চিতায় পুড়লো হৈমন্তির স্বপ্ন by উৎপল রায়

দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে চলতি বছরের শুরুতে ঢাকায় এসেছিলেন হৈমন্তি রানী সরকার। শৈশব থেকেই মেধাবী ও পরোপকারী হৈমন্তি মানবসেবার আশায় সেবিকার চাকরি নিয়েছিলেন মিরপুর আধুনিক হাসপাতালে। সংসারের দুঃখ ঘোচাবেন বলে আশ্বস্ত  করেছিলেন পিতা রবীন্দ্রনাথ সরকারকে। কিন্তু হৈমন্তির আশৈশব লালিত স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। সাত বছর ধরে যে প্রেমিককে মন প্রাণ উজাড় করে ভালবেসেছিলেন, সেই প্রেমিকই হয়ে উঠেছিল তার ঘাতক। প্রেমিক শেখর চন্দ্র হালদারের (চন্দ্রশেখর) ক্ষণিকের উত্তেজনা, জিঘাংসা আর উন্মত্ততায় প্রাণোচ্ছল হৈমন্তি চলে গেছে না ফেরার দেশে। চিতার আগুনে হৈমন্তির দেহের সঙ্গে পুড়ে গেছে তার স্বপ্নও। এদিকে প্রেমিকাকে হত্যার দায়ে স্বেচ্ছায় ধরা দেয়া প্রেমিক শেখর এখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি।

গত বৃহস্পতিবার বিকালে মিরপুর রূপনগর আবাসিক এলাকার আমিরাবাদ হাউজিংয়ের ৩৯ নম্বর রোডের ৬ নম্বর প্লট থেকে হৈমন্তির লাশ উদ্ধার করে রূপনগর থানা পুলিশ। হত্যার দায়ে শেখরকে অভিযুক্ত করে রূপনগর থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়েছে।
পুলিশ, হাসপাতাল ও নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বরিশালের আগৈলঝরার বারপাইকা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ সরকার ও সবিতা রানী সরকারের ৫ কন্যার মধ্যে হৈমন্তি রানী সরকার (২১) ছিল মেজ। জন্মের পর রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তি গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হৈমন্তির সঙ্গে মিল রেখে বাবা-মা আদর করে তার নাম রেখেছিলেন হৈমন্তি। হৈমন্তির মতোই উদার, ত্যাগী ও দুঃখী ছিল একালের হৈমন্তি ও তার জীবনযাপন। মা সবিতা রানী সরকার ৪ বছরের হৈমন্তিকে রেখে চলে গিয়েছিলেন সন্যাসে। বিমাতার সংসারে মানুষ হয়েছিলেন হৈমন্তি। সংসারে স্বাচ্ছন্দ্যও ছিল না তেমন। ২০০৭ সালে স্থানীয় বারপাইকা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০০৯ সালে এইচএসসি পাস করে মৌলভিবাজার হাসপাতাল ও নার্সিং ইনস্টিটিউট থেকে নার্সিং বিষয়ে ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করে হৈমন্তি। মাত্র দু’মাস আগে সেবিকার চাকরি নেন মিরপুর আধুনিক হাসপাতালে। মাধ্যমিকে একই স্কুলে পড়ার সময়ে বরিশালের উজিরপুরের ইন্দুরকান্দি গ্রামের শেখর চন্দ্র হালদারের (২২) সঙ্গে ছিল তার বন্ধুত্ব (শেখর স্থানীয় একটি ডিগ্রি কলেজে স্নাতক পড়ছে)। ধীরে ধীরে সেই বন্ধুত্ব পরিণত হয় প্রণয়ে, গভীর প্রেমে। একটানা সাতবছর তাদের মন দেয়া নেয়া চলে। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে ঢাকায় আসার পরই হৈমন্তি ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার পেশাগত কাজে। আর এতেই বাধে বিপত্তি। প্রেমিক চন্দ্র শেখর তা মানতে নারাজ। তার এক কথা, তাকে সময় দিতে হবে নিয়মিত। দ্রুত বিয়েও করতে হবে।
হৈমন্তির পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েকদিনে ব্যস্ততার জন্য চন্দ্র শেখরের সঙ্গে হৈমন্তির দূরত্ব কিছুটা বেড়ে যায়। বিষয়টি আন্দাজ করতে পেরে চন্দ্র শেখরের মনে জাগে সন্দেহ। তার ধারণা হৈমন্তি বোধহয় এই ফাঁকে অন্য কাউকে মন দিয়ে ফেলেছে। প্রেমিক চন্দ্র শেখর চলে আসে ঢাকায়। গত ১৭ই মে তারা দেখা করে। ওই দিন একসঙ্গে তারা ঘুরেও বেড়িয়েছে। তবে এদিন তাদের মাঝে মনোমালিন্য ছিল অনেকটা। পরদিন ১৮ই মে বিকালে চন্দ্র  শেখর হৈমন্তিকে মিরপুর ১০ নম্বর সেনপাড়া পর্বতার ৭৮/১ বাসা থেকে  ডেকে নিয়ে য়ায় রূপনগর আবাসিক এলাকার আমিরাবাদ হাউজিংয়ের ৩৯ নম্বর রোডের ৬ নম্বর প্লট-এ তার পিসতুতো ভাইয়ের বাসায়। সেখানে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে দুজনেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে উন্মত্ত প্রেমিক চন্দ্র শেখর তার পুরুষত্ব জাহির করার জন্য বেছে নেয় চরমপন্থা। হৈমন্তিকে সেখানকার একটি রুমে আটকে হাত পা বেঁধে চরম নির্যাতন করে সে। গলায় ওড়না পেঁচিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করে। এভাবেই তার ভালাবাসার দাবি আদায়ের চেষ্টা করে প্রেমিক চন্দ্র শেখর। বিরমাহীন শারীরিক অত্যাচারে ততক্ষণে হৈমন্তি নিথর হয়ে পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় ক্ষণিকের মানসিক ভারসাম্যহীন ঘাতক প্রেমিক চন্দ্র শেখর পাশেই পেট্রোল ডিউটিরত পুলিশের কাছে গিয়ে নিজেকে অপরাধী দাবি করে ধরা দেয় পুলিশের হাতে। নিথর হৈমন্তিকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে মুমূর্ষু হৈমন্তিকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট চিকিৎসা দেয়ার জন্য নেয়া হয় ধানমন্ডির নিরূপমা হাসপাতালে। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ১৮ই মে রাত ৯টায় হৈমন্তিকে ভর্তি করা হয় গ্রীন রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালে। কিন্তু চিকিৎসকদের সকল চেষ্টা আপনজনদের আকুতি কিছুই শোনেনি হৈমন্তি। গত বৃহস্পতিবার বিকালে সে চলে যায় মৃত্যুর কোলে।
লাশের সুরতহাল রিপোর্ট শেষে গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হৈমন্তির লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা লাশ সৎকারের জন্য গতকালই নিয়ে যায় বরিশালের আগৈলঝরার হৈমন্তির নিজ বাড়িতে। সেখানে তৈরি হয় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। আদরের হৈমন্তিকে হারিয়ে অসুস্থ বাবা রবীন্দ্রনাথ  সরকার ও মা সবিতা সরকার বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। আত্মীয় স্বজন কেউই চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলেন না। কেবলই তারা মাতম করছেন। এমন মেধাবী একটি প্রাণ এভাবে ঝরে যাবে তাও নিজের প্রেমিকের হাতে তা মেনে নিতে পারছেন না এলাকাবাসী। তারা ঘাতক প্রেমিক চন্দ্র শেখরের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাইছিলেন। হৈমন্তির মামা তারকানাথ সরকার বলেন, খুব মেধাবী ছিল হৈমন্তি। ওদের প্রেমের বিষয়টিও জেনেছিলাম। কিন্তু এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই হৈমন্তিকে এভাবে চলে যেতে হলো। আমরা ঘাতক চন্দ্র শেখরের শাস্তি চাই।  এ বিষয়ে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা রূপনগর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জোবায়ের আহমেদ বলেন, ঘটনার পরপরই শেখরের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে হৈমন্তিকে নির্যাতন করার কথা স্বীকার করেছে। সুরতহাল রিপোর্টে লাশের হাতে, পায়ে ও গলায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। নির্যাতনে আরও কেউ জড়িত আছে কিনা তা তদন্ত করে জানা যাবে। এজন্য আসামিকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.