শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মূল্যায়ন হচ্ছে কি? by তুহিন ওয়াদুদ

মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট ও সমমান পরীক্ষা ২০১৪-এর ফল প্রকাশিত হলো। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ৯১.৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১৪ লাখ ২৬ হাজার ৯২৩ জন। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ৪২ হাজার ২৭৬ জন। গত বছর এই জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৯১ হাজার ২২৬ জন। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এই সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫১ হাজার। ২০০১ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা থেকে গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হয়। সে বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পায় মাত্র ৭৬ জন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ফলাফলকে ইতিবাচক বলেছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেই পাস।

পরীক্ষকেরা যখন উত্তরপত্র নেওয়ার জন্য শিক্ষা বোর্ডে যান, তখন পরীক্ষকদের হাতে উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য নিয়মাবলিসংবলিত একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়। তাতে যে পদ্ধতিতে নম্বর দেওয়ার নির্দেশনা আছে, এতে করে নির্দেশনার উদারতায় আরও বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীর জিপিএ-৫ পাওয়া উচিত। এ বছর প্রশ্ন ফাঁসেরও ঘটনাও ঘটেছিল। সেটা বিবেচনায় নিলে জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা আশানুরূপ হয়নি। বিদ্যমান পদ্ধতিতে জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বৃদ্ধি দেখে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান বেড়েছে এমনটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। জিপিএ-৫-এর পোশাক পরালেই মেধাটা জিপিএ-৫ হবে না; বরং এতে করে শিক্ষার্থীদের পাঠে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। সামান্য পড়লেই, সামান্য লিখলেই যদি কািঙ্ক্ষত ফল পাওয়া যায়; তার জন্য অধিক মনোনিবেশ করার যে প্রয়োজন নেই, তা মাধ্যমিক কেন, প্রাথমিক সমাপনী শিক্ষার্থীরাও জানে।
নানা অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়েই বিকশিত হচ্ছে আমাদের শিক্ষা। সেই অব্যবস্থাপনার মধ্যে একটি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি। বর্তমানে লাখ লাখ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত মূল্যায়ন হচ্ছে ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার দুটোতেই জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় পাসই করতে পারছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা ও ইংরেজিতে ফেল করেছে। অন্যান্য বিষয় তো রয়েছেই। এদের অধিকাংশই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক দুটোতেই জিপিএ-৫ পাওয়া।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর প্রায় এক হাজার ২০০ আসনের বিপরীতে প্রায় ৭১ হাজার শিক্ষার্থী আবেদন করেছিল। ভর্তি পরীক্ষায় সব ইউনিটে পাস করেছিল ৫০০ জনেরও কম। সে জন্য তাদের পাস নম্বর কমিয়ে ভর্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কলা অনুষদে ১৫ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে ইংরেজিতে পাস করেছিল মাত্র ৬৮ জন। জীব ও ভূবিদ্যা অনুষদে প্রায় আট হাজার প্রার্থীর মধ্যে শুধু সাতজন উত্তীর্ণ হয়েছিল। হাজার হাজার জিপিএ-৫ পাওয়া পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণই হতে পারেনি। মূলত আমাদের যে শিক্ষার মান বাড়েনি, এটি তার প্রমাণ।
বর্তমানে প্রাথমিক, নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক—এ চারটি সার্টিফিকেট পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই চারটি পরীক্ষায় বিদ্যমান উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতিতে একজন পরীক্ষক উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন। এ পরীক্ষা পদ্ধতিতে একজন পরীক্ষক এবং একজন প্রধান পরীক্ষক থাকেন। প্রধান পরীক্ষক শুধু নম্বর গণনায় কোথাও ভুল হয়েছে কি না, সেটাই যাচাই করেন। পরীক্ষক যে মূল্যায়নে কোনো ভুল করতে পারেন, তার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। সকল শিক্ষক যে মূল্যায়ন যথাযথভাবে করেন, তা-ও নয়। পরীক্ষকেরা যথাযথ মূল্যায়ন করেন কি না, তা যাচাইয়ের কোনো ব্যবস্থা না থাকার কারণে কেউ কেউ স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নেন। পরীক্ষকদের কোনো জবাবদিহি না থাকার কারণে তাঁরা অনেকেই মনোযোগ সহকারে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন না। এমনও শোনা গেছে, এক রাতে দেড় শ খাতাও কেউ কেউ দেখেন। অনেক সময় নির্বাচনী পরীক্ষায় শিক্ষার্থী খারাপ করলে তাকে চূড়ান্ত পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয় না৷ কিন্তু উত্তরপত্র মূল্যায়ন যথাযথ হয়নি বলে পরীক্ষককে শাস্তি পেতে দেখা যায়নি। যদি কোনো পরীক্ষক উত্তরপত্র মূল্যায়নে ভুল করে, তাহলে তার শাস্তি হচ্ছে ওই উত্তরপত্র মূল্যায়নের পারিশ্রমিক ১৫-২০ টাকা তার থেকে কেটে রাখা। উৎকোচ সাপেক্ষেও অনেক পরীক্ষক উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য সংগ্রহ করে থাকেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
শুধু জিপিএ-৫-এর সংখ্যা আর পাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করলেই শিক্ষার মান বাড়ে না। লাখ লাখ জিপিএ-৫ প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যে ন্যূনতম পাস নম্বরও পাচ্ছে না, সে বিষয়টি সরকারের আমলে নেওয়া প্রয়োজন। জিপিএ-৫-এর গুরুত্ব যাতে কমে না যায়, সেদিকে লক্ষÿ রাখা প্রয়োজন। গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হওয়ার আগে বোর্ডের মধ্যে প্রথম ২০ জন কিংবা স্টার মার্কস প্রাপ্তদের অথবা প্রথম শ্রেণীর একটা বড় কদর ছিল। সনদ দেখেও শিক্ষার্থীদের মান বিচার করা যেত। এখন আর সেই সুযোগ নেই। যেহেতু বিদ্যমান পদ্ধতিতে জিপিএ-৫-ই সর্বোচ্চ ফলাফল, তাই সেটা যেন খেলো না হয়। সনদ দেখে যেন শিক্ষার্থীর কিছুটা মান বিচার করা যায়, সে সুযোগটুকু প্রকৃত মেধাবীরা দাবি করেন। জিপিও-৫-এর সংখ্যাধিক্য দেখে যেন আমাদের বলতে না হয় এত জিপিএ-৫! আবার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের ফেল করা দেখে যেন বলতে না হয়, এত ফেল! সে জন্য শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মূল্যায়ন জরুরি।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর৷
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.