আমরা কেন লাশ হলাম? by সোহরাব হাসান

নারায়ণগঞ্জের পর ফেনী৷ ফেনীর পর লক্ষ্মীপুর৷ এরপর কী?
গত ২৭ এপ্রিল দিনদুপুরে নারায়ণগঞ্জে সাতটি মানুষকে প্রথমে অপহরণ ও পরে তাঁদের নৃশংস কায়দায় খুন করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল খুনিরা। তারা প্রতিটি লাশের সঙ্গে ২০-২২টি ইট বেঁধে দিয়েছিল, যাতে সেগুলো ভেসে উঠতে না পারে। কিন্তু যেখানে লাশগুলো ভাসিয়ে দিয়েছিল, সেই জায়গাটি গভীর ছিল না বলে লাশগুলো ভেসে ওঠে। এর পরপরই নারায়ণগঞ্জ ফুঁসে ওঠে। খুনিদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন চলে। চলে মামলা-তদন্ত ইত্যাদি। এ ঘটনায় মৃতদের লাশগুলোই জীবন্ত সাক্ষী হয়ে ওঠে। আর নিহত মানুষগুলো সরকার ও জনগণের কাছে প্রশ্ন রাখছে, ‘আমরা কেন লাশ হলাম?’ নিখোঁজ হওয়া মানুষগুলোর জিজ্ঞাসা, আমরা কেন গুম হলাম৷

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে র৵াবের তিন সাবেক কর্মকর্তাকে আটক ও রিমান্ডে নেওয়া হলেও প্রধান আসামি নূর হোসেন রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে৷ তিনি সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত কাউন্সিলর। আর তিনি যাঁকে প্রধান নিশানা করেছিলেন, নজরুল ইসলামও আওয়ামী লীগের নেতা৷ নূর হোসেনকে হারিয়ে তিনিই হয়েছিলেন প্যানেল মেয়র৷ আবার উভয়ই ছিলেন নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের বড় নেতা এবং দেশবাসী যাঁকে বিশেষ নামে চেনে, সেই শামীম ওসমানের শিষ্য।
খুন হওয়ার আগে নজরুল ইসলাম গিয়েছিলেন বড় নেতার কাছে, নিরাপত্তার জন্য। তিনি তাঁকে অভয় দিয়েছিলেন। আর যিনি খুন করেছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে, সেই নূর হোসেনও তাঁর (শামীম ওসমান) কাছ থেকে অভয় পেয়েছেন। গতকাল প্রথম আলোয় শামীম ওসমান ও তাঁর শিষ্য নূর হোসেনের একটি কথোপকথন ছাপা হয়েছে৷ চ্যানেল টোয়েন্টি ফোর সেই কথোপকথনের অডিও বার্তা প্রচার করেছে৷ সাত খুনের ঘটনার পর শামীম ওসমান শিষ্য নূর হোসেনকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘তুমি অত চিন্তা করো না।...তোমার কোনো সমস্যা হবে না৷’
শামীম ওসমান যাঁকে সমস্যা হবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন, সেই নূর হোসেনকে ধরার জন্য বাংলাদেশ সরকার ইন্টারপোলের সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছে। কয়েক দিন আগে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, নূর হোসেন দেশেই আছেন। মানুষ কোনটি বিশ্বাস করবে?
নারায়ণগঞ্জের খুনের আসামি ও সাক্ষী পালিয়ে যাওয়া এই প্রথম নয়৷ গত বছরের মার্চে খুন করা হয় কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে। তার অপরাধ, সে নারায়ণগঞ্জ নাগরিক আন্দোলনের নেতা রফিউর রাব্বির ছেলে৷ রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি বন্ধে অান্দোলন করছেন৷ ১৩ মাসেও ত্বকী হত্যার বিচার হয়নি৷ তদন্ত হলেও অদৃশ্য শক্তির নির্দেশে মামলার চার্জশিট হয়নি। আদালতে স্বীকারোক্তি দেওয়া আসািম জামিন নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। রাজনৈতিক মহলের ধারণা, যারা ত্বকী হত্যার আসামিকে বিদেশে পাঠাতে সহায়তা করেছে, তারা নূর হোসেনকেও পার করে দিয়েছে৷
দেশময় আলোড়ন সৃষ্টিকারী নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের পর অনেকেই ধারণা করেছিলেন, দেশটা হয়তো কিছুদিন শান্ত থাকবে৷ দুর্বৃত্তরা খামোশ হবে৷ শিগগির নতুন খুন বা গুমের ঘটনা ঘটবে না৷
কিন্তু তিন সপ্তাহ না যেতেই ফেনীতে প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হলেন ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক। চার সহযোগীসহ তিনি গাড়িতে করে ফেনী থেকে ফুলগাজী যাচ্ছিলেন৷ এই দানবেরা এতটাই নৃশংস ছিল যে তারা প্রথমে একরামুলকে গুলি করে, পরে পেট্রল দিয়ে সেই গাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করে৷ মানুষ এত নৃশংস হতে পারে!
নারায়ণগঞ্জের মতো ফেনীর ঘটনাটিও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ঘটেছে বলে অনেকে মনে করেন৷ ইতিমধ্যে পুলিশ যে ভিডিও উদ্ধার করেছে তাতে রুটি সোহেল, আবিদ, পারভেজ ও হুমায়ুন নামে যে চারজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাঁরা স্থানীয় পৌরসভার এক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতার অনুসারী। সেই কাউন্সিলর আবার সাংসদ নিজাম হাজারীর সহযোগী৷ এঁরা একসময় ফেনীর গডফাদার ও বহু অপকর্মের হোতা জয়নাল হাজারীর সহযোগী ছিলেন৷ এখন নিজাম-জয়নাল বিরোধ চরমে৷ একরামুল খুনের ঘটনায় বিএনপি নেতা মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীকে আসামি করা হলেও জয়নাল হাজারী মনে করেন, ফেনীতে বিএনপির শক্তি নেই আওয়ামী লীগের একজন কর্মীকে চড়-থাপড় দেওয়ার।
তাহলে একরামুল হকের খুিন কে? জয়নাল হাজারী বলেছেন, নিজাম তাঁকে খুন করেছেন৷ আর নিজাম হাজারীর দাবি, জয়নাল হাজারীকে রিমান্ডে নিলেই আসল তথ্য বেরিয়ে আসবে৷ তিনি রিমান্ডে যেতে রাজিও আছেন৷
কেবল নারায়ণগঞ্জ ও ফেনী নয়, লক্ষ্মীপুরেও একের পর এক খুন ও গুমের ঘটনা ঘটেছে৷ লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চরশাহী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি অাবদুল মান্নান ভূঁইয়া (৫০) ও রায়পুর পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মজিদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। এর আগে চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সহসভাপতি আবু নোমানকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার জের ধরে আধ ঘণ্টার মধ্যে ইউনিয়ন যুবদলের কর্মী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর নিহত হন৷ খুনের বদলে খুন৷ এটি আরব দেশে ইসলামপূর্ব আইয়ামে জাহেলিয়াতের সময়ে ছিল৷ এখন বাংলাদেশে চলছে৷
একটি পত্রিকায় ফেনীর গডফাদার জয়নাল হাজারী বলেছেন, তিনি চাঁদাবাজি করতেন না, তাঁর ভাষায় যাঁরা অন্যায় করতেন, তাঁদের শায়েস্তা করতেন৷ দেশে আইনকানুন থানা-পুলিশ থাকলে ব্যক্তিবিশেষ প্রাইভেট বাহিনী গঠন করে জনগণকে শাস্তি দিতে পারে না৷ জয়নাল হাজারী এখন ফেনীতে নেই৷ কিন্তু তিনি যে খুন, গুম ও প্রতিপক্ষকে নিঃশেষ করার রেওয়াজ চালু করেছিলেন, সেটি বহাল তবিয়তে আছে৷ ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে অাওয়ামী লীগের শাসনামলে নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হয়েছিল। এই তিনটি স্থানে তিনজন গডফাদার তৈরি হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে দুজন এখনো রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও ফেনীর জয়নাল হাজারী অবসর নিয়েছেন এবং নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে জাহির করতে চাইছেন। অথচ তিনি সাংবাদিক টিপু সুলতানের হাত-পা ভেঙে দিয়ে তাঁর কলম স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন৷ টিপু এখন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, আর জয়নাল হাজারী ‘পরিত্যক্ত’ রাজনীতিক৷
গডফাদাররা অবসর নিলে কিংবা বিদেশে পালিয়ে গেলে সন্ত্রাসের জনপদে শান্তি আসে না৷ শান্তি আসে তখনই, যখন সেখানে আইনের শাসন চালু থাকে, প্রশাসন, পুলিশ, র৵াব নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালন করতে পারে৷ নারায়ণগঞ্জ, ফেনী কিংবা লক্ষ্মীপুরে সেটি করতে দেওয়া হয়নি, এখনো হচ্ছে না৷
লক্ষ্মীপুরে আবু তাহের ও তাঁর পুত্রদের কর্মকাণ্ড সবার জানা৷ আবু তাহেরের পুত্র হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসািম হলেও মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁকে মাফ করে দেন৷ অথচ আইনজীবী নূরুল ইসলামের পুত্র-কন্যারা আজও পিতা হত্যার বিচার পায়নি৷ গত পাঁচ বছর নারায়ণগঞ্জ, ফেনী ও লক্ষ্মীপুরে পুলিশ, র৵াব, প্রশাসন, স্থানীয় রাজনীতি সবকিছুই চলেছে এমন সব ব্যক্তির কথায়, যাঁদের নাম শুনলে মানুষ আতঙ্কিত হয়। এমনকি বিরোধী দলও টুঁ শব্দ করতে পারেনি তাঁদের ভয়ে৷
নারায়ণগঞ্জে জামায়াত-শিবিরের কোনো অবস্থান নেই। বিএনপি সরকারি দলেরই অনুগত হয়ে কাজ করছে। বামদের তৎপরতাও সীমিত। ফেনীতে বিরোধী দলের অস্তিত্বই বিপন্নপ্রায়। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও একুশে ফেব্রুয়ারিতে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে শহীদ মিনারে মাল্যদানের মধ্যেই সীমিত। লক্ষ্মীপুরে পুলিশ ও সরকারি দলের যৌথ সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে বিরোধী দল দাঁড়াতেই পারছে না।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুন কিংবা ফেনীর একরামুল হক হত্যাকারীরা চিহ্নিত ও বিচারের মুখোমুখি হবে কি না জানি না৷ তবে যে রাজনীতি এই খুনের ও গুমের ঘটনা ঘটিয়েছে, সে রাজনীতি ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়ে গেছে৷ এই খুনের রাজনীতির হোতােদর শক্তির উৎস ক্ষমতা৷ যখন দল ক্ষমতায় থাকে না, তখন এই অপরাজনীিতর কুপুত্ররা পালিয়ে বেড়ান৷ যখন দল ক্ষমতায় থাকে তখনই তারা দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসেন৷ তাঁদের হুকুম ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না৷
৫ জানুয়ারির পর দেশে এখন সেই অর্থে বিরোধী দল নেই৷ ক্ষমতাসীনেরা বিএনপিকে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকারই করতে চান না৷ এমনকি তারা যে ঘরে বসে প্রতিবাদ সভা করবে, সেই সুযোগটিও তাদের দেওয়া হচ্ছে না৷
ফলে বিভিন্ন স্থানে সরকারি দলের কর্মী ও ক্যাডাররা হয়ে উঠেছেন আরও বেপরোয়া, আরও দুর্ধর্ষ৷ আইনকে অগ্রাহ্য ও অমান্য করে নিজেদের মতো সবকিছু চালাতে চাইছেন৷ এবং এ ক্ষেত্রে দলের ভেতরে ও বাইরে যাদেরই বাধা মনে করেন, তাদেরই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেন৷ কী ভয়ংকর রাজনীতি!
সন্ত্রাস এমন এক সংক্রামক ব্যাধি, যা দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে৷ অার সন্ত্রাসী এমন এক দানব, যাকে একবার বোতল থেকে বের করলে আর ভেতরে ঢোকানো যায় না৷ সে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো সৃষ্টিকর্তাকেই হত্যা করে৷ নারায়ণগঞ্জ, ফেনী কিংবা লক্ষ্মীপুরে আমরা তারই পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি৷
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.