নারায়ণগঞ্জে পৌঁছেছেন রিজওয়ানা ও তাঁর স্বামী

অপহরণের ৩৫ ঘণ্টা পর অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসা আবু বকর সিদ্দিক নারায়ণগঞ্জে পৌঁছেছেন। তাঁর সঙ্গে স্ত্রী পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও রয়েছেন।

>>অপহরণের ৩৫ ঘণ্টা পর ধানমন্ডি মডেল থানায় আবু বকর সিদ্দিক। স্বামীর পাশে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। গতকাল রাত আড়াইটায় ছবিটি তুলেছেন সাজিদ হোসেন
আজ শুক্রবার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়ার জন্য সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সেন্ট্রাল রোডের বাসা থেকে পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান আবু বকরকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে পৌঁছায়। সেখানে তাঁকে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে। এখান থেকে তাঁকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে।
এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে মিরপুরের আনসার ক্যাম্প এলাকায় তাঁকে নামিয়ে দিয়ে যায় অপহরণকারীরা। এ সময় তাঁর চোখ গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল। দীর্ঘ সময় গামছা বেঁধে রাখার কারণে তাঁর নাকের ওপরে কালসিটে দাগ পড়ে গেছে। তাঁর পোশাক কিছুটা ছেঁড়া ছিল।
ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আক্তার হোসেন বলেন, আজ সকালে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য আবু বকর সিদ্দিককে নারায়ণগঞ্জ আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে।
গতকাল দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে ধানমন্ডি থানায় আবু বকর সাংবাদিকদের বলেন, তাঁকে মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়ার প্রায় তিন ঘণ্টা পর একটি বাড়িতে নেওয়া হয়। তাঁর চোখ সার্বক্ষণিক বাঁধা ছিল। ধরে নেওয়ার সময় কিছু কিল-ঘুষি ছাড়া তাঁকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি। এ কথা বলার সময় থানায় তাঁর স্ত্রী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।

আবু বকর ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, গতকাল রাতে তাঁকে মিরপুরের আনসার ক্যাম্প এলাকায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়ার সময় পকেটে ৩০০ টাকা দিয়ে দেয় অপহরণকারীরা। তিনি সেন্ট্রাল রোডের বাসায় যাওয়ার জন্য প্রথমে একটি রিকশায় উঠে কাজীপাড়া পর্যন্ত আসেন। এরপর একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা পান। অটোরিকশার চালক হাফিজুর রহমান তাঁকে সেন্ট্রাল রোডের বাসায় নিয়ে যেতে রাজি হন।

হাফিজুর প্রথম আলোকে বলেন, লোকটি এসে তাঁকে বলেন, তিনি ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছিলেন। এরপর তিনি তাঁকে নিয়ে রওনা দেন। পথে কলাবাগান এলাকায় পুলিশ তাঁদের আটকায়।

কলাবাগান স্টাফ কোয়ার্টারের সামনে কলাবাগান থানার উপপরিদর্শক বাবুল রহমানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি তল্লাশি চৌকি অটোরিকশাটিকে আটক করে। এ সময় ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) অশোক কুমার চৌহান পুরো বিষয়টি জেনে আবু বকরকে ধানমন্ডি থানায় নিয়ে যান ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের খবর দেন।

অশোক চৌহান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলে, লোকটি জানান তাঁর নাম আবু বকর সিদ্দিক। তিনি রিজওয়ানা হাসানের স্বামী, নারায়ণগঞ্জ থেকে অপহূত হয়েছিলেন। এ সময় কিছুটা কাঁপছিলেন ও কাঁদছিলেন আবু বকর। এরপর অশোক চৌহান তাঁর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাকে ফোন করেন। ওই কর্মকর্তা এক মিনিটের মধ্যে রিজওয়ানার নম্বর দেন অশোককে। ওই নম্বরে ফোন করে অশোক ফোনটি ধরিয়ে দেন আবু বকরকে। কথা বলতে বলতেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করেন আবু বকর। এরপর তাঁকে ধানমন্ডি থানায় আনা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্বজন-বন্ধু, গণমাধ্যমের কর্মীদের ভিড় জমে যায় থানায়। তখন রাত সোয়া একটা।

রিজওয়ানা সাংবাদিকদের বলেন, ধরে নিয়ে যাওয়ার পর এক সেকেন্ডের জন্য চোখ খুলে দেওয়া হয়নি। কিন্তু কেন তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো, তা সম্পূর্ণ রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে। তারা ‘মোটিভ ক্লিয়ার’ করেনি। অপহরণকারীরা নিজেরা নিজেরা টাকার কথা বলছিল। তবে কেউ টাকা চায়নি। এমনকি তাঁর কাছে পরিবারের নম্বরও চায়নি। রিজওয়ানা বলেন, ‘টাকার জন্য এই অপহরণ করা হয়েছে বলে আমি প্রাথমিকভাবে মনে করছি না। প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়ে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’ কিসের চাপ? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমের চাপ তো ছিলই। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নিজে নির্দেশনা দিয়ে পুরো বিষয়টি তদারকি করছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্পরতাও ছিল অনেক বেশি।

কারা এটা করেছে? জানতে চাইলে রিজওয়ানা বলেন, ‘আধা ঘণ্টার মধ্যে এত কিছু জানতে পারা যায় না। তবে অপহরণকারীরা যে অপেশাদার নয়, সেটা আমরা বুঝতে পারছি।’ রাত সোয়া তিনটার দিকে থানা থেকে বাসায় যান আবু বকর।

ঘটনা শুনে থানায় ছুটে আসেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মুহম্মদ মারুফ হাসান ও নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম।

আবু বকর সিদ্দিক গত বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ভুইগড় থেকে অপহূত হন। এরপর রিজওয়ানা হাসান ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, ‘পেশাগত কারণে আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করে আসছি, যা অনেকের অর্থনৈতিক স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করেছে। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এসব মহল বিভিন্ন সময়ে আমার বিরুদ্ধে প্রচারমাধ্যমে নানা অপপ্রচার চালিয়েছে এবং বিভিন্নভাবে আমাকে আমার কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছে। আমার স্বামী নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে।’

তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, অপহরণকারীরা মাইক্রোবাস দিয়ে আবু বকরকে বহনকারী গাড়িটির পেছনে ধাক্কা দেয়। চালক মো. রিপন গাড়ির কোনো ক্ষতি হলো কি না, দেখতে নামলে তাঁর ঘাড়ে পিস্তল দিয়ে আঘাত করে প্রায় অচেতন করে ফেলে দুর্বৃত্তরা। রিপনের চোখে পেপার স্প্রে (মরিচের মতো ঝাঁজালো এক ধরনের রাসায়নিক) ছোড়া হয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে। অপহরণকারীরা আবু বকরের মুঠোফোন দুটিও নেয়নি। আর পুরো ঘটনাটি তারা ঘটায় এক মিনিটের মধ্যে। দক্ষ ও পেশাদারদের পক্ষেই এ রকম সম্ভব বলে পুলিশ বলছে।

ধরন একই: ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক আনসার আলীকে রাজধানীর বনানী থেকে ধরে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজন ও পুলিশের বর্ণনা অনুযায়ী, ইলিয়াসের গাড়িটিকে প্রথমে পেছন থেকে ভারী কোনো জিপ দিয়ে ধাক্কা দেওয়া হয়। এরপর চালক গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে নামলে তাঁদের দুজনকেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ঘটনাস্থলের পাশে থাকা একটি ভবনের এক নিরাপত্তাকর্মী গাড়ি ধাক্কা দেওয়ার শব্দ ও হইচই শুনেছেন।

আবু বকরকে অপহরণের প্রত্যক্ষদর্শী মোটর মেকানিক আবুল কালাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি একটি গাড়ি মেরামতের পর তা পরীক্ষামূলক চালানোর জন্য বের হন। এ সময় তিনি লাল রঙের কার থেকে একজনকে মাইক্রোবাসে ধরে নিয়ে যেতে দেখেন। ওই রাস্তাটিতে যানবাহনের চাপ বেশি। অল্প সময়ের মধ্যেই আরও কয়েকটি গাড়ি সেখানে দাঁড়ায়। পরে তিনি ওই গাড়ির পিছু নিয়ে চিটাগাং রোড পর্যন্ত যান। গিয়ে দেখেন, গাড়িটি বাঁ দিকে ঘুরে ঢাকার দিকে গেছে। গাড়ির নম্বর প্লেটে শুধু চট্ট মেট্রো লেখাটি তিনি দেখতে পেয়েছেন।

মাইক্রোবাসের নম্বর ভুয়া: জেলার পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, বুধবার রাত একটার দিকে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মাইক্রোবাসের ছবিটি পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, বুধবার দুপুর দুইটা ৫৩ মিনিটে মাইক্রোবাসটি ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় টোল দেয়। গাড়িটির নম্বর প্লেট কিছুটা ঝাপসা ছিল। অনেকভাবে যাচাই করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে নম্বর প্লেটে চট্ট মেট্রো গ-১৭-৮৩২৭ নম্বরটি লেখা ছিল। তবে বিআরটিএতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এটি ভুয়া নম্বর। সাধারণত মাইক্রোবাসের নম্বর প্লেট হয় ‘চ’ ক্রমিকের। আর কারের নম্বর হয় ‘গ’ ক্রমিকের।

No comments

Powered by Blogger.