জার্নাল অব এ্যান আর্টিস্ট : রফি হকের চিত্রভ্রমণ by মোস্তাফিজ কারিগর

পেইন্টিং তার কাছে আবেগ জাগানিয়া কোনো বিষয় নয়, যাপিত জীবনের যাবতীয় ভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় হয়ে ওঠে ক্যানভাসে প্রধান অনুরণন। প্রতিদিনের দিনলিপির মতো করেই স্কেস খাতাই, ডায়েরির পাতায়, এচিং প্লেটে বা ক্যানভাসে প্রতিরূপ লাভ করে শিল্পীর সব অবলোকন। অতীত বা ভবিষ্যতের দিকে একবার দৃষ্টি ফেরালে যে দৃশ্য মনের ভেতরে নির্মাণ হয়, যা মুছে যায় না- এভাবে কল্পিত বা গঠিত কোনো মূর্তি বা প্রতিমূর্তিকেই ইমেজ আকারে প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন শিল্পী রফি হক। পৃথিবীর কত না দেশে দেশে ভ্রমণ, হাজারও মানুষের মুখের প্রকার, আনন্দ-বেদনার বিচিত্র মেলবন্ধন, প্রকৃতি, নদী, শৈশবের পাঠশালা, বন্ধুদের আবেগঘন স্মৃতি- অপার্থিব মরমি সঙ্গীতের মতো, কখনও বা টুকরো টুকরো কবিতা হয়ে মূর্ত হয়। শিল্পী রফি হক এভাবেই নির্মাণ করে চলেছেন একের পরে এক ইমেজ, হয় তা বাস্তবে ছিল; না হয় তাকে প্রতিস্থাপনের জন্যই গড়ে তুলেছেন- যা, দৃশ্যশিল্পের বিশেষ কোনো নিয়ম না মেনে সম্পূর্ণভাবে মানুষের বোধের স্তরে পৌঁছে দিতে পেরেছেন। শিল্পী রফি হক তার যাপিত জীবনের সব অনুষঙ্গের একটা ইউনিভার্সেল ইমেজ নির্মাণ করছেন, যা একান্তই ব্যক্তির ভেতরের গভীর বোধ বা আবেগ- একটা সময় তা আর কেবল একার থাকছে না, ছড়িয়ে পড়ছে অন্যের বোধের সীমানায়। এভাবেই তার কাছে প্রতিদিনের দিনলিপি, কবিতা আর চিত্রকর্ম একাকার হয়ে একটা মাধ্যমে পৌঁছায়। পিকাসো ঠিক যেভাবে কবিতাকে গুরুতর বিষয় বলে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বা পল ক্লীর ছবিতে সঙ্গীতের সিম্ফনি যেই প্রধান মাত্রা এনে দিয়েছে রফি হকেরও যাত্রা সেই অনাস্বাদিত আলোকের দিকে, যেখানে ভৌগোলিক কোনো সীমারেখা থাকে না, একটা মিথ্যা আবহ তৈরি করে ভেতরের নিবির মরমি সত্যকেই সবার করে তুলতে পারেন। কেন না চিত্রকলা, কবিতা, সঙ্গীত- একটা ইউনিভার্সাল চিহ্ন ছাড়া কিছুই নয়। একটা স্বতন্ত্র চিহ্ন আবিষ্কার করাই একজন শিল্পীর শিল্পভ্রমণ। চিহ্নই তো একসময় ভাষা হয়ে ওঠে। কেন না চিহ্নের ভেতরে এক ধরনের শূন্যতা থাকে, শিল্পী সেই শূন্যতার দিকে ধাবিত হয়েছেন। শিল্পী রফি হক সুজিত সরকারের কবিতার এ সত্যের কাছে পৌঁছে যেতে পেরেছেন
এক হাজার মানে এক তারপর তিনটি শূন্য
এক লাখ মানে এক তারপর পাঁচটি শূন্য
এক কোটি মানে এক তারপর সাতটি শূন্য
শূন্য মানে কিছু নয়
শূন্য মানে কিছু নেই...
চিত্ররীতির কোনো বিশেষ একাডেমিক শৈলীর কাছে হাত জোর করে বসে থাকতে চাননি রফি হক। একাডেমিকভাবে তার শিক্ষণের বিষয় ছিল ছাপচিত্র। তিনি ছাপা মাধ্যমেই কাজ করেন, কিন্তু নিজের মতো করে- নিজের ডায়েরির ছেঁড়া পাতা, পুরনো সাহিত্যপত্রিকার কবিতার পাতা, রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া বিস্কিটের প্যাকেট কোলাজ আকারে সেঁটে দেন কাগজে, প্রিন্ট মেশিনের ভেতরে ঢুকিয়ে দেন। ১৯৭১-এ পাকিস্তানি আর্মিরা তাদের কুষ্টিয়ার বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিলে বাড়ির বেড়াতে যে ফাঁকফোকর তৈরি হয়- ভাইবোন মিলে তখন বিভিন্ন সচিত্র ম্যাগাজিনে পৃষ্ঠা কেটে ফাঁকফোকর বন্ধ করার সময় থেকেই তার ভেতরে হয়তো এ কোলাজের ব্যাপারটি গভীরভাবে রয়ে গেছে। ম্যানুয়ালি প্রেসারের মাধ্যমে তৈরি করেন কিছু স্বকীয় টেক্সার। প্রিন্টের রঙের পরিবর্তে তেল রঙের ব্যবহারে তিনি স্বতঃস্ফূর্ত। ক্যানভাসেও তিনি একইভাবে গভীর ও নিয়মিত। তার এ নিজস্বতা এরই মধ্যে তাকে বিশেষভাবে পরিচিত দান করেছে দেশে এবং দেশের বাইরে। তারই ধারাবাহিতকায় ৭ এপ্রিল শিকাগো ইউনিভার্সিটির, ফস্টার হলের ১০৩ নং কক্ষে শুরু হয়েছে জার্নাল অব এ্যান আর্টিস্ট শিরোনামে শিল্পী রফি হকের একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর, চলবে ২৩ মে ২০১৪ পর্যন্ত- যা আমাদের দেশের শিল্পকলা জগতের জন্য বিশেষ অহংকারের। ১০ এপ্রিল তাকে নিয়ে আর্টিস্ট টকেরও আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের সমকালীন চিত্রকলার স্বরূপ ও গতিপ্রকৃতি নিয়ে একটা বক্তৃতাও প্রদান করেন শিল্পী রফি হক।
শিল্পী রফি হকের জন্ম কুষ্টিয়া জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে ছাপচিত্রে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ। দেশে এবং দেশের বাইরে একাধিক একক ও দলীয় প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার।

No comments

Powered by Blogger.