চার বছরে ২৬৮ জন অপহূত-আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য by শরিফুল হাসান

২০১০ সালের ২৫ জুন ঢাকার শেরেবাংলা নগর থেকে অপহূত হন ঢাকার ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার বিএনপির নেতা চৌধুরী আলম। চার বছর হলেও এখনো তাঁর খোঁজ নেই। দুই বছর ধরে নিখোঁজ বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীও। এ ছাড়া পাঁচ মাস ধরে নিখোঁজ কুমিল্লা বিএনপির সাবেক সাংসদ সাইফুল ইসলাম।

কেবল বিএনপি নয়, জামায়াত-শিবির, ছাত্র ইউনিয়ন, এমনকি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বা এর সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা, ব্যবসায়ী কিংবা সাধারণ মানুষও একে একে যুক্ত হচ্ছেন অপহরণ তালিকায়। এই তালিকায় সর্বশেষ যোগ হলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক। তবে অপহরণের ৩৫ ঘণ্টা পর গতকাল গভীর রাতে তাঁকে ফিরে পাওয়া গেছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে ২৬৮ জন অপহূত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। অপহরণের পর ছেড়ে দেওয়া হয় ২৪ জনকে। পরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয় ১৪ জনকে। কিন্তু ১৮৭ জনের কোনো খোঁজই নেই। তাঁরা বেঁচে আছেন, নাকি মরে গেছেন, সেটিও জানে না পরিবার।
এর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ব্যাপকভাবে ‘ক্রসফায়ার’-এর ঘটনা ঘটলেও এখন অপহরণ ও গুমের ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে এসব অপহরণের অভিযোগ উঠলেও তারা সেগুলো অস্বীকার করে।

জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘চার-পাঁচ বছর ধরেই আমরা অপহরণ বা গুমের সংস্কৃতি দেখছি। অধিকাংশ সময়ই রাষ্ট্রের কোনো বাহিনীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ওঠে। কিন্তু এসব ঘটনার কোনো বিচার হয় না। জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি হয় না। বরং দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাগুলো অস্বীকার করছে। এ কারণে এ ধরনের অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। অন্যরাও এতে উৎসাহিত হচ্ছে।’
আবু বকর সিদ্দিক অপহরণের প্রসঙ্গ টেনে মিজানুর রহমান বলেন, এ ঘটনা যদি অপরাধীরাও ঘটিয়ে থাকে, তাহলেও প্রথমেই সন্দেহ চলে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ওপর। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ চাইলে প্রতিটি অপহরণ বা গুমের ঘটনার বিচার করতে হবে। রাষ্ট্রকেও এ ধরনের অনাচার বন্ধ করতে হবে।
আসকের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ৩৯টি অপহরণের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ছাত্রলীগের চারজন, ছাত্রদলের তিনজন, জামায়াত-শিবিরের দুই, বিএনপির ১১, ব্যবসায়ী তিন, চাকরিজীবী চার এবং সাধারণ নাগরিক ১১ জন রয়েছেন। এই ৩৯ জনের মধ্যে ১২ জনের লাশ উদ্ধার হয়। অপহরণের পর ছেড়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীসহ চারজনকে। অন্য ২৩ জনের খোঁজ নেই।
এঁদেরই একজন মফিজউদ্দিন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে নিখোঁজ।
র‌্যাব পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার প্রায় দুই মাস হয়ে গেলেও খোঁজ মেলেনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডের নিরাপত্তা তত্ত্বাবধায়ক (সিকিউরিটি সুপারভাইজার) মফিজউদ্দিনের।
তাঁর স্ত্রী লাইলী বেগম জানান, ঘটনার পরই তাঁরা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। প্রতিকার না পেয়ে র‌্যাব-৫-এর সদর দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও পুলিশের কাছেও অভিযোগ করেছেন। এসব অভিযোগের অনুলিপি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে পাঠানো হয়।
২০১৩ সালে ৬৮ জনকে অপহরণের তথ্য আছে আসকে। এর মধ্যে পরে পাঁচজনের লাশ উদ্ধার এবং ছয়জন ছাড়া পেলেও ৫৫ জনেরই খোঁজ নেই।
গত বছরের ২৭ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসার পথে কে বা কারা তুলে নিয়ে যায় সাবেক সাংসদ এবং লাকসাম বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম ও পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবিরকে। চার মাস পেরিয়ে গেলেও তাঁদের খোঁজ মেলেনি।
নিখোঁজ সাইফুলের ছেলে রাফসান বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার মাস পার হয়ে গেলেও আমার বাবা কোথায়, জানি না। বেঁচে আছে, না মরে গেছে, সেটি জানতে পারলেও মনে মনে সান্ত্বনা পেতাম।’
২০১৩ সালে নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে ছাত্রলীগের এক নেতাও আছেন। হবিগঞ্জের মাধবপুরের বহরা ইউনিয়নের ছাত্রলীগের সভাপতি বকুল খান গত বছরের ১৪ মার্চ নিখোঁজ হন। পরিবারের অভিযোগ, গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে গেছে। বকুলের বড় ভাই আজমল খান গতকাল ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মামলা করেছেন, কিন্তু ভাইয়ের খোঁজ পাননি।
গত বছরের ৪ ডিসেম্বর এক দিনেই ছয়জনকে মাইক্রোবাসে করে তুলে নেওয়া হয় রাজধানীর পান্থপথ থেকে। তাঁদেরও খোঁজ মেলেনি। তবে অপহরণের পর ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম, পাবনার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইব্রাহিম আলী মৃধাসহ পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
২০১২ সালে অপহূত হয়েছেন ৫৬ জন। এর মধ্যে ৩৪ জনের খোঁজ নেই। ওই বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল ইলিয়াস আলীর গুম। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল তিনি নিখোঁজ হন। তাঁর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণেই আমার স্বামীকে অপহরণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু তদন্ত সংস্থার কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তবে আমি এখনো আশা নিয়ে আছি।’
২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নিখোঁজ হন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আল মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহ। নানা জায়গায় খোঁজ করেও তাঁদের সন্ধান মেলেনি। একপর্যায়ে এ দুজনকে সশরীরে আদালতে হাজির করার জন্য ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট নির্দেশ দেন। মুকাদ্দাসের চাচা আবদুল হাই গতকাল আফসোস করে বলেন, ‘জানি না, আর কোনো দিন ভাতিজাকে পাব কি না।’
২০১১ সালে অপহূত হন ৫৯ জন। এর মধ্যে ১৬ জনের লাশ উদ্ধার হয়। পরে ছেড়ে দেওয়া হয় চারজনকে। ৩৯ জনের কোনো খোঁজ নেই। ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা কে এম শামীম আক্তার ২০১১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার পল্টন থেকে নিখোঁজ হন। তাঁর স্ত্রী ঝর্ণা খানম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় তিন বছর হতে চলল, স্বামীর খোঁজ পেলাম না।’
২০১০ সালে ৪৬ জনকে অপহরণের তথ্য আছে আইন ও শালিস কেন্দ্রে। এর মধ্যে ৩৩ জনের খোঁজ নেই। এই তালিকায় আছেন ঢাকার ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার বিএনপির নেতা চৌধুরী আলম। ২০১০ সালের ২৫ জুন ঢাকার শেরেবাংলা নগর থেকে তাঁকে অপহরণ করা হয়।
এ ছাড়া ২০০৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ২১ জন অপহরণের তথ্য আছে আসকে। এর মধ্যে তিনজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে।
আইন ও শালিস কেন্দ্রের পরিচালক (তদন্ত) নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অধিকাংশ সময়ই রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনীর বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ ওঠে। কিন্তু আবু বকর সিদ্দিক অপহরণের সঙ্গে কারা জড়িত সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। কোনো অপরাধী গোষ্ঠী যদি এটা করে থাকে, তাহলে বলতে হবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অপহরণের সংস্কৃতি এখন অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এটি খুবই ভয়াবহ ব্যাপার। এই সংস্কৃতি দ্রুত বন্ধ হওয়া জরুরি।’

No comments

Powered by Blogger.