উদার গণতান্ত্রিক শক্তির সামনে চ্যালেঞ্জ by কুলদীপ নায়ার

নির্বাচনী প্রচারণায় মুসলমানদের হুমকি দেওয়া ও পরে অভিযোগ করা যে মিডিয়া এটা ভুলভাবে বা প্রেক্ষিতহীনভাবে উপস্থাপন করেছে, এ বিষয় এখন রীতিমতো ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। বিজেপির এক প্রাদেশিক নেতা বলেছেন, যাঁরা মোদিকে ভোট দেবেন না, তাঁদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ভালো ব্যাপার হচ্ছে, বিজেপি এ মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ওই নেতাকে বহিষ্কার করলে দলটি আরও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করত। অন্যদিকে জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেছেন, তিনি মোদির রাজত্বে নির্জীব বসে থাকার চেয়ে পাকিস্তানে যাওয়া শ্রেয় মনে করেন। তাঁর এ মন্তব্যও রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিচয় বহন করে না।

প্রতিদিনই পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আমার কাছে ফোন আসছে লোকসভা নির্বাচন নিয়ে অনুসন্ধানী নিবন্ধ লেখার জন্য। তাঁদের মনে ভয়, মোদি ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করবেন, যার ব্যাপারে তাঁদের মনে ঈর্ষাও আছে। আমি আশা করি, মোদি পরবর্তী সরকারের প্রধান হবেন না।
এটা সত্য, সব মতামত জরিপেই দেখা যাচ্ছে, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স বা এনডিএ জোট ও এর নেতা মোদি পরিষ্কারভাবে এগিয়ে আছেন। কিন্তু এসব জরিপ নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ, মোদির সমর্থনে দক্ষিণের রাজ্যগুলো, যেমন অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক, কেরালা ও ওডিশায় মোদি-সমর্থনের কোনো তরঙ্গও দেখা যাচ্ছে না, ঢেউ তো বহু দূরের ব্যাপার। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুতেও বিজেপির দশা করুণ হতে পারে; এসব স্থানে আঞ্চলিক দলগুলো ভোট কাটে। দেশের অন্যান্য স্থানেও আরএসএসের আশীর্বাদপুষ্ট নেতারা যে উত্তপ্ত ভাষা ব্যবহার করছেন, তাতে বুদ্ধিজীবী ও দোদুল্যমান ভোটাররাও বিজেপি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।
তার পরও বিজেপি ও তার বুদ্ধিদাতা আরএসএস জনগণের প্রতিক্রিয়ার ভুল পাঠ করছে। জনগণ হিন্দু ও মুসলমান হিসেবে বিভাজিত হতে চায় না। সমাজ এমন কোনো রাজনৈতিক নেতাকে চায় না, যাঁর রাজনীতি বিভাজনমূলক, এমনকি কর্তৃত্বপরায়ণ। বিজেপি ও আরএসএস যা-ই বলুক না কেন, তারা বহুত্ববাদিতাকে বিনষ্ট করতে পারবে—এটা আমার মনে হয় না। গুজরাটে ২০০২ সালের মুসলমানবিনাশী দাঙ্গায় মোদির সম্পৃক্ততা নাকচ করে দেওয়া যাবে না; যদিও গুজরাটের একটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাঁকে নির্দোষ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। সে সময় তিনি ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, এই হিসেবে সবকিছুর দায়দায়িত্ব তাঁর ওপরই বর্তায়। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তিনি এমনকি দুঃখ প্রকাশও করেননি, ক্ষমা চাওয়া তো বহু দূরের ব্যাপার। কিছুদিন আগে তিনি দুঃখ প্রকাশের একটি সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
তার পরও একজন হিন্দুত্ববাদী নেতা ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। মোদির বক্তব্য জাতীয়তাবাদী হলেও তাতে পাকিস্তানের উল্লেখ নেই। কিন্তু তিনি গুজরাটে উন্নয়নের আড়ালে তাঁর সাম্প্রদায়িক চেহারাটা ঢাকার চেষ্টা করছেন। অনেকেই বিশ্বাস করেন, তাঁকে ভারতের বৈচিত্র্যের মুখোমুখি হতে হবে এবং তিনি আরেকজন অটল বিহারি বাজপেয়িতে রূপান্তরিত হতে পারেন। বাজপেয়ি ছিলেন পাকিস্তানে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী।
মোদির রাজনৈতিক সূচি যা-ই হোক না কেন, প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে তিনি খারাপ সম্পর্ক রেখে চলতে পারবেন না। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার পর বন্ধ হয়ে যাওয়া আলোচনাও তিনি আবার শুরু করতে পারেন। মোদি ও বিজেপির রাজনৈতিক বয়ান যা-ই হোক না কেন, উভয়েরই এই উপলব্ধি আছে যে ইসলামাবাদের সঙ্গে একটি কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার এবং তা নয়াদিল্লির স্বার্থেই।
পাকিস্তানে মৌলবাদের ছায়া ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের ওপর চরমপন্থীদের আক্রমণ হচ্ছে। তারা সাহসী ও গণতান্ত্রিক শক্তির পেছনে অবস্থান নিয়েছে। হামিদ মিরের মতো একজন স্বাধীন সাংবাদিকের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। তবে সেখানকার জনগণ মনে করছে, ভারতের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকলে গণতন্ত্র ও মুক্তচিন্তা আরও শক্তিশালী হবে।
অক্সফোর্ডে অধ্যয়নরত এক পাকিস্তানি ছাত্র কিছুদিন আগে আমার বাসায় এসেছিলেন। তিনি পাকিস্তান সফর করে এসেছেন। তিনি আমাকে এ কথা বলতে কোনো দ্বিধা করলেন না যে পাকিস্তানের উচিত ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। তালেবান ও তেহরিক-ই-তালেবানের শঙ্কা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এটাই একমাত্র বিকল্প। তাঁর, একই সঙ্গে আমারও আক্ষেপ হচ্ছে, প্রথিতযশা উদারনীতিকেরা চুপ করে থাকেন। আমি তাঁকে বলেছি, ভারতও একই রকম অবস্থার শিকার হয়েছে; এই দেশেও প্রচ্ছন্ন হিন্দুত্ববাদী মনোভাব ক্রমে আরও বেশিসংখ্যক মানুষের মনে বাসা বাঁধছে। আমরা দুজনই ঐকমত্যে এলাম, দুই দেশের মধ্যে ভালো ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কোনো বিকল্প নেই।
আমার হতাশা হচ্ছে, ভারত একটি গণতান্ত্রিক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও এ অঞ্চলে দেশটি তার যথাযথ ভূমিকা পালন করছে না। এখানে ইটের বদলে পাটকেল ছোড়াছুড়ি হচ্ছে বড্ড বেশি। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পাকিস্তান সম্পর্কে একটি বিশেষ মানসিকতা আছে। তাঁরা এই বয়ানকে দেশভাগের সময়ে নিয়ে যান নিজেদের আধিপত্যকামী মানসিকতার পক্ষে যুক্তি দেওয়ার জন্য। তরুণেরা একরকম ঘোরের মধ্যে আছেন। তাঁরা চাকরি খোঁজেন এবং ব্যবসা খুলতে চান, ভারতের মতো দেশের পক্ষে যে সুযোগ দেওয়ার কথা। দুই দেশের মধ্যকার বৈরিতার কারণে এ ব্যাপারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা জনগণের দোষ নয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও গোয়েন্দারা এর জন্য দায়ী।
বাংলাদেশ থেকে যাঁরা আমাকে ফোন করেছেন, তাঁরা কেউ ভারতের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র নিয়ে সন্দিহান নন। কিন্তু মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনায় তাঁরা অখুশি। তাঁদের দেশে জামায়াতে ইসলামীর উত্থান হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত কীভাবে সেখানে অসাম্প্রদায়িকতা মার খেয়েছে, তা প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁরা কখনো চিন্তাও করেন না যে এই মৌলবাদীরা, যাঁরা স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিলেন, তাঁরা উন্মত্ত হয়ে সেখানে হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করবেন, যা ঘটে আসছে পাকিস্তানে।
আমি মনে করি, পশ্চিমে যেভাবে ধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটছে, এই উপমহাদেশেও একইভাবে তা ঘটবে। ভারত হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলোর লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। তারা এই রাষ্ট্রকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। কিন্তু এটা সম্ভব নয়, কারণ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এখানে শত শত বছর ধরে একত্রে বসবাস করে আসছে। হিন্দু ও মুসলমানরা এখানে হাজার বছর ধরে একত্রে বসবাস করছে।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হচ্ছে। উত্তর প্রদেশের মুজাফফরনগরে কিছুদিন আগের ঘটনায় দেখা যায়, আমরা একদম খাদের কিনারে বাস করছি। আক্রান্তরা ঘরে এখন ফিরেছে, সবকিছু ঠিকও হয়ে গিয়েছে। সবাই অনুধাবন করতে পেরেছেন, তাঁরা প্রথমে ভারতীয়, তার পরে হিন্দু, মুসলমান ও শিখ। এই ভারতীয় পরিচয় পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণকে একসূত্রে গেঁথে রেখেছে।
বিজেপি, আরএসএস, মহারাষ্ট্রের শিবসেনা প্রভৃতি দলের কারণে ভারতের যৌথতা ও সহনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার পরও সংবিধানের কারণে ঐক্য বজায় রয়েছে। বর্তমান লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয়দের সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপর আস্থার পরীক্ষা হবে। এই অনুভূতি কতটা শক্তিশালী থাকে, তা বোঝা যাবে যখন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় মৌলবাদীরা ক্ষমতায় আসবে। মোদির সমর্থকেরা তাদের অনুকরণ করছেন। ভারতে যাঁরা বহুত্ববাদী আদর্শ বুকে ধারণ করেন, তাঁদের উপলব্ধি করতে হবে যে এই দেশ যদি দক্ষিণপন্থী যাত্রা শুরু করে, তাহলে তাঁদেরও বহুত্ববাদ রক্ষার লড়াই শুরু হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.