বৈষম্যের দুনিয়ায় আয় বৃদ্ধি! by কামাল আহমেদ

‘ইনক্লুসিভ ক্যাপিটালিজম’-এর জুতসই কোনো বাংলা আমার মাথায় আসছে না৷ কী বলা যায় একে? অন্তর্ভুক্তিমূলক পুঁজিবাদ? ভাগাভাগির পুঁজিবাদ? নাকি শুদ্ধ পুঁজিবাদ? বিষয়টা নাহয় ভাষাবিশারদ অর্থনীতিবিদেরাই ঠিক করুন৷ কিন্তু যে কারণে এ বিষয়ের অবতারণা, তা হলো গত ২৭ মে লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক আয়োজন, যার নাম ছিল ‘কনফারেন্স অন ইনক্লুসিভ ক্যাপিটালিজম: বিল্ডিং ভ্যালু অ্যান্ড রিনিউয়িং ট্রাস্ট’৷ অনেকটা ডাভোসের বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের মতো৷ পুঁজিবাদী দুনিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক নেতাদের দিনভর পুঁজিবাদের সমূহ বিপদ সম্পর্কে আলাপ-আলোচনার পর সংকটাপন্ন পুঁজিবাদকে মানবিক রূপ দিয়ে টিকিয়ে রাখার জন্য সম্ভাব্য কী কী উদ্যোগ নেওয়া যায়, তা ঠিক করতেই এ সম্মেলন৷
লাল দোতলা বাসের সঙ্গে লন্ডনের একটা ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে৷ যে কারণে বিশ্বের বহু প্রান্তেই মানুষ এ ধরনের বাসকে ব্রিটেনের একটি স্মারক হিসেবে বিবেচনা করে থাকে৷ এ বাসে ওপরে-নিচে মিলিয়ে ৮০ থেকে ৯০ জন যাত্রী বসতে পারে৷ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টিন লাগার্ড ওই আয়োজনে বলেছেন যে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ৮৫ জনকে আটানোর জন্য লন্ডনের একটি দোতলা বাসই যেখানে যথেষ্ট, সেখানে তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মোট সম্পদের পরিমাণ বিশ্বের ৩৫০ কোটি দরিদ্র মানুষের সম্পদের সমান৷ তিনি বলতে বাধ্য হয়েছেন, বৈষম্য যত বাড়বে, পুঁজিবাদ ততটাই কম অংশীদারমূলক হবে৷

অঙ্কের হিসাবে ওই ৮৫ জনের সম্পদের পরিমাণ তুলে ধরা সম্ভব হলেও তা বোঝানো প্রায় অসম্ভব৷ ক্রিস্টিন লাগার্ডের আগে এ কথাগুলো বলেছিল বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, অক্সফাম৷ গত ১৯ জানুয়ারি তাদের এক প্রকাশনায় তারা এই ৮৫ জনের মোট সম্পদের পরিমাণ অর্থমূল্যে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার বলে উল্লেখ করে৷ বিশ্বব্যাপী ধনী ও গরিবের মধ্যে যে অবিশ্বাস্য গতিতে এ সম্পদ বাড়ছে, তাতে পুঁজিবাদী বিশ্বের মোড়লেরাই সবচেয়ে বেশি চিন্তিত বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রীরা প্রায় বিলুপ্ত এক প্রজাতিতে রূপান্তরিত হওয়ার পরও এসব পুঁজিবাদীর উৎকণ্ঠার শেষ নেই৷ এ উৎকণ্ঠা তাঁদের অর্জিত সম্পদ রক্ষা করার উদ্বেগ থেকে উৎসারিত৷

পুঁজিবাদী অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির দিকনির্দেশনা দেওয়ার কথা যে প্রতিষ্ঠানের, সেই আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিন লাগার্ড এ হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন যে সম্পদের অধিকতর কেন্দ্রীকরণ ঠেকানো না গেলে গণতন্ত্র ও মেধাতন্ত্রের নীতিকে উপেক্ষা করা হবে; এমনকি তা ১৯৪৮ সালে গৃহীত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সম-অধিকারনীতির পরিপন্থী হবে৷ পুঁজিবাদীদের অন্যতম মন্ত্র ‘সুযোগের ক্ষেত্রে সমতা’ (ইকুয়ালিটি অব অপরচুনিটি) নিশ্চিত করার নীতি অর্থহীন বলে স্বীকার করে নিয়ে তিনি বলেছেন, যেহেতু উন্নত মানের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসুবিধা সব সময় টাকা দিয়ে কেনা যায়, সেহেতু সুযোগের ক্ষেত্রে আর কোনো সমতা থাকে না৷
পুঁজিবাদের বেসামাল বিকাশ এবং গুটি কয়ের হাতে পুঁজি কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে তার নিজের মধ্যেই এর ধ্বংসের বীজ নিহিত আছে বলে কার্ল মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণীকে উদ্ধৃত করতে তাই আইএমএফ-প্রধান একটুও লজ্জিত হন না৷ সমৃদ্ধি ভাগাভাগি করে নেওয়ার পথ অনুসন্ধানের তাগিদ দেন তিনি৷ (সূত্র: ২৭ মে প্রকাশিত বক্তৃতা, আইএমএফ ওয়েবসাইট)৷ ওই একই সভায় ইংল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর মার্ক কার্নি বলেছেন, নৈতিকতা উবে গেলে পুঁজিবাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার৷ তিনি আরও বলেছেন, পুঁজিবাজারে বৃহৎ পুঁজির অধিকারী লোকজনের সর্বগ্রাসী আচরণ সামাজিক বন্ধন ভেঙে ফেলার ঝুঁকি তৈরি করছে৷ তিনি ব্যাংকারদের এ সর্বগ্রাসী আচরণ বলতে বুঝিয়েছেন যে ফাটকাবাজিতে লিপ্তরা জুয়ায় জিতলেও যেমন তাদের লাভ, হারলেও লাভ৷
২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার পর থেকে গত পাঁচ বছরে বিশ্বে বৈষম্য আরও বেড়েছে এবং ধনীরা যতটা দ্রুত হারে আরও ধনী হয়েছেন, দরিদ্ররা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ঠিক ততটাই পিছিয়ে পড়েছেন৷ ক্রিস্টিন লাগার্ড অন্য আরেক বক্তৃতায় (রিচার্ড ডিম্বলবি বক্তৃতা, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪) জানান, ২০০৯ সালের পর বিশ্বের মোট আয় বৃদ্ধির শতকরা ৯৫ ভাগই গেছে সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ মানুষের দখলে৷ ওই হিসাব অনুযায়ী নিচের দিকের ৯০ শতাংশ মানুষ আরও গরিব হয়েছেন৷ যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ৯ শতাংশের মতো মানুষের কপালে ছিটেফোঁটা কিছুটা জুটেছে৷ বৈশ্বিক এ হিসাবের পাশাপাশি ক্রিস্টিন লাগার্ড ভারতেরও একটা হিসাব তুলে ধরেছেন, যাতে দেখা যায়, ভারতীয় শতকোটিপতিদের সম্পদ গত ১৫ বছরে বেড়েছে ১২ গুণ৷ ওই সময়ে ভারতীয় শতকোটিপতিদের সম্পদ যে পরিমাণে বেড়েছে, তাঁর হিসাবে তা দিয়ে দেশটির চরম দারিদ্র্যে থাকা জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্য থেকে দুবার বের করে আনা সম্ভব৷
বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের সম্পদের হিসাব নিয়ে এ ধরনের কোনো নির্ভরযোগ্য ও প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার কথা শোনা যায় না৷ অনুমাননির্ভর কিছু কথা অবশ্য মাঝেমধ্যেই শোনা যায়৷ তবে সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের চিত্রটা বাংলাদেশেও যে ভিন্ন কিছু নয়, সেটা নিশ্চিন্তেই বলা যায়; বিশেষ করে শহরাঞ্চলের সঙ্গে গ্রামাঞ্চলের এবং শহরের বহুতল ভবনের বাসিন্দাদের সঙ্গে বস্তিবাসীর জীবন–মানের বৈষম্য৷ আগামী অর্থবছরের বাজেট দেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে অঙ্ক কষতে গিয়ে আমাদের মন্ত্রী ও আমলারা সম্প্রতি হিসাব পেয়েছেন যে মাথাপ্রতি জাতীয় আয় বেড়ে এখন এক হাজার ১৯০ ডলারে দাঁড়িয়েছে৷ কিন্তু বাংলাদেশ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছর অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদের অধিকারী লোকের সংখ্যা মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার (প্রথম আলো, ২২ মে, ২০১৪)৷ এ তথ্যটুকু থেকেই তো আলামত মেলে যে বাংলাদেশেও সব সমৃদ্ধি ও সম্পদ বৃদ্ধির সিংহভাগ গুটি কয় ধনী লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত রয়েছে৷

সরকারি পরিসংখ্যানে অবশ্য বলা হয়, দেশে দারিদ্র্যের হার কমছে, বিশেষ করে চরম দারিদ্র্য৷ কিন্তু দারিদ্র্য কমার হার কি ধনীদের আরও দ্রুত ধনবান হওয়ার হারের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে? রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট গুটি কয় পরিবার ও গোষ্ঠী কুইক রেন্টালের ভর্তুকি, শেয়ারবাজারে উচ্চ মুনাফার মূল্য দেখিয়ে বিনিয়োগকারীদের সঞ্চয় লুণ্ঠন, ব্যাংক-বিমার লাইসেন্স নিয়ে রাতারাতি শতকোটিপতি হওয়া, এমএলএম কোম্পানির নামে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের মাধ্যমে যেভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, তার প্রকৃত চিত্র সম্ভবত কখনোই জানা যাবে না৷

রাজনীতিকদের একটা বড় অংশও যে এই সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, তার প্রমাণও আমরা দেখেছি ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত ভোটারবিহীন নির্বাচনের প্রার্থীদের হলফনামায়৷ তাঁদের কারও কারও সম্পদ নাকি পাঁচ বছরে শতগুণের বেশি বেড়েছে৷ এমনকি একদা শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র কায়েমের রাজনৈতিক মন্ত্রে দীক্ষা নেওয়া কতিপয় বামপন্থী নেতার পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক সরকারি জমি বরাদ্দ নিয়ে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার তথ্যও এখন সবাই জানেন৷ আবার ঘোষিত সম্পদই যে সবার একমাত্র উপার্জন, সে কথাও কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবেন না৷
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০১১ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ২৪ শতাংশই কালোটাকার দখলে৷ ‘শ্যাডো ইকোনমি অব বাংলাদেশ: সাইজ এস্টিমেশন অ্যান্ড পলিসি অ্যাপ্লিকেশন’ শীর্ষক ওই গবেষণায় ব্যবহৃত তথ্য-উপাত্ত ২০০৮ সালের আগের৷ সুতরাং, সাম্প্রতিক কালে তার আকার আরও কতটা স্ফীত হয়েছে অনুমান করা কঠিন৷ ফি-বছর কালোটাকা বৈধ করার সুযোগ দেওয়ায় অভ্যস্ত অর্থমন্ত্রী অবশ্য আবারও বলেছেন যে সেই সুযোগ আর দেওয়া হবে না৷ কিন্তু সেই কালোটাকার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদেক্ষেপ নেওয়ার কোনো অঙ্গীকার তাঁর কাছ থেকে শোনা যায়নি৷
ইউরোপের অনেক দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র গত এক বছরে কর ফাঁকি দেওয়া এবং বিদেশে পাচার হওয়া কালোটাকা উদ্ধারে উদ্যোগী হয়ে বেশ ভালো সাফল্য দেখিয়েছে৷ সুইজারল্যান্ডের কাছ থেকেও এখন তারা সম্পদ গোপনকারীদের বিষয়ে তথ্য আদায় করে নিচ্ছে৷ বাংলাদেশে একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ছাড়া আর কারও ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়৷ অথচ এ বিপুল বৈষম্যের ছায়াতেই আমরা জাতীয় আয় বৃদ্ধি উদযাপন করছি৷ সেখানে বৈষম্য নিয়ে কারও না আছে উদ্বেগ, না আছে ক্ষোভ৷

কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন৷

No comments

Powered by Blogger.