কিশোরগঞ্জে মাদক সেবনে বাধা দেয়ায় অটোরিকশা চালককে হাত-পা-চোখ বেঁধে পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা

বেপরোয়া সন্ত্রাসীদের নেশার আড্ডার প্রতিবাদ করতে গিয়ে অকালেই হারিয়ে গেল শামীম। মাদকাসক্ত সন্ত্রাসীদের নৃশংসতার বলি হয়ে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই পৃথিবীকে বিদায় জানাতে হলো তাকে। শরীরে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র মানুষটিকে। আগুন দেয়ার আগে শামীমকে মারপিট করে তার হাত, পা ও চোখ বেঁধে পৈশাচিক উল্লাসে মাতে ঘাতকেরা। আর্তচিৎকার আর আগুনের লেলিহান শিখা দেখে স্থানীয়রা এগিয়ে গেলেও তারা বাঁচাতে পারেননি শামীমকে। কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়ার পথে ভৈরবের কালিকাপ্রসাদ এলাকায় বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে শামীম। পৈশাচিক এ ঘটনাটি ঘটেছে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার যশোদল ইউনিয়নের আমাটি শিবপুর গ্রামে। নিহত শামীম আমাটি শিবপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেনের ছেলে। এদিকে এ ঘটনায় জড়িত চার দুর্বৃত্তের মধ্যে হোতা জনিকে শুক্রবার বিকালে মিঠামইনের গোপদিঘি ইউনিয়নের খাসাপুর গ্রামের মীরফত আলী মীর নামে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে করিমগঞ্জের ন্যামতপুর এলাকা থেকে সহযোগী সাজনকে কৌশলে আটক করে পুলিশ। নিহতের চাচা মানিক মিয়া বাদী হয়ে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় দায়ের করা মামলার দুজনেই এজাহারভুক্ত আসামি। এদের মধ্যে জনি একই এলাকার ইসলাম উদ্দিনের ছেলে এবং সাজন প্রতিবেশী লাল মিয়ার ছেলে।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, নিহত শামীমের বাড়ির পাশের গুনু মিয়ার ফিশারির পাড়ে স্থানীয় কয়েক সন্ত্রাসী নিয়মিত মাদকের আসর বসাতো। শামীম তাদের নিষেধ করায় এ নিয়ে প্রায়ই ওই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তার কথাকাটাকাটি হতো। একইভাবে গত বুধবার ফিশারির পাড়ে মাদকের আসর জমালে শামীম তাদের বাধা দেয়। এ সময় স্থানীয় চার সন্ত্রাসী জনি, আল-আমিন, শফিক ও সাজন তাকে মারধর করে। এর জের ধরে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে শামীম অটোরিকশা চালানো শেষে শহর থেকে বাড়ি ফেরার পথে জনি, আল আমিন, শফিক ও সাজন তাকে ফিশারিতে ধরে নিয়ে যায়। এ সময় শামীমকে মারপিট করে তার হাত, পা ও চোখ বেঁধে গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় শামীমের আর্তচিৎকারে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে গিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যালে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকায় নেয়ার পথে রাত সাড়ে ১২টার দিকে শামীম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এদিকে শামীম হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার দারি করে গতকাল শুক্রবার সকালে এলাকাবাসী বিক্ষোভ মিছিল করেছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জনির মা ও আল আমিনের মা এবং স্থানীয় দুই যুবকসহ চারজনকে আটক করেছে পুলিশ।
কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক মনোজ কুমার রায় জানিয়েছেন, ভিকটিমের শরীরের ৭০ ভাগ পুড়ে যাওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছিল।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, শামীমের পিতার নাম জাহাঙ্গীর হোসেন। প্রায় ১২ বছর আগে শামীমের মা আমেনা আক্তার মারা যায়। মাতৃহীন শামীম দরিদ্রতার মাঝে বড় হলেও ছিলেন খুবই মিশুক প্রকৃতির। যে কারণে এলাকার সবার প্রিয় ছিল সে। পিতা জাহাঙ্গীর হোসেন দ্বিতীয় বিয়ে করেন। শামীম তার সৎমা পারভীন আক্তারের কাছেও খুব প্রিয় ছিল। সৎমা পারভীন আক্তারের তৃতীয় শ্রেণী পড়ুয়া সুরমা (১০) নামে একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। সুরমাকেও শামীম নিজের বোনের মতোই দেখতো।
গ্রামের চাচা সম্পর্কের বিল্লাল মিয়া বলেন, শামীম বড় ভালো ছেলে ছিল। শামীমের বাবা বর্তমানে মানসিক ভারসাম্যহীন। পরিবারের রুটি-রোজগারের কথা চিন্তা করে সে অটোরিকশা চালানোর কাজ শুরু করে। এর মাধ্যমে তাদের সংসার ভালভাবেই চলে যাচ্ছিল।
এদিকে শামীমের মৃত্যুর খবরে পিতা জাহাঙ্গীর হোসেন একেবারেই নির্বাক হয়ে যান। সৎমা পারভীন আক্তার বারবার মূর্ছা যান। ছোট বোন সুরমা বারবার ও-ভাই ও-ভাই করে ঢুকরে কেঁদে ওঠে। স্বজনেরা সান্ত্বনা দিতে গিয়ে চোখের জল ফেলেন। স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে এলাকার পরিবেশ।
এদিকে নিহত শামীমের লাশ ময়নাতদন্তশেষে শুক্রবার বিকালে আমাটি শিবপুর গ্রামে নিয়ে আসার পর সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। মাগরিবের নামাজের পর স্থানীয় গোরস্তান মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে সংলগ্ন গোরস্তানে দাফন করা হয়।
অন্যদিকে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের চাচা মানিক মিয়া বাদী হয়ে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা করেছেন। গতকাল শুক্রবার দুপুরে দায়ের করা মামলায় একই এলাকার ইসলাম উদ্দিনের ছেলে জনি, মন্নাছ মিয়ার ছেলে আল-আমিন, চাঁন মিয়ার ছেলে শফিক ও লাল মিয়ার ছেলে সাজনের নামোল্লেখ এবং অজ্ঞাত ৫/৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মীর মোশারফ হোসেন জানান, এরই মধ্যে প্রধান আসামি জনি এবং এজাহারভুক্ত আসামি সাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিরা পলাতক রয়েছে। তাদের ধরতেও সম্ভাব্য স্থানসমূহে অভিযান চালানো হচ্ছে। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাদেরও গ্রেপ্তার সম্ভব হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কিশোরগঞ্জে নেশার ছোবল দিন দিনই বাড়ছে। হাত বাড়ালেই মিলছে সব ধরনের মাদক। শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামেও মাদকাসক্তদের সংখ্যা ও মাদক সন্ত্রাস ক্রমশ বাড়ছে। গত ৬ই সেপ্টেম্বর সদর উপজেলা ও পৌর কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সম্মেলনে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মীর মোশাররফ হোসেন নিজেও মাদক সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে গত ৩০শে মে রাতে কিশোরগঞ্জ জেলা সদরে মাদক কেনার জন্য টাকা ছিনিয়ে নিতে না পেরে শাওন (২৮) নামে স্থানীয় এক সন্ত্রাসী ঠেলাচালককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। শহরের আরজত আতরজান উচ্চবিদ্যালয়ের পূর্বপাশের সড়কে তাজুল ইসলাম কালা মিয়া (৪০) নামের ওই ঠেলাচালককে বাঁচাতে গিয়ে শফিকুল ইসলাম নামে এক কলেজছাত্রও ছুরিকাহত হয়। পরে এলাকাবাসী শাওনকে আটক করে পুলিশে দেয়।

No comments

Powered by Blogger.