অন্য রানা প্লাজা

ভয় হয়, রানা প্লাজার সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যু না বৃথা যায়
১০৩ বছর আগের ঘটনা, তারিখ ২৫ মার্চ, ১৯১১। নিউইয়র্ক শহরের গ্রিনিচ ভিলেজে, আজকের ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্কের কোলঘেঁষে ১০ তলা এশ ভবন। তার শেষ তিনটি তলায় অর্থাৎ আট, নয় ও দশতলায় ম্যাক্স ব্লাঙ্ক ও আইজাক হ্যারিস কোম্পানির পোশাক তৈরির কারখানা। অধিকাংশ শ্রমিকই মেয়ে, নানা বয়সের; তবে বেশির ভাগই কিশোরী-তরুণী। প্রায় সবাই নানা দেশ থেকে আসা ইহুদি অভিবাসী। শনিবার বিকেলে সবাই কাজ গুছিয়ে যাওয়ার জন্য উসখুস করছেন। দুপুরের শিফট শেষ হতে ঘণ্টা খানেক বাকি।
তখনই হঠাৎ আগুন। প্রথমে আটতলায়, সেখান থেকে দেখতে দেখতে নয়তলা ছাড়িয়ে দশতলায় দাউ দাউ করে সে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। মালিকের কড়া নির্দেশ ছিল শিফট শেষ হওয়ার আগে মূল দরজা খোলা যাবে না। যুক্তি ছিল, দরজা খোলা থাকলে চুরি হতে পারে। প্রতিটি শ্রমিকের হাতের পুঁটলি তন্নতন্ন করে খুঁজে তবে তাঁদের যেতে দেওয়া হতো। দাউ দাউ আগুন, চোখ আঁধার করা ধোঁয়া, মাথার ওপর ভেঙে পড়া ছাদের কাঠ-পাথর। পালাবেন কোথায়, কীভাবে? কেউ কেউ সেই আট-দশতলা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, নিশ্চিত মৃত্যু তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে, সে কথা জেনেও। সর্বমোট ১৪৬ জন শ্রমিক, তাঁদের মধ্যে ১২৩ জন নারী, সেদিন আগুনে দগ্ধ হলেন। আগুন নেভানোর পর শবদেহগুলো উদ্ধার করা হলো বটে, কিন্তু কারও কারও শরীর এমন পোড়া কয়লা হয়ে গেছে যে তাঁদের চেনার পর্যন্ত উপায় ছিল না। এক এক করে সবাইকে তাঁদের দগ্ধ-গলিত দেহ নিয়ে রাখা হলো ম্যানহাটনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ইস্ট রিভারের একটি জেটিতে। শোকাভিভূত নিকটাত্মীয়রা এসে তাঁদের চিহ্নিত করলেন। করা গেল না মাত্র ছয়জনকে, প্রায় এক শ বছর পর, নানা ফরেনসিক পরীক্ষা শেষে তাঁদেরও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। নিউইয়র্কের সেই ‘ট্রায়াঙ্গল ওয়েস্টশার্ট অগ্নিকাণ্ডের’ ঠিক এক শ বছর পর বাংলাদেশের সাভারে রানা প্লাজার অভাবিত অগ্নিকাণ্ড। এখানে মোট নিহতের সংখ্যা তার ১০ গুণ—১১৩৫। প্রায় সবাই মহিলা, কারও কারও বয়স ১৫-১৬। গ্রাম থেকে উঠে আসা এসব মেয়ের স্বপ্ন ছিল নিজেদের ভাগ্য ফেরাবে, পরিবারের ভাগ্য ফেরাবে। ঠিক যে স্বপ্ন এশ ভবনের ইহুদি কিশোরীরা দেখেছিল।
আগুনের ধ্বংসস্তূপের নিচে ট্রায়াঙ্গল স্কয়ার ও রানা প্লাজা একাকার হয়ে যায়। ২৪ এপ্রিল, রানা প্লাজা অগ্নিকাণ্ডের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আমরা জড়ো হয়েছিলাম সেই গ্রিনিচ ভিলেজের এশ ভবনের কয়েক গজের ভেতর অবস্থিত ইউনিয়ন স্কয়ারে। শুধু বাঙালি নয়, নানা দেশের নানা ভাষার মানুষ। এদিন নিউইয়র্কে সকাল থেকে চলেছে বিভিন্ন সভা-মিছিল-পিকেটিং। ইউনিয়ন স্কয়ারের কাছে তৈরি পোশাকের অভিজাত বিপণি চিলড্রেনস প্লেস। সকাল থেকেই সেখানে ধরনা বসেছে, রানা প্লাজার হতাহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ চাই, এই প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে। হাতে হাতে বিলি হয়েছে প্রচারপত্র। কথা ছিল চিলড্রেনস প্লেস আট মিলিয়ন ডলার ক্ষতি পূরণ দেবে, সে অর্থ দিতে তারা এখন গড়িমসি করছে। অথচ চিলড্রেনস প্লেসের প্রধান নির্বাহী জিন এলর্ফাস গত বছর বেতন-বোনাস মিলে একাই আয় করছেন ১৭ মিলিয়ন ডলার। একটি অল্প বয়সী মেয়ে সে প্রচারপত্রের কয়েকটি কপি আমাদের মধ্যে বিলি করে গেল। প্রায় একই সময়ে ডজন খানেক ছাত্রসংগঠন ও শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যদের উদ্যোগে ওয়াশিংটন স্কয়ারে—ঠিক যেখানে ১০৩ বছর আগে পোশাক কারখানায় আগুন ধরেছিল—নানা দেশের মানুষ জড়ো হয়েছিলেন রানা প্লাজার শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে। তাঁদের কেউ কেউ এই জমায়েতেও এলেন সংহতি জানাতে। একজন এসেই স্লোগান ধরলেন, ‘পে-আপ নাও’। বিলম্ব নয়, এখনই ক্ষতিপূরণ চাই। একটি মেয়ে দীর্ঘ একটি ব্যানার মেলে ধরল, তাতেও সেই একই কথা, ‘অবিলম্বে রানা প্লাজা শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ চাই।’ ‘ট্রায়াঙ্গল অগ্নিকাণ্ডকে ভুলো না’—এই নামের একটি জোটের দুজন কর্মী এসেছিলেন একটি রঙিন প্রচারপত্র নিয়ে। ‘বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ও ট্রায়াঙ্গল মেমোরিয়াল কুইল্ট’ উভয়কে একই সঙ্গে যুক্ত করে তারা একটি কাঁথা বানিয়েছেন। ২৮ এপ্রিল এই শহরের সবচেয়ে বড় গির্জা সেইন্ট জন দ্য ডিভাইন-এ দীর্ঘ সেই কাঁথা উদ্বোধন হবে,
চলবে মাস দুই। আমাদের সবাইকে তারা আমন্ত্রণ জানালেন তাতে যোগ দিতে। ‘দ্য গোস্ট অব রানা প্লাজা’ নামে রানা প্লাজায় হতাহত শ্রমিকদের ছবিসংবলিত পোস্ট কার্ড বিলি করা হলো। আমি দুটি সংগ্রহ করলাম, একটিতে রফিকুল নামের এক যুবকের ছবি, আঁধারভরা তাঁর চোখ দুটিই সেখানে দেখি। অন্যটি পাখি নামের এক বালিকার, গোড়ালি থেকে তার দুটি পা কেটে ফেলা হয়েছে, মেয়েটি হাত দিয়ে চোখের জল মুছছে, তার মুখ বা চোখ কিছুই দেখা হয় না। পুলিৎজার সেন্টারের হয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করছেন জেইসন মটলাঘ, এসব ছবি তাঁরই তোলা। আমি জমায়েতে আসা এসব অচেনা বিদেশিকে দেখছিলাম। তাঁরা প্রায় সবাই আমাদের অপরিচিত, নানা ভাষার নানা দেশের, অথচ মনে হয় সবাই যেন আত্মার আত্মীয়। রানা প্লাজায় যে এগারো শর বেশি শ্রমিক নিহত হন, তাঁদের প্রত্যেকের স্মৃতি আগলে রাখতে এঁরা আমাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। যাঁরা নিহত হন, তাঁদের প্রত্যেকের নাম আছে, নামের পেছনে অকালে ঝরে যাওয়া জীবন আছে, আছে অসম্পূর্ণ স্বপ্ন। ট্রায়াঙ্গল মেমোরিয়াল কোয়ালিশন ইতিমধ্যে ১৯০৩ সালের অগ্নিকাণ্ডে নিহত প্রতিটি শ্রমিকের নাম খোদাই করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে। সে কোয়ালিশনের একজন সদস্য রানা প্লাজায় নিহত দুজনের নাম আলাদা করে লিখে কাঁথা বুনে এনেছিলেন। যে কাঁথাটি তাঁরা বুনেছেন, যত নিহত শ্রমিকের নাম তাঁরা সংগ্রহ করতে পারবেন, সুতোর কালিতে তাঁদের প্রত্যেকের নাম গেঁথে রাখা হবে। আমার চোখে জল এসে যায়।
বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে এর আগে আরেকবার, সেই একাত্তরে, এই রকম স্বতঃস্ফূর্তভাবে পৃথিবীর মানুষ তাদের সংহতি জানিয়েছিল। আমি জানি না, যেখানে এসব হতভাগ্য নারী নিহত হলেন, সেই বাংলাদেশে তাঁদের স্মৃতি জাগিয়ে রাখতে ঠিক কী করা হচ্ছে। এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে কথা নিত্যদিন স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যই প্রয়োজন স্মৃতি সরণির। ২৪ এপ্রিলকে ঘোষণা করা উচিত সেই ট্র্যাজেডির স্মারণিক দিবস হিসেবে। তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে শুনিনি। কিন্তু এ তো শুধু আনুষ্ঠানিকতা। যাঁরা নিহত হলেন, তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখার শ্রেষ্ঠ উপায় শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা আদায় করা ও তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। নিউইয়র্কে দিনভর মিটিং-মিছিলের ভেতর দিয়ে সে দাবির কথাই উঠেছে। কিন্তু এই কাজটি সম্পন্ন করতে হলে ব্যবস্থা নিতে হবে বাংলাদেশে। শুধু আন্তর্জাতিক সংহতি অথবা ঢাকার রাস্তায় স্মরণসভা করে সে দাবি অর্জিত হবে না। চিলড্রেনস প্লেসের প্রধান নির্বাহীর মতো আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরাও বোঝেন মুনাফা। সরকারের ভেতর মালিকদের লোকই বেশি, ফলে তাদের ওপর রাজনৈতিক চাপ কম। যা চাপ তার প্রায় সবই আসছে বিদেশ থেকে। ইউরোপে ও আমেরিকায় বাংলাদেশের শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ ও ন্যায্য মজুরির দাবিতে বিভিন্ন অভিজাত ডিপার্টমেন্ট স্টোর বয়কটের ডাক উঠেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের পোশাক খাতের সংস্কার ও শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা শুরু হয়েছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণাপত্র রানা প্লাজার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টার্ন স্কুল অব বিজনেস।
চারদিক থেকে ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে বড় করপোরেশনগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে গার্মেন্টস খাতে নিরাপত্তাসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মত হয়েছে। এ ব্যাপারে ইউরোপীয়রা এগিয়ে। সেখান থেকে ক্ষতিপূরণের অর্থও আসা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও কিছু কিছু আইন সংস্কার করেছে, ন্যূনতম বেতন বাড়িয়েছে, ইউনিয়ন করার অধিকারও সীমিত আকারে দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু শুধু কাগজ-কলমে প্রতিশ্রুতি দিলে তো হবে না। যে অর্থ আসছে, তা যাতে নিহতের স্বজনেরা পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি শ্রমিকের মজুরি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই নতুন আইনের প্রকৃত বাস্তবায়ন। ১৯০৩ সালের ট্রায়াঙ্গল অগ্নিকাণ্ডের পর আমেরিকায় শ্রমিক আইনের বড় রকম পরিবর্তন হয়। শ্রমিকদের সাংগঠনিক তৎপরতাও বহু গুণে বেড়ে যায়। বাংলাদেশে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। শ্রমিকের দাবির পক্ষে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল শ্রমিক সংগঠনগুলোর। কিন্তু বাংলাদেশে প্রকৃত শ্রমিক আন্দোলনের অনেক আগেই মৃত্যু হয়েছে। যেমন মৃত্যু হয়েছে প্রকৃত ছাত্র আন্দোলনের। যাঁরা একসময় নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্রের দাবিতে বুকে গুলি পেতে নিয়েছেন, তাঁরা এখন ব্যস্ত চাঁদাবাজি ও টেন্ডার চালাচালিতে। যাঁরা একসময় টঙ্গীতে শ্রমিকের দাবির সমর্থনে মিছিল করতেন, তাঁদের কেউ কেউ এখন মন্ত্রী। ভয় হয়, রানা প্লাজা ধসে যে সহস্রাধিক শ্রমিক নিহত হয়েছেন, তাঁদের মৃত্যু না বৃথা যায়!
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.