পানি জাতীয়তাবাদে সমাধান নেই by মহিউদ্দিন আহমেদ

টেলিভিশনের স্ক্রলে দেখলাম, কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুরে পদ্মা নদীতে নৌকাডুবি হয়েছে। মারা গেছেন ১২ জন। খবরটা শোকের হলেও এটা শুনে অনেকেই স্বস্তি পেতে পারেন। কারণ, পদ্মায় এখন যথেষ্ট জল। নৌকা ডুবলে মানুষ তলিয়ে যায়। কিছুদিন আগের সংবাদ ছিল, ধরলা পয়েন্টে তিস্তার জল বিপৎসীমার পাঁচ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। অথচ এই পদ্মা আর তিস্তা নিয়ে শুকনো মৌসুমে আমাদের দেশে কতই না হাহাকার। পত্রিকায় ছবি দেখি, নদী দিয়ে ট্রাক চলছে। এ দৃশ্য অবশ্য নতুন নয়।
এখন অবশ্য পরিবর্তন হচ্ছে আরও দ্রুতগতিতে। প্রাকৃতিক কারণের সঙ্গে যোগ হয়েছে মানবসৃষ্ট কারণ। ফলে নদীতে পলি কিংবা বালু জমে তা ভরাট হচ্ছে, নদী মরে যাচ্ছে। বর্ষাকালেও তাই দেখা যায় লঞ্চ কিংবা ফেরি ডুবোচরে আটকে গেছে। নদী নাব্যতা হারাচ্ছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, গোয়ালন্দে পদ্মায় পানির গভীরতা দাঁড়ায় সর্বনিম্ন দুই মিটারে, ভৈরব বাজারে মেঘনার পানির স্তর হয় এক মিটার, সিলেটে সুরমা নদীতে পানি থাকে ২ দশমিক ১ মিটার।
নদী আল্লাহর দান। এগুলো তৈরি করতে আমাদের প্রকল্প বানাতে হয়নি, বাজেটে কখনো নদী বানানোর বরাদ্দ ছিল না। মুফতে পাওয়া এসব স্রোতোধারা আমরা নিজেরাই ধ্বংস করে চলেছি। আমরা কয়লা, তেল, গ্যাস, মাছ, গাছ, বাঘ, কুমির নিয়ে প্রচুর অশ্রুপাত করে চলেছি। অথচ আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ, আমাদের নদীগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তেমন কিছুই করিনি। মন্ত্রী-আমলাদের দায়িত্ব হলো কাজ করা। তাঁরা কথা বলেন বেশি, কাজের কাছাকাছি থাকেন না।
আমাদের নদীগুলোর জন্য আরেক উপদ্রব হলো, নদীর উজানে নানা ধরনের অবকাঠামো তৈরি করার ফলে নদীর স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। একের পর এক তৈরি হচ্ছে ব্যারাজ। এর ফলে নদীর জল সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে অন্য জায়গায়। আমাদের অনেক মাঠ শুকিয়ে যাচ্ছে, খেতের ফসল মরে যাচ্ছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাচ্ছে, উপকূলীয় অঞ্চলে মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে।
আমাদের তিন দিকেই ভারত। বলা যায় ‘ইন্ডিয়া-লক্ড’। আমরা প্রায়ই বলে থাকি, ভারত আমাদের পানিতে মারছে। পানি নিয়ে এই অসম যুদ্ধে ভারত আছে সুবিধাজনক স্থানে, উজানে। আমরা ভাটির দেশের মানুষ। আমাদের চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতে হয়, কখন ভারত দয়া করে নদীর অর্গল খুলে দেবে আর আমরা জল পাব।
অস্বীকার করার উপায় নেই, পানির চাহিদা বাড়ছে প্রতিদিন। একটা সময় ছিল যখন শুধু কৃষি আর পরিবহনের জন্য নদীর জলের ব্যবহার হতো। এখন নগরায়ণ বাড়ছে, নতুন নতুন শিল্পকারখানা হচ্ছে, আধুনিক জীবনে পানির নানাবিধ ব্যবহার বাড়ছে। চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য রাখা যাচ্ছে না মোটেও। এখন শুধু পানির সরবরাহ নয়, দরকার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। অর্থাৎ অতিরিক্ত পানি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করা এবং ঘাটতি হলে তা মেনে নিয়ে জীবনযাত্রা সাজানো, কোনোটাই হচ্ছে না। কেননা আমরা জানি না, আমাদের সামনে পানির জোগান আগামী বছরগুলোতে কী পরিমাণ থাকবে। জানলে তো পরিকল্পনা করা যায়।
হিমালয়ের নদীগুলো নিয়ে ভারত একটি আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইছে। এ বছরে বিভিন্ন সমীক্ষার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় বাজেটে ১০০ কোটি রুপি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে উজান থেকে আসা পানির প্রবাহ আরও কমে যাবে। আমাদের কৃষি এবং নগরজীবনে পানির ঘাটতি বেড়ে যাবে আরও।
গঙ্গায় পানিপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য ভারত সরকার ১৯৮০-এর দশকে ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা সংযোগ খালের প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রস্তাব অনুযায়ী আসামের ধুবরি থেকে পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা পয়েন্টে ৩২০ কিলোমিটার খাল কেটে ব্রহ্মপুত্রের পানি গঙ্গায় নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। বাংলাদেশ এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। অবস্থা দিনে দিনে এমন হচ্ছে, গঙ্গার পানি অদূর ভবিষ্যতে আমরা আর পাব কি না, সন্দেহ আছে। উত্তর প্রদেশ আর বিহার পার হয়ে ফারাক্কা পর্যন্ত জল কতটুকু গড়ায়, তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরও সন্দেহ আছে বিস্তর। ভারতের আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো হিমালয়ের নদীগুলোর পানি খাল কেটে গঙ্গায় নিয়ে আসা এবং পরে তা দক্ষিণের অন্যান্য রাজ্যে চালান করা। ভারতের জন্য এটা প্রয়োজন। তাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য আমরা শুকিয়ে মরব কেন?
এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করার কথা যৌথ নদী কমিশনের। ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ এই কমিশন যাত্রা শুরু করে। একই বছরের ২৪ নভেম্বর দুই দেশের মধ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, কমিশনের বৈঠক হওয়ার কথা বছরে চারবার। এ পর্যন্ত সভা হয়েছে ৩৭টি। অর্থাৎ কমিশন একটা কাগুজে বাঘ হয়ে রয়েছে। ভারতের সঙ্গে দেন-দরবার করার জন্য এখন আমরা শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিকে তাকিয়ে থাকি।
আমাদের সামনে সাফল্যের একটি উদাহরণ আছে। পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে আজন্ম বৈরী সম্পর্ক। কয়েক বছর পর পর তারা যুদ্ধ করে। তার পরও তারা ‘ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটি’ স্বাক্ষর করেছে। চুক্তি সই করার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু ১৯৬০ সালে করাচি গিয়েছিলেন এবং পাকিস্তানের সেনাপতি ও রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের সঙ্গে একমত হয়ে তাঁদের মধ্যকার ট্রান্স-বাউন্ডারি নদীগুলোর একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছেন। চুক্তিতে তাঁরা নদীর জল ভাগাভাগি করেননি। তাঁরা নদী ভাগ করেছেন। পুবদিকের তিনটি নদী ইরাবতী, বিপাশা ও শতদ্রু পড়েছে ভারতের ভাগে। তারা এই নদীগুলো নিয়ে যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারে। পক্ষান্তরে পশ্চিমে প্রবাহিত সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব পড়েছে পাকিস্তানের ভাগে, শতকরা ১০০ ভাগ, পাকিস্তানকে ১০ বছর সময় দেওয়া হয়েছে, যাতে সে তার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করে নিতে পারে। মধ্যস্থতা করেছে বিশ্বব্যাংক এবং ব্যাংকের উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সরকার অবকাঠামো তৈরিতে পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য দিয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে নেহরু ও আইয়ুব খানের দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে।
আমাদের অঞ্চলে পানি জাতীয়তাবাদ বেশ প্রবল। কথায় কথায় অনেকেই আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে চান। আইয়ুব খানের ওপরও এ বিষয়ে চাপ ছিল। কিন্তু তিনি দ্বিপক্ষীয়ভাবেই সমস্যাটার সমাধান করেছিলেন। আমরাও দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে গঙ্গার পানি ভাগাভাগির একটা সুরাহা করেছি। আরও ৫৩টি অভিন্ন নদী রয়েছে ভারতের সঙ্গে। একটা একটা করে চুক্তি সই করতে গেলে হাজার বছর লেগে যেতে পারে।
সুতরাং আমাদের কৌশল পাল্টাতে হবে। আমাদের দেশে নীতিনির্ধারকেরা সচরাচর গতানুগতিক চিন্তাধারার বাইরে যান না, যাওয়ার সক্ষমতাও হয়তো নেই। কিন্তু তবু যেতে হবে। এ বিষয়ে আমার একটা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আছে। এ ধরনের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য পানি বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
ব্রহ্মপুত্র (যমুনাসহ) নদীটি এখনো আক্রান্ত হয়নি। আমাদের দেশে উজান থেকে পানির যে প্রবাহ আসে, সবচেয়ে বেশি আসে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে। আমরা তো ভারতের সঙ্গে একটা ট্রেড-অফ করতে পারি—তোমরা গঙ্গা নিয়ে নাও, ব্রহ্মপুত্র পুরোটা আমাদের থাকুক। অন্য নদীগুলোও আমরা ভাগ করে নিতে পারি।এটা দুঃখজনক হলেও সত্য, ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রায় পুরোটাই আমরা অপচয় করি এবং তা বঙ্গোপসাগরে চলে যায়। ব্রহ্মপুত্র-যমুনাকে কেন্দ্র করে এ দেশে সেচ কিংবা পানীয় জলের কোনো অবকাঠামো আজও গড়ে ওঠেনি। কী নিদারুণ অপচয়?
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকা পৃথিবীর বৃহত্তম সেচ নেটওয়ার্ককে ধারণ করে আছে। এখানে সেচের আওতায় আছে ২৬ মিলিয়ন একর জমি। ভুলে গেলে চলবে না, এই তিন নদীর অববাহিকার মাত্র ৭ শতাংশ বাংলাদেশে। আমরা যখন ‘ন্যায্য হিস্যার’ কথা বলি, তখন এটাও ভাবতে হবে যে এই অববাহিকায় বসবাসকারী প্রতিটি মানুষের সম–অধিকার আছে, হোক সে বাংলাদেশি কিংবা ভারতীয় অথবা নেপালি কিংবা চীনা। অবাস্তব চিন্তা, একগুঁয়েমি আর সস্তা রাজনীতির নামে জল ইতিমধ্যে অনেক ঘোলা হয়েছে। এখন শুভবুদ্ধির উদয় হোক, সীমান্তের ওপারে এবং এপারে।
ভারতের আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে উদ্বৃত্ত অঞ্চল থেকে ঘাটতি এলাকায় পানি সরিয়ে নেওয়া। রাজনৈতিক সীমানা দিয়ে প্রতিবেশ অঞ্চল নির্ধারণ করা যায় না। এই আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প এমনও হতে পারে, যেখানে বাংলাদেশ এবং অববাহিকার অন্যান্য দেশ, যেমন নেপাল ও ভুটান অংশীদার হবে। পুরো বিষয়টারই সমাধান হতে পারে একটি আঞ্চলিক মহাপরিকল্পনার মধ্য দিয়ে। এ জন্য প্রয়োজন ‘সংলাপ’। আন্দোলনের হুমকি দিয়ে পানি সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে, দেশের মধ্যে সচেতনতা ও মতৈক্য গড়ে তুলতে হবে এবং পানির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবতার আলোকে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
আমাদের সামনে খুব বেশি বিকল্প নেই। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
মহিউদ্দিন আহমেদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.