিক বর্তমানে কারাবন্দি রয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদকে ১৮ই আগস্ট রাজধানীর পান্থপথে সামারাই কনভেনশন সেন্টারের সামনে থেকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পেশাজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত আদর্শ ঢাকা আন্দোলনের সদস্য সচিব হিসেবে ওইদিন তিনি সেখানে একটি সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ১লা এপ্রিল দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারপতির কথোপকথন ফাঁস হওয়ার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১৫ সালের ৬ই জানুয়ারি গ্রেপ্তার হন বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের (ইটিভি) চেয়ারম্যান আবদুস সালাম। পরে ৩রা মার্চ একুশে টেলিভিশনের চাকরিচ্যুত সিনিয়র সাংবাদিক ও জনতার কথার উপস্থাপক ড. কনক সরোয়ারকে শাহবাগ থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। চার সাংবাদিকই এবার ঈদ কাটাবেন কারাগারে। এছাড়া বেশ কয়েক ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর চলতি বছরের ২৪শে ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও ঢাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না। অসুস্থ অবস্থায় তার দিন কাটছে কারাগারে।
টানা দেড় বছর ধরে কারাভোগ করছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ২০১৪ সালের ১২ই মার্চ গুলশানের বাসভবন থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইতিমধ্যে দুই রমজান ও এক কোরবানির ঈদ মিলিয়ে কারাগারেই কেটেছে তার তিনটি ঈদ। জামিন না পাওয়ায় এবারও তার কোরবানির ঈদ কাটবে কারাগারে। দীর্ঘ পৌনে ৫ বছর ধরে কারাবন্দি রয়েছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। ২০১০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর গ্রেপ্তারের পর থেকে কারাগারেই কাটছে সিনিয়র এ নেতার ঈদ। মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ইতিমধ্যে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর এবারও ঈদ কাটবে কনডেম সেলে। ওয়ান ইলেভেনের জরুরি সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ১৮ই জানুয়ারি গ্রেপ্তার হন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুস সালাম পিন্টু। সেই থেকে টানা পৌনে ৮ বছর ধরে কারাবন্দি রয়েছেন তিনি। এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের প্রথম দিক থেকেই কারাবন্দি রয়েছেন বিএনপি নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর। বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশ পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও লুৎফুজ্জামান বাবর রয়েছেন কারাগারের কনডেম সেলে। এছাড়া চলতি বছরের ১২ই ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নানকে গ্রেপ্তার করে গাজীপুরের গোয়েন্দা পুলিশ। ২০১৫ সালের ৩১শে জানুয়ারি গ্রেপ্তার হন বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ। নিম্ন আদালতে হাজিরা দিতে গেলে ২রা আগস্ট বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমানকে কারাগারে পাঠান আদালত। ২০১৫ সালের ১৬ই জুন ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজিরা দিতে গেলে কারাগারে পাঠানো হয় বিএনপি নেত্রী ও সাবেক এমপি সৈয়দা আশিফা আশরাফি পাপিয়াকে। দীর্ঘ সময়েও জামিন পাননি এ সাবেক মহিলা এমপি। জঙ্গি সংগঠন ‘শহীদ হামজা ব্রিগেড’কে আর্থিক সহযোগিতা দেয়ার অভিযোগে ১৮ই আগস্ট ধানমন্ডি থেকে গ্রেপ্তার হন বিএনপি দলীয় সাবেক হুইপ সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপি নেত্রী ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা। ফলে মহিলা দলের এই দুই নেত্রীর ঈদ কাটবে কারাগারে। এছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ জেলা বিএনপি সভাপতি ও পৌর মেয়র জি কে গউছ, চট্টগ্রাম নগর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন দিপ্তী, চাঁদপুর জেলা বিএনপি সভাপতি ও ব্যবসায়ী শেখ ফরিদ আহমেদ মানিকসহ জেলা পর্যায়ের কয়েক শ’ নেতা বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি রয়েছেন।
বিএনপি ছাড়াও দলটির অঙ্গ ও সংযোগী সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মীর ঈদ কাটবে কারাগারে। ২০১৫ সালের ২০শে জুলাই পটুয়াখালীর লেবুখালী ফেরিঘাট থেকে গ্রেপ্তার হন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজীব আহসান। দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পর চলতি বছরের ৮ই মার্চ ফরিদপুর থেকে গ্রেপ্তার হন ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন। এছাড়া ১১ই আগস্ট ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান সোহাগ। বর্তমানে তারা তিনজনই কারাগারে রয়েছেন। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী জানান, কেন্দ্রীয় ও রাজধানীর বিভিন্ন থানা কমিটির প্রায় শতাধিক ছাত্রদল নেতা বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। সারা দেশের হিসাবে কারাবন্দি ছাত্রদল নেতাকর্মীদের সংখ্যা হাজারের বেশি। ফলে ছাত্রদলের হাজারও নেতাকর্মী এবারও ঈদ কাটাবেন কারাগারে। স্বেচ্ছাসেবক দলের ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ইয়াসিন আলী গ্রেপ্তার হয়েছেন চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে। স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক আক্তারুজ্জামান বাচ্চু জানান, রাজধানীতে কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানা কমিটির প্রায় দুই শতাধিক নেতা বর্তমানে কারাবন্দি রয়েছেন। গত কয়েক মাস ধরে আইনি প্রক্রিয়ায় অনেকেই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। সারা দেশে অন্তত দেড় হাজার নেতাকর্মী এখনও কারাবন্দি। ফলে তাদের ঈদ কাটবে চার দেয়ালের মাঝে।
ওয়ান ইলেভেনের জরুরি সরকারের সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন। সেই থেকে কারাগারেই কেটেছে তার ১৮টি ঈদ। জামিন না পাওয়ায় এবারও জেলেই ঈদ কাটবে তার। এছাড়া ডিজিএফআই’র সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, এনএসআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা উইং কমান্ডার শাহাবুদ্দিন, উপ-পরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত, এনএসআইয়ের ফিল্ড অফিসার আকবর হোসেন খান, সিইউএফএলের সাবেক এমডি মহসিন তালুকদার, সাবেক মহাপরিচালক এনামুল হকের বিরুদ্ধে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় মৃত্যুদণ্ডসহ নানা মেয়াদে সাজা হওয়ায় তাদেরও ঈদ কাটবে কারাগারের কনডেম সেলে।
জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে দলটির আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমীর মাওলানা আবদুস সুবহান, নায়েবে আমীর আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, নায়েবে আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম, দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী দীর্ঘদিন ধরেই কারাবন্দি। জামায়াতের কারান্তরীণ নেতাদের মধ্যে কয়েকজন দীর্ঘ ৭ বছর ধরে কারাগারে রয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ইতিমধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। এছাড়া সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরোয়ার, চট্টগ্রাম মহানগরী আমীর সাবেক এমপি শামসুল ইসলাম, সিলেট মহানগর জামায়াতের আমীর এহসান মাহমুদ জুবায়ের, ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার হোসেন, শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও ফখরুল ইসলাম মানিকসহ সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাজারও জামায়াত নেতা বন্দি দিন কাটাচ্ছেন জেলে। দলটির কর্মী-সমর্থক পর্যায়ে এ সংখ্যা হাজার হাজার। কারাবন্দি একাধিক নেতা পরিবারের সদস্যরা জানান, ধর্মীয় নিয়ম ও সামাজিক রীতি মেনে তারাও ঈদ করবেন। তবে তাদের পরিবারে ঈদের আনন্দ বলতে কিছু নেই। তাদের জীবনে ঈদ আসে একরাশ শূন্যতা নিয়ে। ঈদের খুশির দিন তারা সিক্ত হন চোখের জলে। কারাবন্দি একাধিক নেতার পরিবারের সদস্যরা জানান, ঈদের পরদিন তারা কারাফটকে সাক্ষাৎ করতে যাবেন।

No comments

Powered by Blogger.