রাজনীতিক ও তাঁদের গুরুরা by শশী থারুর

ভারতের চলমান সাধারণ নির্বাচন কেবল পদাকাঙ্ক্ষী রাজনীতিক, প্রচারণা ব্যবস্থাপক, প্রচারকর্মী আর ভোটের তদবিরকারীর চিরচেনা দলটিকেই সামনে তুলে আনেনি, সেই সঙ্গে আলোচনায় এনেছে একঝাঁক জ্যোতিষী, সংখ্যাতাত্ত্বিক আর পণ্ডিতকে। প্রার্থীরা ঝাঁকে ঝাঁকে এসব গণকের কাছে হাজির হচ্ছেন। ঠিক কোন লগ্নে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া উচিত, তা থেকে শুরু করে প্রচারণা অফিসের দরজার বিন্যাস পর্যন্ত হেন বিষয় নেই, যা নিয়ে গুরুজির পরামর্শ চাইছেন না তাঁরা।

ভারতীয়রা আসলে আধুনিকতা ও কুসংস্কারের এক বিরল মিশেলের মধ্যে বাস করেন, যা তাঁদের একেবারেই এক আলাদা জাতের জনগোষ্ঠী হিসেবে তুলে ধরে। বিশ্বের কোথায় আর একজন মানুষের কোষ্ঠী নিয়ে এত মাতামাতি হয়? রহস্যময় ওই মহাজাগতিক তথ্যভান্ডারে নাকি ব্যক্তির জীবনের সব সুযোগ আর জন্ম, মৃত্যু, বিবাহের মতো তথ্য সঞ্চিত থাকে। আমি বেশ আগে একবার লিখেছিলাম, রাশিচক্র ছাড়া একজন ভারতীয় ক্রেডিট কার্ড ছাড়া একজন মার্কিনের সমান। সেই পর্যবেক্ষণ এই একুশ শতকেও তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে, এমন লক্ষণ দেখছি না। আর এই সত্য, বিশেষ করে যেন ভারতীয় রাজনীতিতে, বদ্ধমূল হয়ে গেড়ে বসেছে। একজন ধর্মবিশ্বাসী হিন্দু হিসেবে আমি নিজে পুরো যুক্তিবাদী হওয়ার দাবি করি না। কিন্তু জ্যোতিষী শপথ নেওয়ার নির্ধারিত সময়টি শুভ নয় বলায় একজন মন্ত্রীর শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান যখন বিলম্বিত হয় কিংবা কোনো এমপি পদপ্রার্থী অশুভ সময়ে গ্রহ-নক্ষত্রের মন্দ প্রভাব এড়াতে একেবারে শেষ মুহূর্তে গিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন, তখন আমি হতবুদ্ধি না হয়ে পারি না। কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক জগতে দুটোই সাধারণ ঘটনা।
জ্যোতিষীর কথায় শুধু শপথ নেওয়ার সময়ই নির্ধারিত হয় না, নতুন মন্ত্রী কখন প্রথম দপ্তরে প্রবেশ করে কাজ শুরু করবেন, তা-ও ঠিক হয় পুঁজিপাথি ধরে। অনেক মন্ত্রী শপথ নেওয়ার বেশ কয়েক দিন পরও কাজে যোগ দেন না, গ্রহ-নক্ষত্র কখন আরও শুভ অবস্থানে আসবে, তার অপেক্ষায় টেবিলে ফাইল জমা হতে থাকে। মন্ত্রীদের কার্যালয়, আবাসন ও আসবাব বাছাইয়ের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে কুসংস্কার।
এ বিষয়ে আমার প্রিয় গল্পটি একজন মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে। তিনি তাঁর সরকারি বাসভবনে উঠতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কারণ, একজন পণ্ডিত বলেছিলেন, বাড়িটা বাস্তুরীতিনীতি যথাযথভাবে মেনে নির্মিত হয়নি। কাজেই সেখানে উঠলে তাঁর মঙ্গল হবে না। বিপুল সরকারি অর্থ ব্যয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাংলো বাস্তুনীতি মেনে পুনর্নির্মাণ করা হয়। পণ্ডিতকে সন্তুষ্ট করতে বদলানো হয় বাড়ির দরজা-জানালার বিন্যাসও। অবশেষে মুখ্যমন্ত্রী নতুন বাসভবনে উঠলেন। মজার ব্যাপার, এত বিধিবিধান মেনে ওই বাড়িতে ওঠার পরদিনই অপ্রত্যাশিত এক রাজনৈতিক সংকটে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর পদ (এবং নতুন বাসভবন) খোয়ালেন।
এমনিতে মেধাসম্পন্ন, শিক্ষিত মানুষ কেন এমন কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে কাজ করে? ঈশ্বরকে প্রসন্ন করার জন্য মানুষের যে সহজাত আকাঙ্ক্ষা থাকে, তার পুরোপুরিই পক্ষে আমি। এ ধারণাও মেনে নিতে তৈরি আছি যে মহাবিশ্ব হয়তো সত্যিই এর গ্রহ-নক্ষত্রের প্রতিটি অবস্থানের মাধ্যমে আমাদের কোনো না কোনো সংকেত পাঠাচ্ছে। কিন্তু গণকেরা ওই সংকেত বোঝেন, তা আমরা এ রকম চোখ বুজে মেনে নিই কীভাবে? অল্প কিছুদিন আগেই তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী সাবেক অভিনেত্রী জয়ললিতা তাঁর নামের ইংরেজি বানানের শেষে একটি বাড়তি ‘এ’ বর্ণ যুক্ত করেন। একজন জ্যোতিষ বলেছিলেন, নতুন বানান জয়ললিতার অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য শুভ হবে। জয়ললিতা এর পরপরই নিজ রাজ্যের নির্বাচনে জয়লাভ করেন। তবে পরেরটিতে হেরে যান এবং তারপর আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন।
ধরে নিলাম এটা সম্ভব যে জয়ললিতা একটা ‘এ’ দিয়ে নিজের নাম লিখে যে সাফল্য পাচ্ছিলেন না, দুটো ‘এ’ দিয়ে লিখে তা পেয়েছেন। কিন্তু নামে একটা মাত্র বাড়তি স্বরবর্ণ যোগ করেই পরিস্থিতি বদলে গেল, এ কথার ভিত্তি কী? ঈশ্বর নামের মধ্যে স্বরবর্ণের সংখ্যার ভিত্তিতে মর্ত্যলোকের বাসিন্দাদের মধ্যে দাক্ষিণ্য বিতরণ করেন, তা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু অনেক ভারতীয়ই জোরালোভাবে এসব বিশ্বাস করেন। চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র তারকা উভয়ের নামের ক্রমেই বেশি করে অদ্ভুত হয়ে ওঠা এর প্রমাণ। ভারতের সেরা অভিনয়শিল্পীদের একজন ইরফান খান হঠাৎ তাঁর নামের বানান বদল করলেন। অনেকেই কসম খেয়ে বলেন, এ পরিবর্তনের পরই তাঁর ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায়।
নয়াদিল্লির রাজনৈতিক মহলে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপারে অনেক গল্প চালু আছে, যিনি তাঁর প্রাত্যহিক জীবনে একজন সাধুর নির্দেশনা মেনে চলতেন। গল্প আছে সাবেক এক অর্থমন্ত্রীকে নিয়েও। তিনি নাকি জ্যোতিষশাস্ত্র মেনে সরকারি কাজকর্মের সিদ্ধান্ত নিতেন। বেশির ভাগ ভারতীয় রাজনীতিক নিজ নিজ রাশিমতো নির্দিষ্ট গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি অনুযায়ী বা তাঁদের রাশিতে কোনো গ্রহের ক্ষতিকর প্রভাব এড়াতে বিভিন্ন পাথরের আংটি পরেন। অনেকেই জোর দিয়ে বলেন, এগুলো তাঁদের কাজে লাগে। অনেকে আবার মনে করেন, এ ধরনের বিশ্বাসে আংটির দাম ছাড়া কোনো ক্ষতি অন্তত নেই।
তবে জানা গেছে যে কেবল ভারতীয় রাজনীতিকেরাই ভারতের ‘তন্ত্রমন্ত্র মাফিয়ার’ প্রলোভনের শিকার হন না। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী নটবর সিং সাম্প্রতিক এক স্মৃতিকথায় লিখেছেন, খোদ সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের মতো ব্যক্তিত্ব ভারতীয় সাধু চন্দ্রস্বামীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। রক্ষণশীল দলের নেতা হওয়ার অল্প দিন পরই চন্দ্রস্বামীকে তাঁর দলীয় কার্যালয়ে আমন্ত্রণ করে নেন থ্যাচার।
চন্দ্রস্বামী মনের কথা পড়ার ক্ষমতা দেখিয়ে মার্গারেট থ্যাচারকে এতটাই মুগ্ধ করেছিলেন যে তিনি আবার তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। সে সাক্ষাতের সময় সাধুর পরামর্শমতো থ্যাচার পরেছিলেন লালরঙা পোশাক আর একটি মন্ত্রপূত মাদুলি। চন্দ্রস্বামীই মাদুলিটা দিয়েছিলেন থ্যাচারকে। দ্বিতীয় সাক্ষাতে চন্দ্রস্বামী নির্ভুলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে থ্যাচার চার বছরের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং তিনি ৯, ১১ বা ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকবেন। থ্যাচার ক্ষমতায় ছিলেন ১১ বছর।
মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে অবশ্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ তফাত রয়েছে। থ্যাচার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার
অল্প দিন পরই এক সাক্ষাতে লন্ডনে তখনকার ভারতীয় হাইকমিশনার নটবর সিং তাঁকে একান্তে বলেছিলেন, ‘আমাদের সাধুর কথা তো ফলে গেল।’ এ কথায় থ্যাচারের প্রতিক্রিয়া বিস্মিত করেছিল নটবরকে। তিনি লিখেছেন, ‘ক্ষণিকের জন্য তাঁকে হতবাক মনে হলো।’ তারপর থ্যাচার নটবরকে এক পাশে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘হাইকমিশনার সাহেব, আমরা এসব নিয়ে কথা বলি না।’
ভারতীয়রা অবশ্য এসব নিয়ে কথা বলে: কারণ ভারতীয় মন সংস্কারাচ্ছন্ন হতে পারে, তবে ভণ্ডামিভরা নয়।

ইংরেজি থেকে অনূদিত
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর: ভারতের মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী ও লেখক।

No comments

Powered by Blogger.