কারো রক্তচক্ষু পরোয়া করে না প্রজন্ম আন্দোলন গণজাগরণ মঞ্চ by কবির য়াহমদ
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ প্রজন্ম চত্বর, শাহবাগ থেকে সারাদেশের মানুষের দাবিকে সামনে নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ঘোষিত হয়, ৬টি দাবি সম্বলিত আল্টিমেটাম।
অনুমিতভাবেই এ দাবি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। গণজাগরণ মঞ্চ আশা করছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার আওয়ামী লীগ সরকার এই গণদাবিকে গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করবে।
কিন্তু, সময়ের ব্যবধানে আশাটুকু আশাবাদের ফাঁকা বুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জামাত-শিবির নিষিদ্ধকরণ প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য দাবিগুলোর বাস্তবায়ন সুদূরপরাহত, যা সত্যিকার অর্থেই একদিকে যেমন লজ্জাজনক ঠিক তেমনিভাবে হতাশাজনকও বটে।
কসাই কাদের ওরফে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায়ের অব্যবহিত পর প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলন একটানা ১৭ দিন চলার পর আল্টিমেটাম এসেছিল। সব যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির এবং জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে সারাদেশের মানুষ একাট্টা হয়েছিল শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গে।
এই আন্দোলন শাহবাগ থেকে শুরু হলেও মুহূর্তে এর রেশ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এমনকি দেশের বাইরেও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। দীর্ঘ ৪২ বছরের জঞ্জাল সাফ করতে মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। দেশের সব শ্রেণীর মানুষের মুখ থেকে প্রতিধ্বনিত হয় একাত্তরের সেই জ্বালাময়ী স্লোগান 'জয় বাংলা'।
এই সেই স্লোগান যা মুখে নিয়ে যে মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল স্বাধীন এক দেশের, সেই স্লোগান আবারও ফিরে আসে জনমানুষের মাঝে।
দীর্ঘদিন পর 'জয় বাংলা' স্লোগান দলীয় সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে গণস্লোগানে রূপ নেয়। তরুণ-যুবা-বৃদ্ধ কেউ বাকি থাকেননি। প্রবল আত্মবিশ্বাসে উচ্চারণ করেন গগনবিদারী কণ্ঠে- 'জয় বাংলা'।
এ যেন এক দ্রোহের রূপ। এর সঙ্গে তুমুল ধিক্কার আর ঘৃণায় মানুষ জামায়াতিদের বর্জন করে 'তুই রাজাকার' ধ্বনিতে, যা গত ৪২ বছরের ইতিহাসে ছিল এক ধরনের তুমুল ভয় জাগানিয়া এক শব্দযুগল! রাজাকারদের 'রাজাকার' বলে ধিক্কার দেওয়ার এই সাহস সঞ্চারিত করেছে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলন।
২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ মার্চ ২০১৩ গণজাগরণ মঞ্চের সুস্পষ্ট দাবি সম্বলিত আল্টিমেটামের সময়কাল। একটু পেছন ফিরে দেখা যাক কী ছিল এই আল্টিমেটাম:
দাবি-১. ঘাতক জামাত শিবিরের সন্ত্রাসী হামলায় শহীদ রাজীব হায়দার, জাফর মুন্সী, বাহাদুর মিয়া, কিশোর রাসেল মাহমুদ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আগামী সাতদিনের মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে।
দাবি-২. ২৬ মার্চের পূর্বে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক সন্ত্রাসী জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারী জামায়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে সংশোধিত আইনের অধীনে অভিযোগ গঠন এবং নিষিদ্ধের আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
দাবি-৩. অবিলম্বে সংগঠনগুলোর আর্থিক উৎস, যেসব উৎস থেকে সকল প্রকার জঙ্গিবাদী এবং দেশবিরোধী তৎপরতার আর্থিক যোগান দেওয়া হয়, সেগুলো চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
দাবি-৪. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া গতিশীল ও অব্যাহত রাখতে অবিলম্বে আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যনালকে স্থায়ীরূপ দিতে হবে।
দাবি-৫. গণমানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস ও তাণ্ডব বন্ধে অবিলম্বে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে সকল সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ গোপন আস্তানাসমূহ উৎখাত করতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদের ভয়ঙ্কর রূপ প্রকাশ করে দিতে হবে।
দাবি-৬. যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষক এবং হত্যা ও সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এই সময়ে পদ্মার জল গড়িয়েছে অনেক দূর। দেশে ঘটেছে অনেক কিছুই, ইতিবাচক-নেতিবাচক। ইতিবাচক কিছুর দিকে তাকালে দেখা যাবে উচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হয়েছে এবং অনেক জল্পনা-কল্পনা এবং অনিশ্চয়তা উপেক্ষা করে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কোনো রাজাকারের চূড়ান্ত রায় কার্যকর হয়েছে। এটা গণজাগরণ মঞ্চ তথা গণমানুষের একটা অর্জন।
গণজাগরণ মঞ্চের ৬টি দাবি বাস্তবায়নের আল্টিমেটামের প্রথম দাবিতে উল্লেখ ছিল জামায়াত-শিবিরের হাতে নিহতদের খুনিদের গ্রেফতারের দাবি। কিন্তু, অবাক করার ব্যাপার হলো গত এক বছরে ব্লগার রাজীব হায়দারের খুনিদের বিচারের মুখোমুখি করতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকার। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে রাজীব হায়দারের বাসায় গিয়ে সহমর্মিতা জানাবার সঙ্গে সঙ্গে বিচারের আশ্বাসবাণী শুনিয়েছিলেন।
উপরোন্তু, মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হয়েছে আরো কিছু নাম। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, গোলাম আযমের মামলার অন্যতম সাক্ষী সুরকার মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাই এবং সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী জগতজ্যোতি তালুকদার। এখানেও ব্যর্থ প্রশাসন। তারা না দিতে পেরেছে নিরাপত্তা, না করতে পেরেছে খুনিদের গ্রেফতার!
দ্বিতীয় দাবিটি জনমানুষের মুখে মুখে মুখে উচ্চারিত যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধকরণের। কিন্তু দীর্ঘ এক বছরাধিক কাল অতিক্রমের পরও জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়নি। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন যখন তুঙ্গে ছিল, তখন সরকার এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে এ নিয়ে কিছুটা ইতিবাচক কথা শোনা গেলেও কালক্রমে তা মিইয়ে এসেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামীলীগ সরকার এটাকে উপলক্ষ করে রাজনীতি করতে চায়। আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের কিছু নেতার মুখে এই দাবির সপক্ষে কথা শোনা গেলেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনকি গত বছর মহান জাতীয় সংসদেও এ নিয়ে অনির্ধারিত আলোচনা হয়েছিল।
কিন্তু অবাক করার ব্যাপার যে সংসদ সদস্যরা প্রস্তাব তুলবেন, তারা নিজেরাও দাবি জানিয়ে গেছেন। ফলাফল তথৈবচ! এর মধ্যে অবশ্য জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে হাইকোর্টে রাজনৈতিক দল হিসেবে দলটির নিবন্ধন চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট মামলা ফের আলোচনায় এসেছে। হাইকোর্টের আদেশে জামায়াতের রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের বৈধতা হারিয়েছে। এখন তারা দলগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত। দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের সুযোগ হারালেও তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে সদ্যসমাপ্ত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে, যেখানে তাদের অনেক প্রার্থী জয়লাভও করেছেন।
তবে আশার কথা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামী দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠিত হয়েছে এবং তারা দলগতভাবে বিচারের মুখোমুখি হচ্ছে।
আমাদের সংবিধানের ৩৮(গ), ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২০(১) এবং ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনেই জঙ্গি সংগঠন হিসেবে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন ছিল সরকারের সদিচ্ছা। কিন্তু এর অভাব প্রকট বলে দৃশ্যমান হচ্ছে। সাঈদীর রায় পরবর্তী সময়ের সন্ত্রাস, দেশকে গৃহযুদ্ধের হুমকি ইত্যকার নানা বিষয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির প্রকৃতই সন্ত্রাসনির্ভর জঙ্গি সংগঠন। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমনের অঙ্গীকারের দিকে দৃষ্টিপাত করলে তাদেরকে নির্বাহী আদেশেই নিষিদ্ধ করা যেতো। এটা ব্যতিক্রমী কোনো দৃষ্টান্ত হিসেবেও পরিগণিত হয় না। কারণ, এর আগে নির্বাহী আদেশে আরো কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়ছিল।
তাছাড়া যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে প্রমাণিত দল জামায়াতে ইসলামী, সে ঘোষণাও দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) মানবতাবিরোধী অপরাধীদের রায়ের আদেশে। দেশের স্বাধীনতা এবং জন্মের যারা বিরোধিতা করে তাদের এই দেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার থাকতে পারে না।
জামায়াত-শিবির শুধুমাত্রই সন্ত্রাসের মাধ্যমেই দেশের অগ্রগতির যাত্রাপথকে রুদ্ধ করছে তা নয়, তাদের পরিচালিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান সারাদেশে তাদের সন্ত্রাস এবং জঙ্গি অর্থায়নের মূল উৎস।
ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সেবা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ তারা জঙ্গিদের অর্থায়নে ব্যয় করছে। গণজাগরণ মঞ্চের উত্থাপিত দাবির মধ্যে ছিল এসব প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করতে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে এর উৎস খুঁজে বের করে প্রয়োজনে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করা, যাতে করে জঙ্গি অর্থায়নের জন্য তা ব্যয়িত না হয়। গত এক বছরে এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উপরোন্তু, সরকার যখন জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে বিশ্বরেকর্ড করার ঘোষণা দিলো, সেখানে ইসলামী ব্যাংক তিন কোটি টাকার অনুদান দিলো এবং সরকারও সেটা গ্রহণ করলো।
পরবর্তীতে অবশ্য সরকার বাধ্য হয়েছে জাতীয় সঙ্গীত অনুষ্ঠানে জাতীয় ব্যাংকের টাকা ব্যবহার করবে না বলে ঘোষণা দিতে। তবু তারা টাকাগুলো ফিরিয়ে দেয়নি এবং জামায়াতের প্রতিষ্ঠান ইবনে সিনা'র প্রস্তুত করা খাবার স্যালাইন সরবরাহ করেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) এই মুহূর্তে যে সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, তারাই সর্বশেষ চিহ্নিত রাজাকার নয়। এর বাইরেও আরো অনেক যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার রয়েছেন। আরো কয়েকটি অভিযোগ দায়ের করা হচ্ছে বলে জানা গেছে এবং পর্যায়ক্রমে তাদের বিচারও হবে।
গণজাগরণ মঞ্চ দাবি করেছে, এই ট্রাইব্যুনালকে স্থায়ী রূপদানের। কারণ, কেবলমাত্র স্থায়ী রূপদানের মাধ্যমে এই আদালত স্থায়িত্ব পেতো। ফলে, সরকার পরিবর্তন হলেও এই আদালত একইভাবে একই ধরনের অপরাধের জন্য বিচার করতে পারতো। কলঙ্কমোচনের একটা চিরস্থায়ী রূপের জন্য যা খুবই প্রয়োজন ছিল।
আল্টিমেটামের এক বছর অতিক্রমের পরেও এ নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি। তবে আশার কথা, আরো কিছু অভিযোগ চূড়ান্ত পর্যায়ে উত্থাপনের অপেক্ষায় এবং একটা সময়ে হয়ত স্থায়ী রূপ দেওয়ার চিন্তাভাবনা আসতে পারে।
আরব বিশ্বসহ বেশ কিছু মুসলিম প্রধান দেশের কাছে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের একমাত্র ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠন। ফলে, সেখান থেকে তারা প্রচুর পরিমাণে অর্থ সাহায্য পেয়ে আসছে, যা খরচ করছে সারাদেশে সন্ত্রাস সৃষ্টিতে। দেশের মধ্যকার তাদের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীরূপ বাইরে প্রচার হয় না বলে তাদের জন্য সুবিধা হয়েছে। ভেতরের রূপ বাইরে প্রকাশ না হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক লবিংয়ের মাধ্যমে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। সারাদেশে রয়েছে তাদের সুশৃঙ্খল ক্যাডার বাহিনী; যাদের হাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র।
ফলে, তারা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠছে ক্রমশ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে তারা এই রকম পেশিশক্তি অর্জনে সমর্থ হয়েছে। কোনো সরকারই তাদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসেনি; বরং উল্টো লালন-পালন করেছে।
গণজাগরণ মঞ্চের একটা অন্যতম দাবি ছিল তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার। কিন্তু গত এক বছরে দৃশ্যমান কোনো অভিযান পরিচালিত হয়নি। সাঈদীর রায়ের পর যে সন্ত্রাস পরিচালিত হয়েছে তাদের দ্বারা এটা তাদের সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডের একটা অন্যতম নজির। উপরোন্তু, রয়েছে দেশের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের হুমকি। এত কিছুর পরেও তাদের বিপক্ষে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
তাছাড়া গত জাতীয় নির্বাচনের পর দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় জামায়াত-শিবিরের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক হামলা পরিচালিত হয়েছিল। সাতক্ষীরাসহ বেশ কয়েকটি জায়গাকে মিডিয়া 'মিনি পাকিস্তান' বলেও খবর প্রকাশ করেছিল।
গণজাগরণ মঞ্চের ৬ দফা দাবির মধ্যে ছিল যুদ্ধাপরাধীদের দোসর মিডিয়া এবং সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা মিডিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ, মিডিয়া জনমত সংগঠনের ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কিছু মিডিয়া বিশেষ করে মাহমুদুর রহমানের 'আমার দেশ', 'সংগ্রাম', 'ইনকিলাব', 'নয়াদিগন্ত' এবং 'দিগন্ত টিভি' সংবাদের নামে যা প্রচার করছে, তা স্রেফ মিথ্যাচার।
উল্লিখিত মিডিয়াগুলো বিশেষ করে 'আমার দেশ' পত্রিকা সংবাদের নামে হলুদ সাংবাদিকতাকে ধারণ করতো। তাদের উস্কানিতে ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সারাদেশে হেফাজতে ইসলামের আড়ালে জামায়াত-শিবির ব্যাপক সন্ত্রাস করেছে, হামলা করেছে শহীদ মিনারে, ছিঁড়েছে জাতীয় পতাকা এবং ভাঙচুর করেছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত তারুণ্যের অবিনশ্বর কীর্তি গণজাগরণ মঞ্চ। এর নেপথ্যে রয়েছেন মাহমুদুর রহমান।
তাকে গ্রেফতার করতে বিভিন্ন সময়ে দাবি জানানো হলেও সরকার প্রথম দিকে কর্ণপাত করেনি। যখন গ্রেফতার করলো তার আগেই অনেক সর্বনাশ হয়ে গেছে। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানকে দৈনিক ইনকিলাব প্রচার করেছিল র্যাব এবং ভারতীয় বাহিনীর যৌথ অভিযান বলে। পরে তারা সে খবর প্রত্যাহার করে নিলেও আদতে অনেক ক্ষতি হয়ে যায় তার আগেই।
সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো এসব মিডিয়া দেশে সাম্প্রদায়িক উস্কানির সঙ্গে সঙ্গে আস্তিক-নাস্তিক ধুয়া তুলে জাতিকে বিভক্ত করার অপচেষ্টা করছে। এক শ্রেণীর মৌলবাদীকে উস্কানি দিয়ে মুক্তমতের মানুষের ওপর হামলাকে বৈধতার চাদরে লেপ্টে দিচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশের।
গণজাগরণ মঞ্চের আল্টিমেটাম এবং এক বছর সময়ে সার্বিক পরিস্থিতি খেয়াল করলে অনেকেই সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ দেখে হতাশই হবেন হয়ত। এই শাহবাগ আন্দোলন যেমন কারো একার উদ্যোগে গড়ে ওঠেনি এবং কেউ একা এর মূলেও না। এক থেকে পাঁচ হয়ে এই আন্দোলন এখন সারাদেশের মানুষের দাবিকে প্রতিনিধিত্ব করে। প্রান্তিক মানুষ নিজেরাই নির্ধারণ করে নিচ্ছে, আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি। তাই, সরকার যেখানে ব্যর্থ কিংবা দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করে কিংবা অপারগ, সেখানে মানুষ নিজেরাই নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে।
আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে যেমন কেউ গভীরভাবে ভাবছেন না, তেমনিভাবে জাগরণকে আগামী দিনের পাথেয় হিসেবে দেখছে, সবাই।
গণজাগরণ আন্দোলনে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল। এর মধ্যে অনেকেরই রাজনৈতিক পরিচয় ছিল কিন্তু স্লোগানে স্লোগানে সবাই এক মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছিল। গণজাগরণ মঞ্চ শুধু ফাঁসির দাবি নিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি গণমানুষের আবেগের প্রতি সম্মান জানিয়ে রানা প্লাজার অসহায় মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সাম্প্রদায়িক হামলায় অসহায় মানুষদের পাশে গিয়ে বলেছিল, তারাও মানুষ এবং মানুষের পাশে মানুষই দাঁড়ায়, ধর্ম মানুষকে বিভক্ত করে না। পাকিস্তান যখন কাদের মোল্লার ফাঁসির পর ন্যাক্কারজনক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল, তখন গণজাগরণ মঞ্চ মানুষের কাছে গিয়ে বলেছিল- আমাদের জন্মশত্রু পাকিস্তানি পণ্য বর্জন করতে।
'গুন্ডে' সিনেমাতে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য সন্নিবেশ হয়েছিল, তখন গণজাগরণ মঞ্চ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ভারতীয়দের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রত্যাহার করতে।
গত এক বছরে গণজাগরণ মঞ্চের ছয় দফা দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। তবে এই দাবি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে সন্দেহ নেই। তীব্র অপপ্রচার উপেক্ষা করে মানুষ জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চাইছে। কিন্তু সরকার তা খুব বেশি আমলে নিচ্ছে না। উপরোন্তু, সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ করলে দেখা যাবে, সরকার গণজাগরণ মঞ্চকে তার প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করেছে।
ছাত্রলীগ গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে অনেক দিন ধরেই। সর্বশেষ ৩ এপ্রিল ২০১৪ তারা শাহবাগে মঞ্চকর্মীদের হামলা করে। পরের দিন পুলিশ হামলা করে, গ্রেফতার করে নিয়ে যায় অন্তত ৬ জন কর্মীকে। হামলার দায় একদিকে ছাত্রলীগ অস্বীকার করে আবার অন্যদিকে হাস্যকরভাবে প্রমাণ করতে পারলে জাতীয় প্রেসক্লাবে দাঁড়িয়ে ক্ষমা প্রার্থনার ঘোষণা দেয়।
একইভাবে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতারা মঞ্চ বন্ধ করে দেওয়ারও নসিহত প্রদান করেন। অথচ তারা ভুলে গেছেন কারো ডাকে গণজাগরণ গঠিত হয়নি এবং একইভাবে কারো ডাক-আহ্বানে তা বন্ধ হওয়ারও নয়। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন নিজেরাই দাবি করে, তারা গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে গণজাগরণ মঞ্চ ত্যাগ করেছে। মঞ্চ ছাড়ার এক বছর পর কেন তারা কোন যুক্তিতে আবারও গণজাগরণ মঞ্চের পেছনে লেগেছে, সেটা প্রশ্নের উদ্রেক করে বৈকি!
বিপ্লব কিংবা আন্দোলন হয়ত শুরু হয় হুট করে কিন্তু এর ফল আসে ধীরে ধীরে। ধীরে আসা ফলের স্থায়িত্বও দেশি। কেউ ভাবেনি বায়ান্ন'র ভাষা আন্দোলনের পর বাংলাদেশের স্বাধীন হতে সময় লাগবে আরো বছর ঊনিশ! ঠিক তেমনিভাবে হয়ত রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে যে আন্দোলন শুরু হলো ২০১৩-তে, তার চূড়ান্ত ফল আসবে কবে কেউ কী জানে?
তবে আমাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস বলে বাঙালি হারে না। তারা জেতে এবং জেতেই চলে! বাঙালির এই বিজয়রথ আগেও যেমন কেউ থামাতে পারেনি; এখনো পারবে না!
মানুষ শাহবাগ আন্দোলনের মাধ্যমে 'জয় বাংলা' স্লোগান যেমন নিজেদের দখলে নিতে পেরেছে তেমনিভাবে পেরেছে সমুচ্চ ধিক্কার জানিয়ে বলতে 'তুই রাজাকার'। মানুষের মাঝে একাত্তরের চেতনা আর দেশপ্রেম যেভাবে জেগে উঠেছে, সেটাকে যদি অর্জন হিসেবে ধরে নিই, তবে বলে দেওয়া যায়, এই দেশের জনগণ যেমন হারেনি একাত্তরে, তেমনিভাবে হারবে না এই সময়েও! সরকার আসবে-যাবে, কিন্তু চেতনা রয়ে যাবে আজন্ম। এই চেতনার মশাল জ্বালিয়ে দিয়েছে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এর হাত ধরেই!
কারো রক্তচক্ষু পরোয়া করেনি বাঙালি; কারো রক্তচক্ষু পরোয়া করে না প্রজন্ম আন্দোলন গণজাগরণ মঞ্চ!
কবির য়াহমদ, ব্লগার অ্যাক্টিভিস্ট: Kabiraahmed007@gmail.com
অনুমিতভাবেই এ দাবি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। গণজাগরণ মঞ্চ আশা করছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার আওয়ামী লীগ সরকার এই গণদাবিকে গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করবে।
কিন্তু, সময়ের ব্যবধানে আশাটুকু আশাবাদের ফাঁকা বুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জামাত-শিবির নিষিদ্ধকরণ প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য দাবিগুলোর বাস্তবায়ন সুদূরপরাহত, যা সত্যিকার অর্থেই একদিকে যেমন লজ্জাজনক ঠিক তেমনিভাবে হতাশাজনকও বটে।
কসাই কাদের ওরফে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায়ের অব্যবহিত পর প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলন একটানা ১৭ দিন চলার পর আল্টিমেটাম এসেছিল। সব যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির এবং জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে সারাদেশের মানুষ একাট্টা হয়েছিল শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গে।
এই আন্দোলন শাহবাগ থেকে শুরু হলেও মুহূর্তে এর রেশ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এমনকি দেশের বাইরেও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। দীর্ঘ ৪২ বছরের জঞ্জাল সাফ করতে মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। দেশের সব শ্রেণীর মানুষের মুখ থেকে প্রতিধ্বনিত হয় একাত্তরের সেই জ্বালাময়ী স্লোগান 'জয় বাংলা'।
এই সেই স্লোগান যা মুখে নিয়ে যে মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল স্বাধীন এক দেশের, সেই স্লোগান আবারও ফিরে আসে জনমানুষের মাঝে।
দীর্ঘদিন পর 'জয় বাংলা' স্লোগান দলীয় সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে গণস্লোগানে রূপ নেয়। তরুণ-যুবা-বৃদ্ধ কেউ বাকি থাকেননি। প্রবল আত্মবিশ্বাসে উচ্চারণ করেন গগনবিদারী কণ্ঠে- 'জয় বাংলা'।
এ যেন এক দ্রোহের রূপ। এর সঙ্গে তুমুল ধিক্কার আর ঘৃণায় মানুষ জামায়াতিদের বর্জন করে 'তুই রাজাকার' ধ্বনিতে, যা গত ৪২ বছরের ইতিহাসে ছিল এক ধরনের তুমুল ভয় জাগানিয়া এক শব্দযুগল! রাজাকারদের 'রাজাকার' বলে ধিক্কার দেওয়ার এই সাহস সঞ্চারিত করেছে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলন।
২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ মার্চ ২০১৩ গণজাগরণ মঞ্চের সুস্পষ্ট দাবি সম্বলিত আল্টিমেটামের সময়কাল। একটু পেছন ফিরে দেখা যাক কী ছিল এই আল্টিমেটাম:
দাবি-১. ঘাতক জামাত শিবিরের সন্ত্রাসী হামলায় শহীদ রাজীব হায়দার, জাফর মুন্সী, বাহাদুর মিয়া, কিশোর রাসেল মাহমুদ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আগামী সাতদিনের মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে।
দাবি-২. ২৬ মার্চের পূর্বে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক সন্ত্রাসী জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারী জামায়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে সংশোধিত আইনের অধীনে অভিযোগ গঠন এবং নিষিদ্ধের আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
দাবি-৩. অবিলম্বে সংগঠনগুলোর আর্থিক উৎস, যেসব উৎস থেকে সকল প্রকার জঙ্গিবাদী এবং দেশবিরোধী তৎপরতার আর্থিক যোগান দেওয়া হয়, সেগুলো চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
দাবি-৪. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া গতিশীল ও অব্যাহত রাখতে অবিলম্বে আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যনালকে স্থায়ীরূপ দিতে হবে।
দাবি-৫. গণমানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস ও তাণ্ডব বন্ধে অবিলম্বে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে সকল সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ গোপন আস্তানাসমূহ উৎখাত করতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদের ভয়ঙ্কর রূপ প্রকাশ করে দিতে হবে।
দাবি-৬. যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষক এবং হত্যা ও সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এই সময়ে পদ্মার জল গড়িয়েছে অনেক দূর। দেশে ঘটেছে অনেক কিছুই, ইতিবাচক-নেতিবাচক। ইতিবাচক কিছুর দিকে তাকালে দেখা যাবে উচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হয়েছে এবং অনেক জল্পনা-কল্পনা এবং অনিশ্চয়তা উপেক্ষা করে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কোনো রাজাকারের চূড়ান্ত রায় কার্যকর হয়েছে। এটা গণজাগরণ মঞ্চ তথা গণমানুষের একটা অর্জন।
গণজাগরণ মঞ্চের ৬টি দাবি বাস্তবায়নের আল্টিমেটামের প্রথম দাবিতে উল্লেখ ছিল জামায়াত-শিবিরের হাতে নিহতদের খুনিদের গ্রেফতারের দাবি। কিন্তু, অবাক করার ব্যাপার হলো গত এক বছরে ব্লগার রাজীব হায়দারের খুনিদের বিচারের মুখোমুখি করতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকার। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে রাজীব হায়দারের বাসায় গিয়ে সহমর্মিতা জানাবার সঙ্গে সঙ্গে বিচারের আশ্বাসবাণী শুনিয়েছিলেন।
উপরোন্তু, মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হয়েছে আরো কিছু নাম। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, গোলাম আযমের মামলার অন্যতম সাক্ষী সুরকার মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাই এবং সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী জগতজ্যোতি তালুকদার। এখানেও ব্যর্থ প্রশাসন। তারা না দিতে পেরেছে নিরাপত্তা, না করতে পেরেছে খুনিদের গ্রেফতার!
দ্বিতীয় দাবিটি জনমানুষের মুখে মুখে মুখে উচ্চারিত যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধকরণের। কিন্তু দীর্ঘ এক বছরাধিক কাল অতিক্রমের পরও জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়নি। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন যখন তুঙ্গে ছিল, তখন সরকার এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে এ নিয়ে কিছুটা ইতিবাচক কথা শোনা গেলেও কালক্রমে তা মিইয়ে এসেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামীলীগ সরকার এটাকে উপলক্ষ করে রাজনীতি করতে চায়। আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের কিছু নেতার মুখে এই দাবির সপক্ষে কথা শোনা গেলেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনকি গত বছর মহান জাতীয় সংসদেও এ নিয়ে অনির্ধারিত আলোচনা হয়েছিল।
কিন্তু অবাক করার ব্যাপার যে সংসদ সদস্যরা প্রস্তাব তুলবেন, তারা নিজেরাও দাবি জানিয়ে গেছেন। ফলাফল তথৈবচ! এর মধ্যে অবশ্য জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে হাইকোর্টে রাজনৈতিক দল হিসেবে দলটির নিবন্ধন চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট মামলা ফের আলোচনায় এসেছে। হাইকোর্টের আদেশে জামায়াতের রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের বৈধতা হারিয়েছে। এখন তারা দলগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত। দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের সুযোগ হারালেও তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে সদ্যসমাপ্ত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে, যেখানে তাদের অনেক প্রার্থী জয়লাভও করেছেন।
তবে আশার কথা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামী দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠিত হয়েছে এবং তারা দলগতভাবে বিচারের মুখোমুখি হচ্ছে।
আমাদের সংবিধানের ৩৮(গ), ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২০(১) এবং ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনেই জঙ্গি সংগঠন হিসেবে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন ছিল সরকারের সদিচ্ছা। কিন্তু এর অভাব প্রকট বলে দৃশ্যমান হচ্ছে। সাঈদীর রায় পরবর্তী সময়ের সন্ত্রাস, দেশকে গৃহযুদ্ধের হুমকি ইত্যকার নানা বিষয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির প্রকৃতই সন্ত্রাসনির্ভর জঙ্গি সংগঠন। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমনের অঙ্গীকারের দিকে দৃষ্টিপাত করলে তাদেরকে নির্বাহী আদেশেই নিষিদ্ধ করা যেতো। এটা ব্যতিক্রমী কোনো দৃষ্টান্ত হিসেবেও পরিগণিত হয় না। কারণ, এর আগে নির্বাহী আদেশে আরো কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়ছিল।
তাছাড়া যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে প্রমাণিত দল জামায়াতে ইসলামী, সে ঘোষণাও দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) মানবতাবিরোধী অপরাধীদের রায়ের আদেশে। দেশের স্বাধীনতা এবং জন্মের যারা বিরোধিতা করে তাদের এই দেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার থাকতে পারে না।
জামায়াত-শিবির শুধুমাত্রই সন্ত্রাসের মাধ্যমেই দেশের অগ্রগতির যাত্রাপথকে রুদ্ধ করছে তা নয়, তাদের পরিচালিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান সারাদেশে তাদের সন্ত্রাস এবং জঙ্গি অর্থায়নের মূল উৎস।
ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সেবা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ তারা জঙ্গিদের অর্থায়নে ব্যয় করছে। গণজাগরণ মঞ্চের উত্থাপিত দাবির মধ্যে ছিল এসব প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করতে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে এর উৎস খুঁজে বের করে প্রয়োজনে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করা, যাতে করে জঙ্গি অর্থায়নের জন্য তা ব্যয়িত না হয়। গত এক বছরে এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উপরোন্তু, সরকার যখন জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে বিশ্বরেকর্ড করার ঘোষণা দিলো, সেখানে ইসলামী ব্যাংক তিন কোটি টাকার অনুদান দিলো এবং সরকারও সেটা গ্রহণ করলো।
পরবর্তীতে অবশ্য সরকার বাধ্য হয়েছে জাতীয় সঙ্গীত অনুষ্ঠানে জাতীয় ব্যাংকের টাকা ব্যবহার করবে না বলে ঘোষণা দিতে। তবু তারা টাকাগুলো ফিরিয়ে দেয়নি এবং জামায়াতের প্রতিষ্ঠান ইবনে সিনা'র প্রস্তুত করা খাবার স্যালাইন সরবরাহ করেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) এই মুহূর্তে যে সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, তারাই সর্বশেষ চিহ্নিত রাজাকার নয়। এর বাইরেও আরো অনেক যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার রয়েছেন। আরো কয়েকটি অভিযোগ দায়ের করা হচ্ছে বলে জানা গেছে এবং পর্যায়ক্রমে তাদের বিচারও হবে।
গণজাগরণ মঞ্চ দাবি করেছে, এই ট্রাইব্যুনালকে স্থায়ী রূপদানের। কারণ, কেবলমাত্র স্থায়ী রূপদানের মাধ্যমে এই আদালত স্থায়িত্ব পেতো। ফলে, সরকার পরিবর্তন হলেও এই আদালত একইভাবে একই ধরনের অপরাধের জন্য বিচার করতে পারতো। কলঙ্কমোচনের একটা চিরস্থায়ী রূপের জন্য যা খুবই প্রয়োজন ছিল।
আল্টিমেটামের এক বছর অতিক্রমের পরেও এ নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি। তবে আশার কথা, আরো কিছু অভিযোগ চূড়ান্ত পর্যায়ে উত্থাপনের অপেক্ষায় এবং একটা সময়ে হয়ত স্থায়ী রূপ দেওয়ার চিন্তাভাবনা আসতে পারে।
আরব বিশ্বসহ বেশ কিছু মুসলিম প্রধান দেশের কাছে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের একমাত্র ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠন। ফলে, সেখান থেকে তারা প্রচুর পরিমাণে অর্থ সাহায্য পেয়ে আসছে, যা খরচ করছে সারাদেশে সন্ত্রাস সৃষ্টিতে। দেশের মধ্যকার তাদের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীরূপ বাইরে প্রচার হয় না বলে তাদের জন্য সুবিধা হয়েছে। ভেতরের রূপ বাইরে প্রকাশ না হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক লবিংয়ের মাধ্যমে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। সারাদেশে রয়েছে তাদের সুশৃঙ্খল ক্যাডার বাহিনী; যাদের হাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র।
ফলে, তারা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠছে ক্রমশ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে তারা এই রকম পেশিশক্তি অর্জনে সমর্থ হয়েছে। কোনো সরকারই তাদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসেনি; বরং উল্টো লালন-পালন করেছে।
গণজাগরণ মঞ্চের একটা অন্যতম দাবি ছিল তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার। কিন্তু গত এক বছরে দৃশ্যমান কোনো অভিযান পরিচালিত হয়নি। সাঈদীর রায়ের পর যে সন্ত্রাস পরিচালিত হয়েছে তাদের দ্বারা এটা তাদের সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডের একটা অন্যতম নজির। উপরোন্তু, রয়েছে দেশের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের হুমকি। এত কিছুর পরেও তাদের বিপক্ষে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
তাছাড়া গত জাতীয় নির্বাচনের পর দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় জামায়াত-শিবিরের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক হামলা পরিচালিত হয়েছিল। সাতক্ষীরাসহ বেশ কয়েকটি জায়গাকে মিডিয়া 'মিনি পাকিস্তান' বলেও খবর প্রকাশ করেছিল।
গণজাগরণ মঞ্চের ৬ দফা দাবির মধ্যে ছিল যুদ্ধাপরাধীদের দোসর মিডিয়া এবং সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা মিডিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ, মিডিয়া জনমত সংগঠনের ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কিছু মিডিয়া বিশেষ করে মাহমুদুর রহমানের 'আমার দেশ', 'সংগ্রাম', 'ইনকিলাব', 'নয়াদিগন্ত' এবং 'দিগন্ত টিভি' সংবাদের নামে যা প্রচার করছে, তা স্রেফ মিথ্যাচার।
উল্লিখিত মিডিয়াগুলো বিশেষ করে 'আমার দেশ' পত্রিকা সংবাদের নামে হলুদ সাংবাদিকতাকে ধারণ করতো। তাদের উস্কানিতে ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সারাদেশে হেফাজতে ইসলামের আড়ালে জামায়াত-শিবির ব্যাপক সন্ত্রাস করেছে, হামলা করেছে শহীদ মিনারে, ছিঁড়েছে জাতীয় পতাকা এবং ভাঙচুর করেছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত তারুণ্যের অবিনশ্বর কীর্তি গণজাগরণ মঞ্চ। এর নেপথ্যে রয়েছেন মাহমুদুর রহমান।
তাকে গ্রেফতার করতে বিভিন্ন সময়ে দাবি জানানো হলেও সরকার প্রথম দিকে কর্ণপাত করেনি। যখন গ্রেফতার করলো তার আগেই অনেক সর্বনাশ হয়ে গেছে। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানকে দৈনিক ইনকিলাব প্রচার করেছিল র্যাব এবং ভারতীয় বাহিনীর যৌথ অভিযান বলে। পরে তারা সে খবর প্রত্যাহার করে নিলেও আদতে অনেক ক্ষতি হয়ে যায় তার আগেই।
সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো এসব মিডিয়া দেশে সাম্প্রদায়িক উস্কানির সঙ্গে সঙ্গে আস্তিক-নাস্তিক ধুয়া তুলে জাতিকে বিভক্ত করার অপচেষ্টা করছে। এক শ্রেণীর মৌলবাদীকে উস্কানি দিয়ে মুক্তমতের মানুষের ওপর হামলাকে বৈধতার চাদরে লেপ্টে দিচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশের।
গণজাগরণ মঞ্চের আল্টিমেটাম এবং এক বছর সময়ে সার্বিক পরিস্থিতি খেয়াল করলে অনেকেই সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ দেখে হতাশই হবেন হয়ত। এই শাহবাগ আন্দোলন যেমন কারো একার উদ্যোগে গড়ে ওঠেনি এবং কেউ একা এর মূলেও না। এক থেকে পাঁচ হয়ে এই আন্দোলন এখন সারাদেশের মানুষের দাবিকে প্রতিনিধিত্ব করে। প্রান্তিক মানুষ নিজেরাই নির্ধারণ করে নিচ্ছে, আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি। তাই, সরকার যেখানে ব্যর্থ কিংবা দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করে কিংবা অপারগ, সেখানে মানুষ নিজেরাই নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে।
আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে যেমন কেউ গভীরভাবে ভাবছেন না, তেমনিভাবে জাগরণকে আগামী দিনের পাথেয় হিসেবে দেখছে, সবাই।
গণজাগরণ আন্দোলনে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল। এর মধ্যে অনেকেরই রাজনৈতিক পরিচয় ছিল কিন্তু স্লোগানে স্লোগানে সবাই এক মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছিল। গণজাগরণ মঞ্চ শুধু ফাঁসির দাবি নিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি গণমানুষের আবেগের প্রতি সম্মান জানিয়ে রানা প্লাজার অসহায় মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সাম্প্রদায়িক হামলায় অসহায় মানুষদের পাশে গিয়ে বলেছিল, তারাও মানুষ এবং মানুষের পাশে মানুষই দাঁড়ায়, ধর্ম মানুষকে বিভক্ত করে না। পাকিস্তান যখন কাদের মোল্লার ফাঁসির পর ন্যাক্কারজনক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল, তখন গণজাগরণ মঞ্চ মানুষের কাছে গিয়ে বলেছিল- আমাদের জন্মশত্রু পাকিস্তানি পণ্য বর্জন করতে।
'গুন্ডে' সিনেমাতে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য সন্নিবেশ হয়েছিল, তখন গণজাগরণ মঞ্চ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ভারতীয়দের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রত্যাহার করতে।
গত এক বছরে গণজাগরণ মঞ্চের ছয় দফা দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। তবে এই দাবি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে সন্দেহ নেই। তীব্র অপপ্রচার উপেক্ষা করে মানুষ জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চাইছে। কিন্তু সরকার তা খুব বেশি আমলে নিচ্ছে না। উপরোন্তু, সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ করলে দেখা যাবে, সরকার গণজাগরণ মঞ্চকে তার প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করেছে।
ছাত্রলীগ গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে অনেক দিন ধরেই। সর্বশেষ ৩ এপ্রিল ২০১৪ তারা শাহবাগে মঞ্চকর্মীদের হামলা করে। পরের দিন পুলিশ হামলা করে, গ্রেফতার করে নিয়ে যায় অন্তত ৬ জন কর্মীকে। হামলার দায় একদিকে ছাত্রলীগ অস্বীকার করে আবার অন্যদিকে হাস্যকরভাবে প্রমাণ করতে পারলে জাতীয় প্রেসক্লাবে দাঁড়িয়ে ক্ষমা প্রার্থনার ঘোষণা দেয়।
একইভাবে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতারা মঞ্চ বন্ধ করে দেওয়ারও নসিহত প্রদান করেন। অথচ তারা ভুলে গেছেন কারো ডাকে গণজাগরণ গঠিত হয়নি এবং একইভাবে কারো ডাক-আহ্বানে তা বন্ধ হওয়ারও নয়। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন নিজেরাই দাবি করে, তারা গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে গণজাগরণ মঞ্চ ত্যাগ করেছে। মঞ্চ ছাড়ার এক বছর পর কেন তারা কোন যুক্তিতে আবারও গণজাগরণ মঞ্চের পেছনে লেগেছে, সেটা প্রশ্নের উদ্রেক করে বৈকি!
বিপ্লব কিংবা আন্দোলন হয়ত শুরু হয় হুট করে কিন্তু এর ফল আসে ধীরে ধীরে। ধীরে আসা ফলের স্থায়িত্বও দেশি। কেউ ভাবেনি বায়ান্ন'র ভাষা আন্দোলনের পর বাংলাদেশের স্বাধীন হতে সময় লাগবে আরো বছর ঊনিশ! ঠিক তেমনিভাবে হয়ত রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে যে আন্দোলন শুরু হলো ২০১৩-তে, তার চূড়ান্ত ফল আসবে কবে কেউ কী জানে?
তবে আমাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস বলে বাঙালি হারে না। তারা জেতে এবং জেতেই চলে! বাঙালির এই বিজয়রথ আগেও যেমন কেউ থামাতে পারেনি; এখনো পারবে না!
মানুষ শাহবাগ আন্দোলনের মাধ্যমে 'জয় বাংলা' স্লোগান যেমন নিজেদের দখলে নিতে পেরেছে তেমনিভাবে পেরেছে সমুচ্চ ধিক্কার জানিয়ে বলতে 'তুই রাজাকার'। মানুষের মাঝে একাত্তরের চেতনা আর দেশপ্রেম যেভাবে জেগে উঠেছে, সেটাকে যদি অর্জন হিসেবে ধরে নিই, তবে বলে দেওয়া যায়, এই দেশের জনগণ যেমন হারেনি একাত্তরে, তেমনিভাবে হারবে না এই সময়েও! সরকার আসবে-যাবে, কিন্তু চেতনা রয়ে যাবে আজন্ম। এই চেতনার মশাল জ্বালিয়ে দিয়েছে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এর হাত ধরেই!
কারো রক্তচক্ষু পরোয়া করেনি বাঙালি; কারো রক্তচক্ষু পরোয়া করে না প্রজন্ম আন্দোলন গণজাগরণ মঞ্চ!
কবির য়াহমদ, ব্লগার অ্যাক্টিভিস্ট: Kabiraahmed007@gmail.com
No comments