ক্রীড়া-দুর্নীতির উর্বরভূমি সুইজারল্যান্ড? by প্রতীক বর্ধন

সুইজারল্যান্ডের জুরিখে অবস্থিত ফিফার কার্যালয় ছবি: এএফপি
সুইজারল্যান্ড কোন খেলাতে বিশ্বসেরা? ফুটবল, ভারোত্তোলন, ভলিবল, বক্সিং-কোন খেলা? সামগ্রিকভাবে দেশ হিসেবে সুইজারল্যান্ড কোনো খেলাতেই তেমন পারদর্শী না হলেও পৃথিবীর অনেক আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ফেডারেশনই এই দেশটিতে অবস্থিত। ব্যাপারটি কি সুইসদের খেলাধুলাপ্রীতির কারণে? মোটেই নয়! কিন্তু তার পরেও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর প্রধান কার্যালয়ের জন্য কেন এই দেশকে বেছে নেওয়া? ব্যাপারটা পুরোপুরিই আর্থিক সুযোগ-সুবিধাকেন্দ্রিক। আইনকানুনের শিথিলতার কারণে সুইজারল্যান্ডে ক্রীড়া ফেডারেশনের প্রধান কার্যালয় স্থাপন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক! আইনের শিথিলতার কারণে দুর্নীতি ও অন্যান্য অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্যও সুবিধাজনক এই সুইজারল্যান্ড। সে কারণেই খেলাধুলায় ঐতিহ্য না থাকার পরেও ক্রীড়া ফেডারেশনের কার্যালয় স্থাপনের জন্য এই দেশকে বেছে নেওয়া। ফিফায় কেলেঙ্কারি ও সভাপতির পদ থেকে সেপ ব্ল্যাটারের সরে যাওয়ার ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই বিষয়গুলো এখন সামনে চলে এসেছে।
বেসবলের দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু সেই বেসবলের আন্তর্জাতিক কার্যালয় সুইজারল্যান্ডে। সেই একই ভবনে গলফ, ভারোত্তোলন, বক্সিংসহ ও আরও কিছু জনপ্রিয় ক্রীড়া ফেডারেশনের আন্তর্জাতিক কার্যালয় অবস্থিত, তার একটু দূরেই হকি ও ভলিবলের ফেডারেশন। আর বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা—ফিফার কার্যালয়ও সুইজারল্যান্ডের জুরিখে অবস্থিত।
আন্তর্জাতিক এই ক্রীড়া সংস্থাগুলো সুইজারল্যান্ডে বিশেষ আইনি মর্যাদা লাভ করে। সুইস আইনে এই সংস্থাগুলোকে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এমনকি দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের ক্ষেত্রেও সুইস আইন এই সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। মোদ্দা কথা, সেখানে একবার কার্যালয় বানাতে পারলেই হলো, কোনো দায়দায়িত্ব নেই, যা খুশি তা-ই করা যায়। ব্যাপারটা অনেকটা দুর্নীতির টাকা সুইস ব্যাংকে রাখার মতোই।
সুইস আইনের ফাঁক গলে এই সংস্থাগুলো বছরের পর বছর ধরে আত্মনিয়ন্ত্রণের সুযোগ পাচ্ছে। ফেডারেশনগুলো সম্প্রচার ও বিপণনকার্যক্রম থেকে প্রচুর আয় করছে, যেটা সাধারণত দুর্নীতির উর্বরক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত।
গত ২৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক্টের অ্যাটর্নি ফিফার নয়জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন, গত দুই দশকে তাঁরা সম্প্রচার ও প্রচারণাস্বত্ব পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ১৫০ মিলিয়ন ডলার ঘুষ নিয়েছেন। ফিফা কংগ্রেসের ঠিক আগ দিয়ে জুরিখের একটি বিলাসবহুল হোটেল থেকে সেদিনই তাঁদের মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে সুইস পুলিশ। এদিকে ফিফার নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য চাক ব্লেজার স্বীকার করেছেন, ১৯৯৮ ও ২০১০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ নির্বাচনে তিনিসহ আরও কয়েকজন সদস্য ঘুষ নিয়েছিলেন। ২০১৮ ও ২০২২ সালে বিশ্বকাপের আসর বসবে যথাক্রমে রাশিয়া ও কাতারে। এই দুটি দেশকে স্বাগতিক নির্বাচন করার পেছনেও বিপুল অঙ্কের ঘুষ লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। বিশেষ করে ছোট ও গ্রীষ্মপ্রধান দেশ কাতারকে ২০২২ সালের বিশ্বকাপের স্বাগতিক নির্বাচন নিয়ে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির ফুটবল অবকাঠামোও তেমন শক্তিশালী নয়। কাতার ফুটবল অবকাঠামো নির্মাণ করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমিক নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের হিসাব অনুসারে, ২০১০ সালে থেকে এ পর্যন্ত এক হাজার ২০০ নেপালি ও ভারতীয় প্রবাসী শ্রমিক এই নির্মাণযজ্ঞে অংশ নিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
পদত্যাগের চার দিন আগে ব্ল্যাটার পঞ্চমবারের মতো ফিফার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কেন পদত্যাগ করব? পদত্যাগ করলে তো সবাই বলবে, আমি অপকর্ম করেছি।’
এদিকে এই আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংস্থাগুলোর ব্যাপক দুর্নীতির কারণে ভাবমূর্তি-সংকট সৃষ্টি হওয়ায় সুইজারল্যান্ডও এখন নড়েচড়ে বসেছে বেশ ভালোভাবেই। (টাইম অবলম্বনে)

No comments

Powered by Blogger.