আইএস নির্মূলে সিরিয়ায় হামলা -যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পাঁচ আরব দেশ অংশ নিচ্ছে

ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের নির্মূল করতে ইরাকের পর এবার সিরিয়ায়ও নির্বাচিত লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাল যুক্তরাষ্ট্র। গত সোমবার মধ্যরাতে শুরু হওয়া বিমান ও নৌ হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাঁচটি আরব দেশও অংশ নিয়েছে। ইরাকের বেলায় কোনো আরব দেশ সরাসরি হামলায় অংশ নেয়নি।

গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত প্রায় ৫০টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো হয়। এতে আইএসের অন্তত ৭০ যোদ্ধা নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে বেসামরিক লোকজন হামলায় হতাহত হয়েছেন কি না, তা জানা যায়নি। খবর এএফপি, বিবিসি, রয়টার্স ও নিউইয়র্ক টাইমসের।
মার্কিন কেন্দ্রীয় কমান্ড (সেন্টকম) জানায়, অভিযানে পাঁচটি আরব দেশ—বাহরাইন, জর্ডান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ‘অংশ নিয়েছে বা সমর্থন দিয়েছে’। তবে অভিযানে এই দেশগুলোর অংশগ্রহণ বা সমর্থনদানের ধরন সম্পর্কে সেন্টকম স্পষ্ট করে কিছু জানায়নি।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এ হামলার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন আরেক যুদ্ধ ছড়িয়ে দিল। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, এটা আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের একার যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও অংশ নিচ্ছে।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অবিবেশন চলছে। এর মধ্যেই সিরিয়ায় এ হামলা হলো। হামলা শুরুর কয়েক ঘণ্টার মাথায় জাতিসংঘের মহাসচিব মান কি মুন গতকাল বলেছেন, আইএস সিরিয়া ও ইরাকের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র আরব দেশগুলোর হামলাকে সরাসরি সমর্থন দেননি তিনি।
মহাসচিব শুধু বলেন, ‘আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য আইএস সরাসরি হুমকি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে একমত।’ তবে তাদের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ অবশ্যই জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী হওয়া উচিত বলে জোর দিয়ে জানিয়ে দেন বান কি মুন।
সিরিয়া ও ইরাকে একের পর এক জনপদ দখল করে নিতে থাকা আইএস সম্প্রতি আরব ভূখণ্ডে ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। তাদের অগ্রযাত্রা থামাতে এ দুই দেশের সরকারই কার্যত ব্যর্থ হয়। আইএসের হামলার ভয়ে গত এক সপ্তাহে অন্তত দেড় লাখ সিরীয় নাগরিক দেশ ছেড়ে তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছে। তবে এর আগে আইএসের হাতে অপহৃত দুই মার্কিন সাংবাদিক ও এক ব্রিটিশ ত্রাণকর্মীর শিরশ্ছেদের ঘটনা চরম ক্ষুব্ধ করে তোলে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্রদের। আইএস আতঙ্ক ধরায় শিয়া-অধ্যুষিত আরব রাষ্ট্রের নেতাদেরও।
মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগন গতকাল জানায়, আইএসকে দুর্বল ও ধ্বংস করতেদীর্ঘমেয়াদি অভিযানের অংশ হিসেবে সিরিয়ায় হামলা শুরু করা হয়েছে। এতে যুদ্ধবিমান, চালকবিহীন বিমান (ড্রোন) ও টোমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। আইএসের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত সিরিয়ার রাকা শহরসহ বিভিন্ন শহরে হামলা চালানো হচ্ছে।
সেন্টকম জানায়, গতকাল বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত (বাংলাদেশ সময়) মোট ৫০ বার বিমান হামলা চালানো হয়। এসব হামলায় আইএসের প্রশিক্ষণকেন্দ্র, কমান্ড ও কন্ট্রোল স্থাপনা এবং যানবাহন ও গুদামঘর ধ্বংস বা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
হামলায় লোহিত সাগর ও উত্তর আরব উপসাগরে মোতায়েন মার্কিন যুদ্ধজাহাজ থেকে ৪৭টি টোমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। এ হামলা অব্যাহত থাকবে।
হামলায় অংশ নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে সৌদি আরব ও জর্ডান। জর্ডানের তথ্য ও যোগাযোগমন্ত্রী মোহাম্মদ আল মোমানি বলেন, বিমান হামলা চলবে। অভিযানে তাঁর দেশসহ আর চারটি আরব দেশ অংশ নিয়েছে।
ব্রিটেনভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস বলেছে, সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর রাকায় দুটি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ২০ জনের বেশি আইএস সদস্য। মানবাধিকারকর্মীদের বরাত দিয়ে বিবিসি বলেছে, রাকাসহ বিভিন্ন স্থানে চালানো হামলায় নিহত হয়েছেন আইএসের অন্তত ৭০ জন।
সিরিয়ায় অভিযানের আগে আইএস জঙ্গিদের লক্ষ্য করে গত জুন মাসেই ইরাকে বিমান হামলা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। আগস্টের দিকে অভিযান জোরদার করা হয়। ইরাকের বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত আইএসের বিরুদ্ধে ১৯০টির মতো বিমান হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অতি সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর দেশবাসীর উদ্দেশে এক ভাষণ দেন। এতে সুন্নি গোষ্ঠী আইএসকে নির্মূলে নিজ পরিকল্পনার রূপরেখা তুলে ধরেন তিনি। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ইরাকের পর সিরিয়ায় আইএসকে লক্ষ্য করে অভিযান শুরু করা হলো বলে মনে করা হচ্ছে।
আগেই জানত সিরিয়া: সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গতকাল বলা হয়, সিরিয়া ও ইরাকের উল্লেখযোগ্য অংশে গেড়ে বসা আইএসের ওপর এই আক্রমণ চালানোর বিষয়ে জাতিসংঘে নিযুক্ত তাদের দূতকে আগেই অবগত করা হয়েছিল। তা ছাড়া অভিযানের বিষয়টি জানিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির একটি চিঠিও পেয়েছে মন্ত্রণালয়। তবে আইএসবিরোধী অভিযান নিয়ে সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সঙ্গে কোনো ধরনের সহযোগিতার কথা নাকচ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাজ্যসহ অন্যরা।
রাশিয়ার সমালোচনা: মার্কিন নেতৃত্বাধীন আইএসবিরোধী হামলার সমালোচনা করেছে সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের মিত্র রাশিয়া। গতকাল দেশটি বলেছে, এই অভিযানের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে অবশ্যই দামেস্কের সঙ্গে মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে, অন্যথায় তা উত্তেজনা বাড়াবে। তা ছাড়া এ ধরনের যেকোনো পদক্ষেপ হতে হবে আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
ওবামার অভিনন্দন: অভিযানে অংশ নেওয়া আরব দেশগুলোকে অভিনন্দন জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি বলেছেন, এটা যুক্তরাষ্ট্রের একার লড়াই নয়। হামলা শুরুর কয়েক ঘণ্টা পর হোয়াইট হাউসের লনে দাঁড়িয়ে গণমাধ্যমকে এ কথা বলেন তিনি।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে রওনার প্রাক্কালে ওবামা তাঁর ওই বক্তব্যে অভিযানে সৌদি আরব, বাহরাইন, জর্ডান, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের অংশ নেওয়ার বিষয়ও নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের অভিন্ন নিরাপত্তা রক্ষায় এ দেশগুলোর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে পেরে গর্বিত যুক্তরাষ্ট্র। এ জোটগত শক্তিতে বিশ্বের কাছে স্পষ্ট যে এটা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের একার লড়াই নয়।’
লক্ষ্য আল-কায়েদাও: আইএসের অবস্থান লক্ষ্য করে শুরু করা এই অভিযানের সঙ্গে সিরিয়ায় আরেক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার ঘাঁটিতে মার্কিন সেনারা আট দফা পৃথক হামলা চালিয়েছে বলে জানায় সেন্টকম। সিরিয়ার পশ্চিমের গুরুত্বপূর্ণ শহর আলেপ্পোয় সংগঠনটির শক্তিশালী খোরাসান গ্রুপের নিরাপদ ঘাঁটিতে এ হামলা চালানো হয়। আলেপ্পোয় আল-কায়েদাবিরোধী হামলায় নিহত হয়েছে অর্ধশত লোক। এদের মধ্যে তিন শিশু, এক নারীসহ আট বেসামরিক নাগরিক রয়েছে।

আইএস সৃষ্টি করেছে সিআইএ!
আগ্রাসন চালানোর পথ সুগম করতে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) নামের জঙ্গি সংগঠনটি গড়ে ওঠা-সংক্রান্ত সন্দেহ আরও জোরালো হয়েছে।
গত ২০ সেপ্টেম্বর দ্য নিউইয়র্ক টাইমস অনলাইনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে আইএস গড়ে ওঠার পেছনে সিআইএর সহযোগিতার আভাস মেলে।
আইএস দমনে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ইরাকে বিমান হামলা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তা সত্ত্বেও বাগদাদের অলিগলি থেকে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত এই সন্দেহ রয়েছে যে, জঙ্গিগোষ্ঠীটির পেছনে রয়েছে সিআইএ।
ইরাকের উপপ্রধানমন্ত্রী বাহা আল আরাজি বলেন, ‘আমরা জানি, এটি কে তৈরি করেছে।’
আইএস দমনের অজুহাতে ইরাকে সম্ভাব্য মার্কিন সেনা মোতায়েনের যেকোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সম্প্রতি এক সমাবেশে হুঁশিয়ার করেছেন দেশটির প্রভাবশালী শিয়া নেতা মুকতাদা আল সদর। তিনিও প্রকাশ্যে আইএস সৃষ্টির জন্য সিআইএকে দায়ী করেছেন।
সদরের সমাবেশে আসা হাজারো মানুষের মধ্যে অধিকাংশই একই তত্ত্বে বিশ্বাসী। এই দলে দেশটির পার্লামেন্টর সদস্যরাও রয়েছেন। ইরানেও এই সন্দেহ বেশ জোরালো।
আইএসের নাম করে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা আবার ইরাকে ফিরে আসছেন বলে দেশটির মানুষের মনে ধারণা জন্মেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অবশ্য বলেছেন, আইএস দমনে ইরাক বা সিরিয়ার ভূমিতে সেনা পাঠাবেন না তিনি।
কিন্তু ওবামার এই কথায় খুব কমসংখ্যক ইরাকির আস্থা আছে। রাদ হাতেম নামের এক ইরাকি বলেন, ‘আমরা তাঁকে বিশ্বাস করি না।’
হায়দার আল আসাদি নামের আরেকজন ইরাকি বলেন, ‘আইএস সুস্পষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি। আইএসকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে আবারও আগ্রাসন চালানোর চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র।’
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বাইরেও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে এই সন্দেহ আছে। কোনো কোনো পশ্চিমা বিশ্লেষক মনে করছেন, ইরাকের পর এবার সিরিয়ায় আগ্রাসন চালাতে আইএসকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র।
ওয়াশিংটনভিত্তিক খ্যাতিমান ফ্রিল্যান্স লেখক মাইক হুইটনির মতে, জর্জ ডব্লিউ বুশের মতো মার্কিনিদের বিভ্রান্ত করতে যাচ্ছেন ওবামা। তিনি আইএস জঙ্গিদের দমনের কথা বলছেন। কিন্তু তাঁর মূল উদ্দেশ্য মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি দীর্ঘ মেয়াদি যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়। অঞ্চলটিতে নৈরাজ্য সৃষ্টি, বিদ্যমান সীমান্ত নিশ্চিহ্ন করা ও ক্রীড়নক সরকার বসাতে ওবামা প্রশাসন তৎপর।
হুইটনির দাবি, আরেকটি রক্তক্ষয়ী আগ্রাসনের পথ সুগম করতেই মূলত পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে তাদের সহযোগীরা আইএসকে সৃষ্টি করেছে।
বিশ্লেষক প্যাট্রিক মার্টিনের ভাষ্য, আইএস হলো মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের অজুহাত।

No comments

Powered by Blogger.